ফজলুল বারী :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মামা শশুর শেখ আশরাফুল হক বলেন ১৫ আগষ্ট তিনি বাড়িতে ছিলেন। ভোরে বৈকুন্ঠের কাছে দুঃসংবাদটি পান। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। এটা কী করে সম্ভব! যার নামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাকে হত্যা করা হয়েছে!
সারাদিন থমথমে একটা পরিবেশ ছিল গ্রামে। কারও কাছে নিশ্চিত কোন খবর নেই। সকাল ন’টার দিকে পুলিশ আসে বাড়িতে। পুলিশ দেখে অনেকে বাড়ি থেকে চলে যায়। আপনি যাননি? শেখ আশরাফুল হক জবাব দেন, না।
পুলিশ এসে কয়েকটি কবর খুঁড়ে রাখতে বলে। পরে এসে বলে কয়েকটা না, কবর লাগবে একটা। ১৬ আগষ্ট বেলা পৌনে দু’টোর দিকে একটি হেলিকপ্টার টুঙ্গিপাড়ার আকাশে চক্কর দেয়। দু’টোর দিকে স্থানীয় হেলিপ্যাডে এসে নামে হেলিকপ্টার।
টুঙ্গিপাড়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার আবুল কাশেম, আব্দুল হাই মেম্বার, আকবর কাজী, মোঃ ইলিয়াস হোসেন, জহুর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টার প্রমুখ বাড়িতে লাশ বহন করে আনেন।
হেলিকপ্টারে লাশের সঙ্গে আসা সেনা সদস্যদের ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল তারা সংখ্যায় কম। গ্রামবাসী আবার তাদের ওপর চড়াও হামলা করে কিনা। মোটকথা গ্রামবাসী ভয় পাচ্ছিল সেনাদের। আর সেনারা ভয় পাচ্ছিল গ্রামবাসীদের।
এরজন্য তাড়াতাড়ি দাফনের জন্যে তারা চাপ দিচ্ছিল। কফিন না খুলে কফিন সহ দাফনের নির্দেশ তারা দেয় তাদের একজন। কিন্তু একজন কাজী সিরাজুল ইসলামের দৃঢ়তায় সেটা সম্ভব হয়নি। ইনি পুলিশের কনস্টেবল পদে তখন চাকরি করতেন।
সেনা অফিসারের মুখের ওপর তিনি বলেন, মুসলমানের লাশ গোসল করে দাফন করাতে হয়। গোসল ছাড়া মুর্দার দাফন হয়না। আর ইনিতো কোন সাধারন মুসলমান নন। কাজী সিরাজুল ইসলাম বলেন লাশের গোসল তিনিই দেবেন।
এরপর তাঁর সঙ্গী হন দাফনের জন্যে আনা মৌলভী আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, লাশ না দেখে তিনি দাফন করবেননা। শরীয়তে নিষেধ আছে। লাশ দেখে পুরুষ না মহিলা নিশ্চিত হয়ে দাফন করার নিয়ম। অতঃপর আইয়ুব মিস্ত্রিকে দিয়ে খোলা হয় কফিন।
বাজারে একজনকে একটি সাবান আনতে পাঠানো হয়। যে সাবান আনতে গিয়েছিল সে ৫৭০ সাবান ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায়নি। তিব্বত কোম্পানির লাল রঙের সাবানটি তখন কাপড় কাচার সাবান হিসাবে প্রচলিত জনপ্রিয় ছিল।
শেখ আশরাফুল হক বলেন, তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলোনা তিনি মারা গেছেন। যেন মনে হচ্ছিল কফিনের ভিতরে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি গেঞ্জি আর সাদা চাক লুঙ্গি। গোসলের সময় দেখা গেল বুকে তাঁর চব্বিশটি গুলির দাগ।
গুলি গুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে গেছে। ডান হাতের তালুতে ছিল একটা গুলির চিহ্ন। বাম পায়ের গোড়ায় একটি গুলি, দুই রানে দুটি করে গুলি। তখনও শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। পাঞ্জাবির পকেটে পাওয়া যায় তাঁর চশমা আর প্রিয় পাইপ।
টুঙ্গিপাড়া শেখ সায়েরা খাতুল রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রাখা ত্রানের মালখানা থেকে আনা হয় ত্রানের শাড়ি। সেগুলোর লাল কালো পাড় ছিঁড়ে ফেলে বানানো হয় কাফনের কাপড়। সেই কাপড়ে জড়িয়ে দাফন হয় আমাদের প্রানের বঙ্গবন্ধুর।
জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। পুলিশি বাধার মুখেও টুঙ্গিপাড়া, পাঁচ কাহনিয়া, পাটগাতি গ্রামের ৩০/৩৫ জন জানাজা-দাফনে অংশ নেন। বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক মানুষ আটকে থাকেন বহু মানুষ।
বাংলাদেশের জাতির পিতার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সুযোগ দেয়নি খুনির দল। জাতীয় বা দলীয় পতাকার শেষ স্পর্শ পায়নি তাঁর কফিন। উল্টো শয়তানের দল দীর্ঘদিন ব্যাঙ্গ করে বলেছে ৫৭০ সাবানে গোসল হয়েছে বঙ্গবন্ধুর লাশের!
ত্রানের কাপড়ে তাঁর কাফন হয়েছে! সেই শয়তানের দোসররাই আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা আশ্রয় নিয়েছে টকশোতে। সেদিন মরদেহের সঙ্গে আসা খুনির দল দাফন শেষে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে তাঁকে তিন দফা সালাম জানিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।
দাফনের পরও অনেকদিন সেই কবরের পাশে পুলিশ পাহারা থাকতো। তারা গ্রামবাসীকে কবরের পাশে যেতে দিতোনা। মৃত বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও তাদের অনেক ভয় ছিল। গ্রামবাসী দূর থেকে জিয়ারত দোয়া করে চলে যেতেন।
গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্যে গোপনে কোরান খানি, মিলাদ-দোয়া হয়েছে। এখন অবশ্য ১৫ আগষ্ট এলে এসব কোরান খানি, গণভোজ নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এসবে এখন প্রানের ছোঁয়া কম।
১৯৭২ সাল থেকে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বাড়ির ম্যানেজার-কেয়ারটেকার ছিলেন বৈকুন্ঠ নাথ বিশ্বাস। শেখ মোহাম্মদ মুসার মাধ্যমে পরিচয় জানার পর পর বৈকুন্ঠ আমাকে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর মূলবাড়িতে। নীচতলার দরজার তালা খুলে সোফায় বসতে দেন।
বাড়ির এ অংশে আসবাবপত্র গাদাগাদি করে রাখা। আমার জন্যে দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন বৈকুন্ঠ দা। খাবার মানে ভাত-ডাল-ডিমভাজা। বললেন আমার এটুকই সামর্থ্য। মুগ্ধ হতে হয় তাঁর আন্তরিকতায় ।
ঘরের ছোট আলমিরায় বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র। শেখ হাসিনা বাড়ি গেলে দলের লোকজনের উপস্থিতিতে বাড়ির একটি রমরমা চেহারা থাকে। এরপর আবার সবকিছু চুপচাপ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে টুঙ্গিপাড়া একটি ইউনিয়ন ছিল। স্বাধীনতার পর গ্রামে হাসপাতাল, ডাকবাংলো হয়। ওয়ারলেস আসে। থানা প্রতিষ্ঠার পর ডাকবাংলোয় হয় পুলিশ স্টেশন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর টুঙ্গিপাড়া আবার হয় বিরান জনপদ।
তাঁর যে দোষ একটাই। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। বৈকুন্ঠ বলেন পচাত্তরের ওই সময় বঙ্গবন্ধুর মা-বাবা’র কবর বাঁধাইর কাজ চলছিল। অন্যদিনের মতো ভোর থেকে কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রাজমিস্ত্রি আর তার সহকারীরা।
ওই সময় এমন একটি মর্মন্তুদ খবর আসলে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির বাড়িতে এসে অর্ডার করে থানার পুলিশ! অর্ডার করে কবর খুঁড়ে রাখতে বলে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বৈকুন্ঠ প্রতিবেশীদের পরামর্শ চান।
খবর খোঁড়ার কাজ করেন রাজমিস্ত্রির লোকজনই । যারা বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা’র কবর বাঁধাইর কাজ করছিলেন, তারা খোঁড়েন বঙ্গবন্ধুর কবর! ১৬ আগষ্ট হেলিকপ্টারে লাশ পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীদের পরামর্শে বাড়ি থেকে চলে যান বৈকুন্ঠ।
দু’দিন পরে বাড়ি ফিরেছেন। আমাকে নিয়ে গ্রামে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলেন বৈকুন্ঠ। বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার জন্মগ্রাম ঘুরতে খুব ভালো লাগছিল। সত্যি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় অপরূপ সেই গ্রাম।
-বঙ্গবন্ধুর কোন বিষয়টি আপনার বেশি ভালো লাগতো?
-বৈকুন্ঠঃ সবকিছু। বিশেষ করে তাঁর হৃদয়টা ছিল বিশাল।
-তাঁর কোন স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
-বৈকুন্ঠঃ অনেক স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা বলবো। একটা ঘটনা বলি। একদিন তাঁর হেলিকপ্টার বাড়ির ওপর চক্কর দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাবা তখনও বেঁচে ছিলেন। হঠাৎ দেখি বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারের দরজা খুলে আমার নাম ধরে ডাকছেন।
এক বাড়ির ছাদে নামে সেই হেলিকপ্টার। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে নেমে তাঁর বাবাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর সঙ্গী ফটোগ্রাফারের তোলা ছবিটি তাঁর অন্যতম বিখ্যাত ছবি। সেই ফটোগ্রাফারের নাম সম্ভবত মোহাম্মদ আলম।
আবার পনের আগষ্ট প্রসঙ্গে আসে। বৈকুন্ঠ বলেন প্রতিবেশীদের পরামর্শে বাড়ি থেকে চলে গেলেও দু’দিন পর তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। খুব ইচ্ছা করতো বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে যেতে। কবরের মাটি ছুঁয়ে একটু কাঁদতে ইচ্ছে করতো।
কিন্তু পুলিশ পাহারার কারনে সেখানে যাবার সুযোগ ছিলোনা। কবর জিয়ারতে এসে একবার গ্রেফতার হন যশোরের এক আওয়ামী লীগ নেতা। বৈকুন্ঠ তাঁর নাম মনে করতে পারেননি। ওই খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের ভয় বেড়ে যায়।
আর কেউ আর জাতির পিতার কবরের কাছে যাবার চেষ্টা করেননি। জিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় জেনারেল ওসমানী যখন গোপালগঞ্জের জনসভায় আসেন তখনই প্রথম সুযোগ পান কবর ধরে কাঁদবার। এরপর আর কোন সমস্যা হয়নি। ডিগ্রী পাশ বৈকুন্ঠের তখন নির্ধারিত কোন বেতনভাতা ছিলোনা। বেতন ভাতা দিয়ে আসলে মূল্যায়নও সম্ভব ছিলোনা তাঁর মতো বিশ্বস্ত একজনের। আজ গোপালগঞ্জে ফোন করে বৈকুন্ঠ দা’র খোঁজ নিতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে।
মাস দুয়েক আগে মারা গেছেন ১৯৮৬ সালে আমার টুঙ্গিপাড়ার হোষ্ট। ভালো থাকবেন দাদা। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় থাকায় এর এখন অগনিত মানুষজন। সারাক্ষন এ বাগান সে বাগান ঘুরে বেড়ায়, মধু খায় আর অন্যদের শাসায়!
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে এরাই আবার দৌড়ে ফার্স্ট হয়। কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যার পর সেই শ্বাপদসংকুল দিনগুলোয় এই বৈকুন্ঠ দা’র মতো লোকগুলোই বরাবর আওয়ামী লীগের বাতি জ্বালিয়ে রাখার সলতে। এরাই আওয়ামী লীগের তৃণমূল শক্তি। ওপারে ভালো থাকবেন দাদা।