শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমকে গতিশীল করতে গ্লোবাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হচ্ছে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ করছে, যার নাম দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিরেন)। চলতি বছরের মধ্যেই এর কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১০০টি দেশের গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারবে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষা এবং গবেষণাকর্মের গুণগত মানোন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারবে। একইভাবে দেশের শিক্ষকরাও অন্য দেশে পাঠদান করতে পারবেন।
বিডিরেনের আন্তর্জাতিক সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাবেদ ইকবাল খান বলেন, দেশের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো প্রয়োজন। এজন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ চলছে। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের সব শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হবে।
শিক্ষা ও গবেষণায় নানা তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হয়। তথ্যের অভাবে অনেক সময় গবেষকরা তাদের গবেষণাকর্ম সম্পাদন করতে পারেন না। এ উপলব্ধি থেকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা প্রত্যেক দেশে রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক (রেন) তৈরির পরিকল্পনা করেন। ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলো ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক (ইইউ) ও আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলো আমেরিকান নেটওয়ার্ক (এইউ) তৈরি করে। এছাড়া চীন, ভারত. জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশসহ ১৯টি দেশের সমন্বয়ে ট্রান্স-ইউরেশিয়া ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (টিইআইএন) তৈরি করা হয়। বিডিরেনের কাজ শেষ হলে এ গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সুবিধা পাওয়া যাবে।
সূত্রমতে, বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশেরই কনটেন্ট হোস্টিং করতে হয় বিদেশে। অভ্যন্তরীণ ট্রান্সমিশন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অভাবই মূলত এর কারণ। তবে বিডিরেন হবে হাইস্পিড নেশনওয়াইড একাডেমিক নেটওয়ার্ক। এটি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি একাডেমিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত রাখবে। পাশাপাশি টিইআইএনের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের শিক্ষা ও গবেষণা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে বিডিরেনের আওতাভুক্ত দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংযুক্ত করতে ২০১১ সালে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) কাছ থেকে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার ভাড়া নেয় বিডিরেন। ২০ বছরের জন্য এ কেবল ভাড়া নেয়া হয়েছে। এর বাইরে নিজস্ব ৩২৫ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২৮৩ কিলোমিটার কেবল স্থাপনের কাজ সম্পন্নও হয়েছে। ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে সারা দেশে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিডিরেন পপ সেন্টার।
প্রাথমিকভাবে বিডিরেনের আওতায় ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
গ্লোবাল নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে ইউজিসিতে একটি টিয়ার-৩ ডাটা সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস নেটওয়ার্ক, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম ও ইউনিফায়েড কমিউনিকেশন সিস্টেম তৈরির কাজও চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিডিরেন নেটওয়ার্কটি ডেন্স ওয়েব ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং (ডিডব্লিউডিএম) প্রযুক্তির হওয়ায় এটি বাণিজ্যিক ইন্টারনেট সংযোগের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী হবে। এর মাধ্যমে বিনামূল্যে দেশের এক প্রান্তের প্রতিষ্ঠান অন্য প্রান্তের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। এর সুবিধা পেতে বিডিরেনের সদস্য হতে হবে। আর সদস্য হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসকে অপটিক্যাল ফাইবারের আওতায় আনতে হবে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানও নিজস্ব অর্থায়নে অবকাঠামো তৈরি করছে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন শেষ হবে বলে জানান বিডিরেনের টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, প্রকল্পটির কার্যক্রম আগামী জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যন্ত্রপাতি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আশা করি, ২০১৫ সালের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মত আদান-প্রদানের সুযোগ তৈরি হবে। গবেষণাকর্ম থেকে শুরু করে শিক্ষা কার্যক্রমের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন সম্ভব হবে।
সূত্র: বণিক বার্তা