গত তিন-চারদিন ধরে বাংলাদেশের অনলাইন সমাজে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গেছে। রাতারাতি হঠাৎ আমরা টের পেলাম, অনলাইনে ফেইসবুকনিবাসী হাজার হাজার মিলিটারী স্ট্রাটেজিস্ট, প্যারা কমান্ডো, জেমস বন্ড, মাসুদ রানা, মেজর, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার, জেনারেলে উপচে পড়ছে। এই এসপিওনাজ এজেন্টরা ১০ তলার এসিরুমে বসে পায়ের উপর পা তুলে ফেইসবুকে একটু পর পর হাঁক দেন, শালার কয়েকটা চুনোপুটি জঙ্গীরে তিন দিনেও মারতে পারে না আর্মি! নিশ্চয়ই এইটা ইন্ডিয়ান আর্মি। নাটক নাটক, সব নাটক! অন্যদিকে কমান্ডোজ, কল অফ ডিউটি অথবা কমান্ড অ্যান্ড কনকার টাইপের গেম খেলে খেলে নিজে নিজে ফিল্ডমার্শাল খেতাবপ্রাপ্ত গেমিং জেনারেশন বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘একটা লেভেল পার হইতে হালারা এতোক্ষন লাগায়, কয়েকটা জঙ্গীরেই মারতে পারে না, এই অপদার্থ আর্মি পোষার দরকারটা কি?’
সমস্যাটা হচ্ছে কি, সিলেটের শিববাড়িতে আতিয়া মহল নামের যে ভবনটিতে জঙ্গীরা আস্তানা গেড়েছিল, তার আশেপাশে ভিডিও গেমসের মত ফাঁকা জায়গা ছিল না। খুবই প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা পূর্বপরিকল্পনা মতো ঘনবসতিপূর্ন এমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছিল যে তাদের সাথে প্রথাগত যুদ্ধ করতে গেলে অনেক প্রাণহানীর আশংকা ছিল। তাই সোয়াটের কাছ থেকে অভিযানের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের মিলিটারি প্যারা কমান্ডোদের প্রথম দায়িত্ব ছিল আতিয়া মহলের বাসিন্দা ২৮টা পরিবারের ৭৬ জন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে উদ্ধার করে আনা। আমাদের কমান্ডোরা সেটা করেছে, প্রায় ৩০ ঘন্টা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আটকে থাকার পর তাদের উদ্ধার করেছে, একজন মানুষেরও কোন ক্ষতি হয়নি। বাড়ির সামনে এবং বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিরা আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বসিয়েছিল বলে সামনে দিয়ে ঢোকা নিরাপদ ছিল না। কমান্ডোরা কৌশলে মই ব্যবহার করে পাশের ভবন থেকে গিয়ে গ্রিল কেটে লোকজনকে বের করে আনে। একটানা গোলাগুলির মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করে কমান্ডোরা। পৃথিবীর ইতিহাসে জঙ্গীদের কবল থেকে এতো পরিমাণে মানুষকে জীবিত অক্ষত উদ্ধার করার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম।
মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা জানানো তো দূরে থাক, আমাদের ফেসবুকনিবাসী মাসুদ রানারা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন, একটা বাড়ীর মধ্যে দুই-তিনটা জঙ্গি মারতে এতোক্ষন লাগে? ওদিকে জঙ্গীরা কিন্তু বসে নেই। কোন জিম্মি রাখতে না পেরে জঙ্গীরা তখন পুরো বাড়ীর প্রতিটি তলার প্রবেশমুখে এবং বিভিন্ন পয়েন্টে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস লাগিয়ে রেখেছে, সরাসরি অভিযানে যেগুলো বিস্ফোরিত হলে স্রেফ ওই ভবনটিই ধসে পড়তো না, আশেপাশের ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হতো, প্রাণহানী ঘটতো প্রচুর। এই বিস্ফোরকগুলো যে কত ভয়াবহ ছিল, তার ছোট্ট একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসানের ব্রিফিংয়ে,
“প্রথম দিনের ঘটনা। বাড়িটির কলাপসিবল গেটের সামনে একটি বড় বালতির মধ্যে বিস্ফোরক ছিল। ওটা যখন ডেটোনেট করেছে, তখন পুরো কলাপসিবল গেটটা উড়ে এসে পাশের বিল্ডিংয়ে পড়েছে। ওখানে আমাদের তিন চারজন সদস্য ছিলেন, তারা ছিটকে গেছেন। পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠেছে। এরকম এক্সপ্লোসিভ ভেতরে আরও থাকতে পারে।”
সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল জঙ্গীদের ঘিরে রাখা পুলিশ-র্যাব এবং সেনা কমান্ডোদের বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে গ্রেনেড হামলা। আহত হন দুজন সেনা সদস্য। ক্রমাগত গুলি আর গ্রেনেড বিস্ফোরণের মধ্যেই সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ভবনের কাছাকাছি পুলিশের চেকপোস্টে সেনা র্কমর্তাদের ব্রিফিং শেষে ভিড়ের ভেতর জঙ্গীদের গ্রেনেড বিস্ফোরণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা, ছাত্রলীগ নেতা এবং সাধারণ মানুষসহ নিহত হন ছয়জন। পুলিশ-সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। তারপর রাত ৮টায় ভবনের বাইরে দু’টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে আহত হয়েছেন পাঁচজন পুলিশ ও র্যাবসদস্য। অর্থাৎ ভেতরের জঙ্গীদের কাভার দিতে বাইরে ঘিরে থাকা পুলিশ-র্যাব-কমান্ডোদের উপর অতর্কিতে বিভিন্ন দিক থেকে হামলা চালিয়ে গেছে ওরা। এতো এতো প্রতিকূলতার সত্ত্বেও আমাদের অনলাইন কমান্ডোরা বিরক্ত হন কেন আর্মি অভিযান শেষ করতে এত সময় লাগাচ্ছে এই ভেবে। অথচ জঙ্গীরা এতোই প্রশিক্ষিত ছিল যে তাদের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ে দেবার পর তারা সেগুলো ধরে উল্টা আবার সেনাদের দিকে নিক্ষেপ করেছে, প্রায় পুরো সময়টা জুড়েই একটানা গুলি চালিয়ে গেছে, একের পর এক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আইইডি এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গেছে। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও আমাদের কমান্ডোরা হাল ছাড়েনি, শেষ পর্যন্ত আজ সোমবার দেয়াল ভেঙ্গে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে মোট চারজন জঙ্গীর লাশ পেয়েছে কমান্ডোরা। এর মধ্যে দুজনের লাশ হস্তান্তর করা হলেও বাকি দুজনের শরীরে এমনভাবে এক্সপ্লোসিভ ভেস্ট লাগানো রয়েছে যে, সেগুলো বিস্ফোরিত হলে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আর পুরো ভবনে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক মজুদ থাকায় অভিযান চলছে এখনো।
পাঁচতলা আতিয়া মহলের আনাচেকানাচে যে ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস-আইইডি লাগানো ছিল, সেগুলো বানাতে সাধারণত সালফার,পটাশিয়াম, গান পাউডার, ব্ল্যাক পাউডার ইত্যাদি রাসায়নিক ছাড়াও কাঁচের গুঁড়া, বাইসাইকেলের বিয়ারিং বল, মার্বেল, জি আই পাইপ, মোটা কাঁচের বোতল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। রিমোট কন্ট্রোল বা মোবাইল ফোনের তরঙ্গ ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারা এই আইইডি সচরাচর ব্যবহৃত হয় রাস্তার পাশে, ভেহিক্যাল অ্যাম্বুশের জন্য, একবার বিস্ফোরিত হলে গাড়িই যেখানে নরমালি পাউডার হয়ে যায়, সেখানে মানুষের হাড্ডিমাংসের কিমা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এমন অসংখ্য আইইডি খুব সাবধানে ডিস্পোজাল করে এগোতে হয়েছে আর্মি কমান্ডোদের, এক চুল এদিক-ওদিক হলে, স্রেফ একটা আইইডি বিস্ফোরিত হলে নরক নেমে আসতো, বিস্ফোরিত হত বাকি সবগুলো, আশেপাশের সবার দেহের অবশেষটুকুনও খুঁজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। ওহো, আপনারা তো আবার স্রেফ জঙ্গীরা মরলে সন্তুষ্ট হন না, আপনাদের কাছে মনে হয় নাটক, আর্মি কমান্ডো দু-দশজন মরলেই ভালো হত, কি বলেন?
সিলেটের ঘটনাকে আমাদের অনলাইন জেমস বন্ডরা নাটক নাটক বলে উড়িয়ে দেওয়ার সময়েই আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে একটা ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় যে প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যেই রাব্বী নামে এক কমান্ডো হঠাৎ একেবারে বাড়ীর সামনে ডেনজারজোনে চলে গেছেন গুলি করতে করতে, আর পেছন থেকে তার কমান্ডার তাকে চিৎকার করে ডাকছেন,‘রাব্বী, রাব্বী, গেট ব্যাক, গেট ব্যাক’। এসিরূমে বসে যখন আমাদের কল অফ ডিউটি খেলে এক্সপার্ট ফিল্ড-মার্শালরা ট্রেইন্ড জঙ্গীদের সাথে ভয়ংকর যুদ্ধকে নাটক বলে উড়িয়ে দেন, ঠিক সে মুহুর্তে রাব্বীর মতো অসমসাহসী বাঘেরা প্রাণ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন জঙ্গীদের টুঁটি ছিড়ে ফেলবেন বলে, রাব্বীর মত বোকা ছেলেরা বুঝতেই পারেন না যে এটা আসলে নাটকের শ্যুটিং, বুঝতে পারেন না যে আমাদের বিবেকের মাপকাঠিতে তারা আসলে সামান্য অভিনেতা। তাদের কাছে চিট কোড নাই, ঘরের ভেতর নিরাপদে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কল অফ ডিউটির সবগুলো লেভেল পার করে ফেলার কপাল তাদের নাই। বরং সরাসরি বাস্তবের মুহুর্মুহু গুলির মাঝে রাব্বীরা লড়ে যান, যেন আমরা নিরাপদে বসে তাদেরকে নাটক বলে উড়িয়ে দিতে পারি। একাত্তরেও পাকিস্তানী সেনাদের সাথে আমাদের এমন নাটক হয়েছিল, সেখানেও রাব্বীর মত বাঙ্গালী আর্মির বোকা ছেলেরা জানের পরোয়া না করে চলে যেত একেবারে সামনে, গুলি চালিয়ে যেত শেষ নিঃশ্বাস অবধি। যুগে যুগে এই রাব্বীদের নিয়েই যত সমস্যা, বুঝলেন? এই বোকা ছেলেগুলো কখনোই নাটক আর জীবনের মূল্য বোঝে না। কখনোই না..
()