আওয়ামী লীগের প্রথম বড় নির্বাচনী চমক! নৌকার মাঝি হচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা

আওয়ামী লীগের প্রথম বড় নির্বাচনী চমক! নৌকার মাঝি হচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা

নির্বাচন করবেন নড়াইল থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট হৃদয়ের রাজনৈতিক ইনিংস শুরু হচ্ছে শেখ হাসিনার অধিনায়কত্বে

ফজলুল বারী: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রথম বড় চমক কোনটি? আমরা বলে দেই? তাহলে শুনুন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার, বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন, এই সময়ের সবচেয়ে বড় ছবি-পোস্টার মাশরাফি বিন মুর্তজা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন এবং নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন নড়াইল সদর আসন থেকে।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলেছে মাশরাফির পুরো বিষয়টি হ্যান্ডেল করছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মাশরাফিকে আস্বস্ত করে বলেছেন রাজনীতিতে যোগ দিলেও তার খেলায় কোন সমস্যা হবেনা। মাশরাফি যতদিন চাইবেন খেলে যাবেন। মাশরাফির মনোনয়নপত্রটি সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যোগদান অনুষ্ঠানটি হবে গণভবনে। এবং তা সম্ভবত আগামী সোমবার, ১২ নভেম্বর। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। এর আগেও হতে পারে। বাংলাদেশ ও বিশ্ব ক্রিকেটের দুই সুপার স্টার মাশরাফি-সাকিবের নির্বাচন করার কথা বেশ আগে বলেছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী ও সাবেক বিসিবি-আইসিসি বস মোস্তফা কামাল।

তবে সূত্রগুলো বলছে এবার শুধু মাশরাফি নির্বাচন করবেন। বাংলাদেশ দলের সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরের সময় এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মাশরাফি আমাদের বলেছিলেন তিনি নড়াইলের বাড়ি গেলে নানা বয়সী লোকজন ছুটে এসে তাকে নির্বাচন করতে বলে। তবে তিনি এমপি হন এই আগ্রহটি নড়াইলের মুরব্বি সম্প্রদায়ের বেশি। এই মুরব্বিরা আওয়ামী লীগ-বিএনপি সব দলের। নড়াইলের একটি সূত্র যোগাযোগের পর আমাদের বলেছে মাশরাফি প্রার্থী হলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়াটা বিএনপির জন্যেও বিব্রতকর হবে। কারন মাশরাফি সেখানে সবার। সবদলের কাছেই প্রিয়। আর বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানকে সবার ওপরে তুলে ধরা মাশরাফির রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিকল্পতো নেই।

মাশরাফির স্মরণীয় একটি উক্তি হচ্ছে ,”ক্রিকেটার বা অন্য কেউ নয়, বাংলাদেশের হিরো হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে আমাদের সবাইকে এই বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন।”

মাশরাফির স্মরণীয় একটি উক্তি হচ্ছে ,”ক্রিকেটার বা অন্য কেউ নয়, বাংলাদেশের হিরো হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে আমাদের সবাইকে এই বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন।” একনজরে মাশরাফিঃ নামঃ মাশরাফি বিন মুর্তজা (কৌশিক)। পিতাঃ গোলাম মুর্তজা। মাঃ হামিদা মুর্তজা। স্ত্রীঃ সুমনা হক সুমী। দুই সন্তানঃ ছেলে সাহেল মুর্তজা, মেয়ে হুমায়রা মুর্তজা।ভাই (ছোট) মোরসালিন বিন মুর্তজা। জন্মঃ অক্টোবর ৫, ১৯৮৩ নড়াইল জেলা। নড়াইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করে ভর্তি হন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে। এখান থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাশরাফি মুর্তজা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অন্যতম বোলিং স্তম্ভ। এখন পালন করছেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব। তাঁর বোলিংয়ের ধরন ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। শেষদিকে করেন কার্যকরী ব্যাটিংও। বাংলাদেশ জাতীয় দল ছাড়াও তিনি এশিয়া একাদশের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। যেভাবে আজকের মাশরাফিঃ ছোটবেলা থেকেই তিনি বাঁধাধরা পড়াশোনার বদলে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর বেশ ভালো লাগতো চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটতে। তারুণ্যের শুরুতে ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। ব্যাটিংটাই বেশি করতেন তখন। যদিও এখন বোলার হিসেবেই তিনি বেশি খ্যাত। যেজন্যে তাকে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামেও অভিহিত করা হয়। মাশরাফির বাবা গোলাম মুর্তজা আমাদের বলেছেন ছোটবেলা হাতের কাছে কিছু না পেলে একটা স্যান্ডেলকে ব্যাট বানিয়েও খেলতে লেগে যেতেন তাঁর কৌশিক।

গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় বাংলাদেশ দলের খেলা দেখতে দেশ দুটি ভ্রমন করেন এই গর্বিত পিতা। দেশে তিনি মাশরাফির গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। আর করেন মেহমানদারি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাশরাফি ভক্তরা নড়াইলে তাদের প্রিয় ম্যাশের বাড়ি দেখতে যায়। তাদের কেউ সে বাড়ি থেকে না খেয়ে আসতে পারেননা। বছরের পর বছর এই নিরবিচ্ছিন্ন মেহমানদারি করে যাচ্ছেন মাশরাফির বাবা-মা। বাইক প্রিয় মর্তুজা তথা কৌশিককে সবাই খুব হাসিখুশি আর উদারচেতা মানুষ হিসেবেই জানে। নিজের শহরে তিনি প্রচণ্ড রকমের জনপ্রিয়। এখানে তাকে বলা হয় ‘প্রিন্স অব হার্টস’।

নড়াইলে সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় সুমনা হক সুমির সাথে তার পরিচয় হয় মাশরাফির। দু’জনে ২০০৬ সালে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তারা এখন দুই সন্তানের বাবা-মা। বাংলাদেশের সফলতম পেস বোলারদের একজন মাশরাফি। আক্রমণাত্মক আর গতিময় বোলিং দিয়ে অনূর্ধ-১৯ দলে থাকতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের নজর কেড়েছিলেন। রবার্টস তখন অনূর্ধ-১৯ দলের অস্থায়ী বোলিং কোচের দায়িত্বে। মূলত তখন এই রবার্টসের পরামর্শেই মাশরাফিকে নেয়া হয় বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। বলা যায় খাঁটি জহুরি এই রবার্টস। এমন জহর কি করে তার নজর এড়ায়! সে কারনে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে একটি মাত্র ম্যাচ খেলেই মাশরাফি জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান।

৮ নভেম্বর, ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি অমীমাংসিত থেকে যায়। ১০৬ রানে ৪টি উইকেট নিয়ে মাশরাফি অবশ্য অভিষেকেই তাঁর জাত চিনিয়ে দেন । তার প্রথম শিকার ছিলেন গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার । এটি মাশরাফির প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও ছিল । ক্রিকেটে তিনি এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ৩১তম খেলোয়াড় এবং ১৮৯৯ সালের পর তৃতীয় জন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অভিষেক হয় ২০০১ সালে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে। ২০০৬ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিরুদ্ধে মাশরাফি ২৬ রানে ৬ উইকেট নেন, যা তার সেরা সাফল্য এখন পর্যন্ত। ২০০৯ সালের শুরুতে মাশরাফিকে মোহাম্মদ আশরাফুলের সহকারী অধিনায়ক করা হয় । পরবর্তীতে ওই বছরেরই জুন মাসে তিনি মোহাম্মদ আশরাফুলের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পান সাকিব আল হাসান। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে নিজের প্রথম ম্যাচেই তিনি হাঁটুতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন। ঐ খেলায় বাংলাদেশ জয় পায়। কিন্তু এই চোটের কারনে মাশরাফি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠের বাইরে ছিলেন। সাকিব আল হাসান ওই টেস্ট ম্যাচসহ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করেন । পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের সাথে হোম সিরিজে তিনি পুনরায় অধিনায়কত্ব পান। যদিও সেটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য। ২০১৫সালের বিশ্বকাপেও তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যার হাত ধরে কোন বিশ্ব আসরে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। এরপর ওয়ানডের পাশাপাশি অধিনায়ক করা হয় টি-টোয়েন্টি দলেরও।

গত বছর ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নেন মাশরাফি। এখন শুধু তিনি ওয়ানডে অধিনায়ক হলেও আদতে দেশের মানুষের ক্রিকেটমননের অধিনায়ক। এত ইনজুরি নিয়ে সম্ভবত পৃথিবীর আর কোন ক্রিকেটার ক্রিকেট খেলেননা। বাংলাদেশ ক্রিকেটদলের হৃদয়ের নাম মাশরাফি। এই দলটিতে তিনি সিনিয়র-জুনিয়র সব ক্রিকেটারদের ভাই-বন্ধু-বাবা-অভিভাবক সবকিছু। বাংলাদেশের বারোটির বেশি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড এম্বেসেডর এখন মাশরাফি বিন মুর্তজা। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর চুক্তিপত্রের শর্তও উল্লেখ করার মতো। প্রতিটি চুক্তিতে উল্লেখ করা আছে প্রতিবছর মাশরাফির সুপারিশকৃত দশজনকে চাকরি দিতে হবে। চিকিৎসার জন্যে দুই লক্ষ করে টাকা দিতে হবে মাশরাফির সুপারিশকৃত দশজনকে। এসব আমাদের মানবিক মাশরাফির আংশিক চিত্র।

এখন শুরু হচ্ছে মাশরাফির রাজনৈতিক ইনিংস শেখ হাসিনার অধিনায়কত্বে।

ফজলুল বারী