অনলাইন ডেস্কঃ তারুণ্যের আবেগ সুরে বেঁধে ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘আগে যদি জানতাম’- এর মত জনপ্রিয় সব গান উপহার দিয়ে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী লাকী আখান্দ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বেশ কিছুদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের পর শুক্রবার সন্ধ্যায় সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় এই শিল্পীর মৃত্যু হয় বলে তার মেয়ে মাম্মিন্তি আখান্দ নূর জানান।
একষট্টি বছরের জীবনের তারুণ্যের দিনগুলোতে গিটার হাতে লাকী আখান্দ বাংলাদেশের আধুনিক গানে যোগ করেন নতুন ছন্দ। ভাই হ্যাপী আখান্দের মৃত্যুর পর কী এক অভিমানে প্রায় এক দশক নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি।
গত শতকের একেবারে শেষভাগে নতুন গান নিয়ে শ্রোতাদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন গুণী এই শিল্পী। কিন্তু বছর দেড়েক আগে ধরা পড়ে, তার ফুসফুসে বানা বেঁধেছে কর্কট রোগ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় তার মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। সংগীত শিল্পীদের অনেকেই ভিড় করেন লাকীর আরমানিটোলার বাসায়।
জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ ফেইসবুকে লিখেছেন, লাকী আখান্দের কথা আর সুরের ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল।
আর নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল ফিডব্যাকের গিটারিস্ট লাবু রহমান স্মরণ করেছেন লাকী আখান্দের গান গেয়ে প্রেম করার কথা।
পরিবারের বরাত দিয়ে গীতিকার আসিফ ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, লাকী আখাণ্দের মরদেহ রাতে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রেখে শনিবার সকালে নেওয়া হবে আরমানিটোলার বাসায়। সকাল ১০টায় আরমানিটোলা জামে মসজিদে জানাজা শেষে শিল্পীর কফিন নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই সুর-সৈনিককে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে। বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কফিন সেখানে রাখা হবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে লাকীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। জোহরের পর সেখানে জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
ক্যান্সারের সঙ্গে দেড় বছর
গুরুতর অসুস্থ হয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে লাকী আখান্দের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে।
এরপর থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পর কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তার চিকিৎসায় সহায়তা করা হয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকেও।
সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা আড়াইমাস থাকার পর গত ৭ এপ্রিল আরমানিটোলার বাসায় ফেরেন শিল্পী।
তার মেয়ে মাম্মিন্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাল রাত থেকে অনেক জ্বর ছিল উনার। সকালে কিছু কথা বলেছিলেন। মনে করছিলাম, জ্বর কমে যাবে। কিন্তু আর কমেনি।”
লাকীর বোনের মেয়ে ইসমত জেরিন তানি জানান, শুক্রবার বিকালে তিনি তার মামাকে স্যুপ খাওয়াতে গিয়ে দেখেন পালস নেই, হাত-পা ঠাণ্ডা। এরপর বাড়ির পাশের মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাড়ি ফেরার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগে ভর্তি ছিলেন লাকী আখন্দ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে গিটার হাতে তার গান গাওয়ার ভিডিও এসেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।
সেন্টারের চিকিৎসক রুবাইয়াৎ রহমান জানান, লাকীর ক্যান্সার শেষ দিকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে হাড়গুলোও আক্রান্ত হচ্ছিল।
“উনি আমাকে সবসময় বলতেন, মরে গেলে রাষ্ট্র যেন তাকে মর্যাদা দেয়। মানুষ যেন তার গান ভুলে না যায়। উনার ফাইলটা যেন বন্ধ করে না দেওয়া না হয়।”
শিল্পীর মৃত্যুর খবরে তার বাসায় ছুটে যান সংগীত শিল্পী ফাহমিদা নবী, বোন সামিনা চৌধুরী, মানাম আহমেদ, শেখ শাহেদ ও গীতিকার আসিফ ইকবাল।
মানাম আহমেদ বলেন, “লাকী ভাই সবসময় আক্ষেপ করতেন, তার গানের কপিরাইট নিয়ে । এত বছর হয়ে গেল, তার গানের কোনো কপিরাইট তিনি পাননি। আজ লাকী ভাই চলে গেলেন। আশা করি তার গানের কপিরাইট তার পরিবার পাবে।”
‘বিবাগী এ মন নিয়ে’
লাকী আখান্দের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ জুন। শৈশব পেরোতেই তিনি সুযোগ পেয়ে যান রেকর্ড লেভেল প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে। তারপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছন্দ-লয়ের টানে তিনি ভেসে চললেন সুরদরিয়ায়।
আশির দশকের শুরুতে লাকী আর হ্যাপী আখান্দ জুটির বেশ কিছু গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় লাকী মূলত ছিলেন সুরকার ও গীতিকার। আর সেই গানের শিল্পী ছিলেন হ্যাপী। সে সময়ের একটি টিভি নাটকে ‘এই নীল মনিহার’ গানটি দারুণ সাড়া ফেলে।
১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে বাজারে আসে লাকীর প্রথম একক অ্যালবাম। ‘এই নীল মণিহার’ ছাড়াও ওই অ্যালবামের ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি জানি না’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’ গানগুলো শ্রোতাদের মাঝে সাড়া ফেলে।
১৯৮৭ সালে হ্যাপীর মৃত্যুর পরপর সঙ্গীতাঙ্গন থেকে অনেকটাই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান এই গুণী শিল্পী। দীর্ঘ নীরবতার পর ১৯৯৮-এ ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ নামে তার দুটি অ্যালবাম আসে।কুমার বিশ্বজিৎ এর কণ্ঠে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, আইয়ুব বাচ্চুর ‘কী করে বললে তুমি’, হাসানের ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’- এর মতো অনেক জনপ্রিয় গানে সুর দিয়েছেন লাকী।
ব্যান্ডতারকা জেমসের গাওয়া ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া’ গানটির সুরযোজনার পাশাপাশি সঙ্গীতপরিচালনাও লাকীর করা।
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায়রে’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘পাহাড়ি ঝর্ণা, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’সহ বহু গানের সঙ্গে মিশে আছে লাকী আখান্দের নাম।
অভিমানী এই শিল্পী সেই আশির দশকেই গেয়ে গেছেন, “আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না/ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না।” ( সূত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)