২২ ডিসেম্বর চিরতরে চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের দশ শব্দসৈনিকদের একজন- রাশিদুল হোসেন (কাগজে-কলমে হোসেন হলেও হাসান কথাটিই বেশি পরিচিত)। আগারগাঁওস্থ বেতার ভবনে তাঁর নামাজে জানাযায় সেদিন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। চেনা মুখগুলো বারবার নিয়ে যাচ্ছিল একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে। আর তা থেকেই এ লেখার অবতারণা।
কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশের যে ভৌগলিক সীমারেখা, সেখানে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। সালটা ১৯৩৯। বৃটিশ আমলেও প্রথম যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল বেতার থেকে, তা বাংলায়। ঢাকা ধ্বণি বিস্তার কেন্দ্র। কেন যেন সম্প্রচারকর্মীরা সবসময়ই অগ্রগামী। এমনকি একাত্তরও এর ব্যতিক্রম নয়। কানে বাজছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ-‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর’। মার্চ জুড়ে লোকজন লাঠি-সোটা নিয়ে কুচকাওয়াজ শুরু করলো। সে এক অন্যরকম উন্মাদনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি কথাকে বুকে ধারণ করে তাৎক্ষণিক কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কেউ বুঝি বেতারের আগে নয়। ৪ মার্চ থেকেই ‘রেডিও পাকিস্তান’ নামটি বর্জন করে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হন না এমন বাঙ্গালী বিরল। যুদ্ধের নয়মাসে তাঁর বজ্রকন্ঠ যেমন সবার মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল, তেমনি আজও সেই ভাষণ সবাইকে দেশকে নিয়ে নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখায়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা এমন আর একটা ভাষণ কল্পনা করতে পারিনা, যা অন্তত সবার স্মৃতিতে বিরাজমান। সেই ঐতিহাসিক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার আহ্বান সবার মধ্যে পৌঁছে যেত না, যদি না আমাদের বেতারকর্মীরা ৭ মার্চের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি না নিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হওয়ার সময় ছিল বেলা তিনটায়। দুপুর ১২টায় দ্বিতীয় অধিবেশন শুরুর পর থেকে বারবার ভাষণ প্রচারের ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। বেতারকর্মীরা যখন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণটি প্রচারের সব উদ্যোগ চূড়ান্ত করে ফেলেছে, তখনই জানা গেল, পাকিস্তানী শাসকরা এ ভাষণ প্রচার করতে দিবেনা। কথাটা মঞ্চে বসা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিলেন বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফ-উজ-জামান খান। সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াই ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। তাইতো সেখানে তাঁর নির্দেশ ছিল-‘রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোন বাঙ্গালি রেডিও স্টেশনে যাবে না’। সন্ধ্যা নাগাদ দেখা গেল, শাহবাগ সম্প্রচার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কাজের জন্য কেউ নেই। বেতার তরঙ্গ নিঃশব্দ হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে পাকিস্তানী সরকারের হটকারী সিদ্ধান্তের। টনক নড়লো কর্তৃপক্ষের। খোঁজ পড়লো সেই শব্দসৈনিক আশরাফ-উজ-জামান খানের, যার নির্দেশে সব বেতারকর্মীরা নিমিষেই সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে উধাও হয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হল। পরদিন ৮ মার্চ সকাল ৮-৩০-য়ে প্রচারিত হল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, যার প্রতিটি কথা আজ মানুষের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে আছে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেখানেও আমরা দেখতে পাই আমাদের শব্দসৈনিকদের। শব্দসৈনিকেরা তখন অগ্রসৈনিক। আর কেউ তাদের মত এত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা দূরদর্শিতা না থাকলে এটা কখনও সম্ভব নয়। এর প্রমাণ পাই আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যার ভাষণ থেকে। বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর পূর্তিতে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্লেষণ করেছেন সম্প্রচারকর্মীদের কর্মকাণ্ডকে। তাঁর ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করাই এখানে সঙ্গত হবে। ‘১৯৬১ বা ’৬২ সাল। আমরা চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন আবদুল আজিজ সাহেব। বাঙ্গালীর আলাদা যে একটা ভূখণ্ড দরকার, স্বাধীনতা দরকার, এটা কিন্তু জাতির পিতা সবসময় উপলব্ধি করেছেন। সেভাবেই তিনি কিন্তু সংগ্রাম করেছেন। .. আমার এখনও মনে আছে, যখন টাইগারপাস আমরা দেখতে যাই, তখন আজিজ কাকা বলেছিলেন যে একদিন এ জায়গা থেকে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবে। আর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কাছে যেয়ে বলেছিলেন যে এ জায়গা থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমরা ঘোষণা করব’। কি আশ্চর্য, ২৬ মার্চ থেকে পরবর্তী চারদিনের কর্মকাণ্ড সেই প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিল। ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই গঠিত হল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা দিলেন। বেতার উপস্থাপকদের কন্ঠস্বর সবারই পরিচিত। তাই ধরা পড়ার ভয় মাথায় রেখেই চেষ্টা চললো উপস্থাপকদের কন্ঠে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ না করে গ্রহণযোগ্য বিকল্প খোঁজার। মনে রাখতে হবে, বেতারকর্মীর কাজ শুধু কন্ঠ দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর মূল কাজই হচ্ছে নেপথ্যে থেকে পরিকল্পনামাফিক অনুষ্ঠান আদায় করে নেয়া। তাইতো প্রথমদিকের দশ শব্দ সৈনিকদের একজন বেলাল মোহম্মদ নিজেদের ‘মাইনর’ উল্লেখ করে খুঁজে বের করলেন একজন মেজরকে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ইতিহাসের পাতায় সবকিছুই লেখা আছে। ৩০ মার্চ কালুরঘাটে বিমান হামলা করা হল। অকুতোভয় শব্দসৈনিকেরা এরই মধ্যে ট্রান্সমিটার খুলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে পাড়ি জমালেন ভারতে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর যে বর্বরোচিত হামলা করেছিল, তা প্রতিহত করার জন্য আমরা সংঘটিত হই মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে। সারা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র হিসেবে নবোদ্যমে কাজ শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। একে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের ১২ নম্বর সেক্টর। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা- বিভিন্ন আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারকর্মীরা জড়ো হতে থাকে কলকাতার বালিগঞ্জ স্ট্রিটে।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সাড়ে সাত কোটি জনগণের আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আঞ্চলিক ভাষায় এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শোনার জন্য কান পেতে থাকতো সবাই। কল্যাণ মিত্রের লেখা ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর করুণ দশা শোনার পর সে কাহিনী ঘুরে বেড়াতো লোকের মুখে মুখে। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পাঠাতেন আশরাফুল আলম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ সময় জনপ্রিয় হয় বেশ কিছু অবিসংবাদিত গান- শোন একটি মুজিবরের, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, তীরহারা ঐ ঢেউয়ের সাগর ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কাজের মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত ছিলেন যেসব অনুষ্ঠান সংগঠক- শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান খান প্রমুখ তাঁদের অন্যতম। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয় কামাল লোহানী, আলী যাকের সহ আরও অনেককে। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীরা সেদিন এ কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ বেতার। সবাই যখন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তখন আমরা দেখি এসব সংগঠকরা মেতে উঠেছেন তাদের পুরনো অস্ত্রের যথার্থ ব্যবহারে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা দেখি বেতারের জন্য দেশের স্বনামধন্য কবিরা গান লিখছেন, সেরা সুরকাররা সুর করছেন- জন্ম নিয়েছে অমর অনেক দেশাত্মবোধক গান। স্বাধীন দেশে ট্যালেন্ট হান্টের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বেতারের অনুষ্ঠানমালা থেকে বের হয়ে এসেছে সুবীর নন্দী, শাম্মী আখতারের মত সংগীত শিল্পী। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের আর্কাইভে মুক্তিযোদ্ধাদের অমর গাঁথা রেকর্ড করে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টাও চলেছে। কিন্তু শব্দসৈনিকেরা কখনও তাঁদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কিছু চাননি এবং পাননি। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম দশ শব্দসৈনিককে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য গেজেট জারী হলেও পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর তা দীর্ঘদিন বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে ২০১৪ সালে হীরক জয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী সেই দশ শব্দসৈনিকদের সম্মাননা দিলেন।
বাংলাদেশ অনেক বড় বড় অর্জনের পাশাপাশি একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রয়েছে, যা না জানালে এ বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির সর্বশেষ্ঠ সন্তানকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর মেজর ডালিমরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা শাহবাগের বাংলাদেশ বেতার থেকেই। সেদিন খন্দকার মোশতাকের মত আওয়ামী লীগের কেউ কেউ যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করে ঘাতক চক্রের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, তেমনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন বিশিষ্ট শিল্পী আপেল মাহমুদ হাত মিলিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেজর ডালিমের সাথে।
আপেল মাহমুদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ বিখ্যাত গানটি গেয়ে দেশের আপামর মানুষের হৃদয়ে সশ্রদ্ধ আসনে আসীন থাকলেও স্বাধীন দেশে এ গানটিকে বিক্রি করে বারবার পুরস্কার নিয়েছেন। বাংলাদেশ বেতারে প্রথম শ্রেণীর পদে যোগদানের ক্ষেত্রে প্রথম পদটি হচ্ছে অনুষ্ঠান সংগঠক। চাকুরির যোগ্যতা না থাকলেও গানের শিল্পী হিসেবে তিনি বলতে গেলে ডবল প্রমোশনের চেয়েও বেশি কিছু পেলেন। তিনি যোগ দিলেন আরও এক ধাপ উপরে- সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে। সেসময় তারই নেতৃত্বে পাকিস্তানীদের চিহ্ণ মুছে ফেলার নামে মুছে ফেলা হয় সব টেপ, ভেঙ্গে ফেলা হয় ডিস্ক। এসব কাজ সুপরিকল্পিত নাকি অপরিপক্কতার বহিঃপ্রকাশ- তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা একথা সহজেই অনুমেয় যে, রাজাকারদের বিচার করতে গেলে এ অডিও ডকুমেন্টগুলো মহামূল্যবান প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারত।
পঁচাত্তরে মেজর ডালিমের ডান হাত হিসেবে আবারও ডবল প্রমোশন নিয়ে পঁচাত্তরে পরিচালক পদে পদোন্নতি পান আপেল মাহমুদ। পরবর্তীতে পটপরিবর্তন হলে নতুন সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে তার আত্মউন্নতির প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল সারা জীবন। উদাহরণ- বিএনপি আমলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদক পেয়েছেন আপেল মাহমুদ। একই সময়ে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান শাখার সর্বোচ্চ পদ উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) হিসেবে অবসরের পরও দুই বছর অতিরিক্ত চুক্তিভিত্তিক চাকরি তিনি করেছেন। তবে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনা। রাজাকারদের বিচার যেমন এদেশের মাটিতে হচ্ছে, তেমনি শেষ পর্যন্ত রাতের অন্ধকারেই তিনি বিদায় নিয়েছেন বেতার থেকে।
আপেল মাহমুদের নানাবিধ প্রাপ্তির পরও আজ পিছন ফিরে তাকালে আমাদের ভাবতে হবে-ইতিহাস কিভাবে মূল্যায়ন করবে এই সংগীত শিল্পীকে? একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি গানটির জন্য শিল্পী হিসেবে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বারবার কী আমরা ক্ষমা করে দিব জাতির পিতার হত্যাকারীদের সাথে হাত মেলানো এই স্বার্থপর মানুষটিকে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের বহুমুখী অবদান রয়েছে। আমরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিব ? নাকি বারবার ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিব সেই একজনকেই?
(ছায়াসঙ্গীর বচন ,ব্রডকাস্ট সাংবাদিক)