ফজলুল বারী:নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিল পর্বের পর আমার সাফ সাফ কথা ড কামাল হোসেন এরমাঝে বাংলাদেশের চলতি রাজনীতির একটি প্রতারক জোটের নেতা হিসাবে চিহ্নিত। কেনো এভাবে কথাটি বলছি তা এ লেখায় স্পষ্ট করবো। শুরুতেই মোটা দাগে দেখে নেই এই জোটটি করার সময় ড কামালরা কি কি বচন দিয়েছিলেন? শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অবিস্মরনীয় কাজটি করেছে। নানা সূচকে এবং বাস্তবে অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে দেশবিদেশে কেউ কোন দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। কিন্তু কামাল হোসেনরা দুর্নীতির দন্ড নিয়ে জেলে থাকা খালেদা জিয়া, বিদেশে পলাতক তারেক রহমানের দল বিএনপির পক্ষ নিয়ে রা’ তুললেন যেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্যে দেশ গেলো, গেলো! কাজেই দেশে জনগনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে।
এই সময়ে ভালো ভালো আরও কিছু বচনও দেয়া হলো! যেমন, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগনকে করতে হবে ক্ষমতার মালিক। এরজন্যে বিএনপির কাছ থেকে নিতে হবে দেড়শ আসন! রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যের সৃষ্টি করতে হবে। যাতে করে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে কোন এক তরফা স্বৈরাচারী ভূমিকা নিতে না পারে। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হলো, নতুন জোটের সঙ্গে কোন স্বাধীনতা বিরোধী বা জঙ্গির সম্পর্ক থাকবেনা। দুর্নীতির মামলার বিচারে দন্ডিত খালেদা জিয়াকে কৌশলে বলা হলো রাজবন্দী! দুর্নীতি এবং হত্যা মামলায় দন্ডিত এবং বিদেশে পলাতক ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব-পাসপোর্ট ত্যাগকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে বলা হয়, তার সঙ্গে নয়া জোটের কোন সম্পর্ক থাকবেনা। ‘কোথাকার কোন তারেক লন্ডনে বসে কী করছে না করছে!’ শুরুতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দেশে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবেনা, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে, এমন কথাও বলা হয়েছিল। সব হুঙ্কার এখন নিখোঁজ।
দেশের মানুষজনকে আশা জাগানিয়া এসব কথাবার্তা যারা বলেছিলেন অথবা বচন দিয়েছিলেন তারা কারা কারা? ড কামাল হোসেন দেশের প্রতিথযশা আইনজীবী, বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়ন কমিটির প্রধান। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে নিতে না পেরে তার রাজনৈতিক উৎস দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন পৃথক রাজনৈতিক দল গণফোরাম। কিন্তু তিন দশকেও তার এই দলের কোন গণভিত্তি তৈরি হয়নি। কোন গনতন্ত্রও নেই। প্রতিষ্ঠার দিন থেকে ড কামালই এ দলের সভাপতি।
১৯৭১ সালের ২ রা মার্চ ডাকসু ভিপি হিসাবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন আ স ম আব্দুর রব। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল জাসদ। পচাত্তরে এই জাসদ ছত্রখান হতে শুরু করে। এরশাদ আমলে যখন সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন চলছিল তখন অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচারের পক্ষ নেন রব। ১৯৮৮ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলে রব হন বিনা ভোটের সেই সংসদের গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা। এরশাদের পতনের পর তাই তিনিও পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার দলে এখন সারাদেশে হাজার খানেক নেতাকর্মী-সমর্থকও নেই।
মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাবেক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না স্বাধীনতার পর আ স ম আব্দুর রবের অনুসারী হয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে ডাকসু ভিপি পরিচয়ে নন্দিত ছাত্রনেতা হন। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় এসে জিয়া এই রব-মান্না দু’জনকেই জেলে পোরেন। জেল থেকে বেরিয়ে মান্না তার নেতা রবের সঙ্গে জাসদে থাকতে পেরে যোগ দেন বাসদে। বাসদ আবার দু’ভাগ হলে তিনি যোগ দেন আ ফ ম মাহবুবুল হকের বাসদে। এরপর বাসদ থেকে বেরিয়ে আবার চুয়াডাঙ্গার জাসদ নেতা মির্জা সুলতান মুক্তিকে নিয়ে গঠন করেন জনতা মুক্তি পার্টি। কিন্তু সব বিপ্লব-মুক্তি অতঃপর বাদ। নতুন রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে মান্না যোগ দেন আওয়ামী লীগে। কিন্তু মান্নারতো ছোট দলের বড় নেতা হয়ে থাকার অভ্যাস। আওয়ামী লীগের এতো নেতার ভিড়ে দলটি সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেলেও এখানে তার ভালো লাগলোনা।
১/১১’র সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর মান্নার আবার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাধ জাগে। তার বাসদ ছাত্রলীগের জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক এক নেতার টকশোতে বসে শেখ হাসিনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেন মান্না। তিনিই উড়ে গেলেন। আওয়ামী লীগে আর সুবিধা হবেনা ভবে গঠন করেন আলাদা রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্য। শুরুতে এ দলের সঙ্গে ছিলেন ড কামালের জানি দুশমন ব্যারিষ্টার রফিকুল হক। এ কারনে তাকে নিয়ে ঐক্য করতে শুরুতে সাতবার ভেবেছেন ড কামাল হোসেন। মান্নাকে অনেক কষ্টে ড কামালকে বোঝাতে হয়েছে ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের সঙ্গে তার আর কোন যোগাযোগ সম্পর্ক নেই।
রব-মান্না আবার মাঝখানে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে গঠন করেছিলেন যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু এক ঘরেতো দু’জনের মুরব্বিয়ানা চলতে পারেনা। তাই বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ব্যাপারে ড কামাল হোসেন সূচিবায়ুগ্রস্ত টের পেয়ে তাকে বাদ দিয়েই বিএনপি জোটে চলে আসেন রব-মান্না। এদের সঙ্গে সবশেষে এসে যোগ দিয়েছেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে একাত্তরে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর তার বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার বাহিনী একসঙ্গে অস্ত্র সমর্পনও করেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রভাবে তার বাহিনীর অস্ত্র সমর্পন হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদ করতে আবার ভারতে যান। কিন্তু ততদিনে ভারতে কংগ্রেস শাসনের অবসান হলে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদক হবারও চেষ্টা করেছেন। সোনার বাংলা নামে কোম্পানি খুলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার অনেকগুলো সেতু নির্মানের কাজ নেন। কিন্তু এর একটি সেতুরও কাজ শেষ না করে টাকা তুলে নেবার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানা হয়। একাত্তরের দাপুটে মুক্তিযোদ্ধার নাম হয় সেতু চোর। বিএনপি আমলে এসবের ফাঁড়া কাটাতে তিনি খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ হন। গামছা গলায় নিয়ে গঠন করেন আলাদা রাজনৈতিক দল। কিন্তু এ দলটি টাঙ্গাইলের একটি আঞ্চলিক দলও হতে পারেনি। অর্থনৈতিক সমস্যায় তিনি সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের দিগন্ত টিভিতেও কাজ করেছেন। ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এবার পারবেন সে গ্যারান্টিও এখনও নেই।
এখনও প্রতিদিন নানাকিছুতে হম্ভিতম্ভি করেন মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী। কিন্তু তিনি যে এখন আর একাত্তরের কাদের সিদ্দিকী না, এই সরল হিসাবটিও তার মাথায় থাকেনা। এখন তিনি রাজাকারদেরও প্রিয়। আর আজকের সময়ে শূন্য রাজনৈতিক গণভিত্তির এইসব লোকজনকে একসঙ্গে করতে ভূমিকা পালন করেছেন বিএনপির বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্যের ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ত্রিপুরার মেলাগড়ে গড়ে তোলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিশেষ একটি হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হবার পর সাভারে বঙ্গবন্ধুর দেয়া জমিতে গড়ে তোলেন আজকের গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল ও কমপ্লেক্স। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি সাবেক চীনপন্থী বামপন্থীতো। এই লোকজন সব সময় আওয়ামী লীগ বিরোধীই হয়। সে কারনে বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী, গণস্বাস্থ্যের জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী শাসনের বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জমি নিয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দোসর-সহযোগীদের অন্যতম। জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ইনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। চিন্তায়-মননে এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতির মানুষ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মূল রাজনৈতিক মিশনটি যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা। বিএনপিকে দিয়ে হচ্ছেনা দেখে এখানে ড কামালকে শিখন্ডি বানানো হয়েছে। কিন্তু জোট গঠনের শুরুতে নানান ভালো ভালো বচন দিলেও এরমাঝে প্রমানীত কোন নিয়ন্ত্রন নেই ড কামালদের। কারন তাদের কোন গণভিত্তি নেই।
নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে স্পষ্ট কামাল হোসেনরা জোট গঠন উপলক্ষে যে সব ভালো ভালো কথা বলেছিলেন এর সবকিছু বচনমাত্র। বিএনপির পুরো নির্বাচনে মনোনয়ন প্রক্রিয়াটিরই খুব স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রক বিদেশে পলাতক তারেক রহমান। যাকে শুরুতে ড.কামাল বলেছিলেন, থাকবেনা। ‘কোথাকার কোন তারেক লন্ডনে বসে কী করছে না করছে! তার সঙ্গে জোটের কোন সম্পর্ক থাকবেনা’। ড কামাল হোসেনরা বলেছিলেন যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গিদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে কোন সম্পর্ক তাদের থাকবেনা। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে বিএনপি জোটে এখন ড কামাল-রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকী এদের সঙ্গে জামায়াতের আলাদা কোন পার্থক্য নেই। জামায়াতের ২৫ জন প্রার্থী এবার ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। জামায়াতের মতো ধানের শীষে নির্বাচনও করবেন মান্নারও ৯ প্রার্থী।
ড.কামালের গণফোরাম, রবের জাসদ প্রার্থীরাও নির্বাচন করবেন ধানের শীষে। এবং কোথায় কাকে কয়টা আসন দেয়া হবে-হচ্ছে এর সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক লন্ডনে থাকা তারেক রহমান। জামায়াতের মতো ড.কামাল-রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকীও এখানে তারেক রহমানের কৃপা প্রার্থী। কারন ড কামাল যতোই বলুননা কেনো, ‘কোথাকার কোন তারেক’, কার্যত তার লোকবল আছে ড কামালের বিশাল ইমেজ আছে কিন্তু কোন লোকবল নেই। ক্ষমতার ভারসাম্য-দেড়শ আসন এসব গালগল্পও আর নেই। আসন সমঝোতার নামে দন্ডিত-পলাতক তারেকের দরবারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন সংবিধান প্রনেতা ড.কামাল হোসেন, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রব, একাত্তরের বিশাল মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীগং। তারেক সাহেব যদি দেন যদি কিছু বেশি সিট দেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানান বাগাড়ম্বর করেছেন ড কামালগং। কিন্তু বিএনপি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদেরই মনোনয়ন দিয়েছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এরা কথা বলেছেন! আর বাংলা ভাইদের স্রষ্টা আলমগীর কবিরদেরই দলে ফিরিয়ে নিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আইকন মাশরাফি বিন মোর্তজার বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয়েছে মুফতি শহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা মামলার আসামী ফকির শওকত আলীকে! সাংবাদিক নির্যাতনকারী, বিতর্কিত ডিগবাজি বিশারদ গোলাম মাওলা রনিকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। ড.কামালরা এমন এক বিএনপি নামের কাঁঠাল গাছ থেকে দেশের মানুষকে আম দেবার প্রতারনামূলক ঘোষনা দিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পর্বেই স্পষ্ট হয়ে গেলো কাঁঠাল গাছে কাঁঠালই হয়। আম নয়। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার নিয়তে বিএনপি নামের কাঁঠাল গাছটির ডালে বসে আম নামের কাঁঠাল খাওয়ানোর ড.কামালদের প্রতারনামূলক মুখোশ এরমাঝে প্রকাশিত। বিপদ বুঝলে বিদেশ পাড়ি জমাতে পারদর্শী ড কামাল। খুব স্বাভাবিক এখন আবার ক্ষনগননা শুরু হবে এই প্রতারকের নেক্সট ফ্লাইট কবে।