ফজলুল বারী:মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগে ২২ জন রাজাকার(!) খুঁজে পেয়েছে বিএনপি! দলটির অফিস বাসিন্দা মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি এক ব্রিফিং’এ এ ব্যাপারে একটি তালিকা দিয়েছেন! তালিকায় বলা হয়েছে অমুক অমুক রাজাকারের ভাই অথবা সন্তান। অমুক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন। একাত্তরের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নামও রাখা হয়েছে এই তালিকায়! এসব কারনে শুরুতেই এই অনুসন্ধান তালিকাটি গড়বড়-হাস্যকর হয়ে গেছে। সারাক্ষন ‘আওয়ামী লীগেও রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী আছে’, ‘আগে নিজদের ঘরের যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের বিচার করেন’ এসব বলতে বলতে পাওয়া গেলো সাকুল্যে ২২ জন! অথচ এদের একজনও কী অস্ত্রহাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী?
এ যেন সেই বাক্যটিকে সামনে নিয়ে সামনে নিয়ে আসে! ‘লক্ষ লক্ষ সৈন্য মরে কাতারে কাতার, গুনিয়া শুমারে মিলে চল্লিশো হাজার’! আর বিএনপির অনুসন্ধানে একশ’ নামও মিললোনা! অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে তাদের ২২ জনের একটি হাস্যকর তালিকা করতে পারার কারন রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কারনে আওয়ামী লীগে কোন দাগী যুদ্ধাপরাধীদের জায়গা পাওয়া সম্ভব ছিলোনা। কারন কখনো নেতাকর্মী-সমর্থকদের ঘাটতি ছিলোনা তৃনমূল পর্যায়ের ইতিহাস প্রাচীন দলটিতে । পারিবারিক-রাজনৈতিক কারনে বিচ্ছিন্ন গুটি কয়েক এখানে ঢুকে গেলেও যুদ্ধাপরাধীদের নিজস্ব বাইবেলে বিএনপির তালিকার কারো কোন স্বীকৃতি নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বাইবেলের নাম হলো একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকার ফাইল। সাচ্চা পাকিস্তান প্রেমিক যোদ্ধা হিসাবে যাদের যোগ্য-পরীক্ষিত মনে করা হয়েছে এদের নামই শুধু একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকায় স্থান হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর দাগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিশেষ কাজে দিয়েছে একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকার ফাইলটি। সে কারনে এদের ফাঁসির পর বিএনপি একটু উফ-আহ প্রতিক্রিয়াও দিতে পারেনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির পর দলটি তার জন্যে একটি শোক বিবৃতি দেয়া দূরে থাক, গোপনে একটি মিলাদও দিতে পারেনি।
আমরা সেই এরশাদ আমল থেকে কর্নেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান, ড আহমদ শরীফ, শাহরিয়ার কবির প্রমুখের নেতৃ্ত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেন্দ্রের ব্যানারে যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের বিচার ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের আন্দোলন করে আসছি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম পরে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। এই আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগ ও দেশের বামপন্থী দলগুলো, প্রগতিশীল ছাত্র-নারী-শ্রমিক সংগঠন সমূহ, অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সংগঠন, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, প্রগতিশীল লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে পেলেও কখনো বিএনপি-জাতীয় পার্টিকে বা এদের সহযোগীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন সমর্থন পাইনি। এ দুটি দলে মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও তারা কখনো আমাদের সমর্থনে দাঁড়াতে পারেননি।
কারন দল দুটির জন্ম সেনানিবাসে। দল ভারী করতে শুরুতেই এরা চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে নিয়েছে। এরমাঝে জাগোদল-বিএনপি গঠনের আগে জেনারেল জিয়া সামরিক ফরমানে দালাল আইন বাতিল করে বন্দী যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে তাদের দলে জায়গা দেন। একই নীতি অনুসরন করেন জেনারেল এরশাদ। এসব তাদের ছিল ‘বিভেদ ভুলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রাজনীতি’!
সামরিক বাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অনেকে পরবর্তিতে জিয়া-এরশাদের দলে যোগ দিয়েছেন। ভাসানী ন্যাপের মুক্তিযোদ্ধা অনেকেও যোগ দিয়েছেন এ দুটি দলে। বিচ্ছিন্নভাবে শাহ মোয়াজ্জেমের মতো কিছু আওয়ামী লীগারও যোগ দেন সামরিক জেনারেলদের দলে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম হয়েছিল জাসদ। এ দলটিতেও তখন বিপুল সংখ্যক স্বাধীনতা বিরোধী নেতাকর্মী যোগ দেন। কিন্তু বিএনপি গঠন আর জিয়া স্বাধীনতা বিরোধীদের দল গঠনের সুযোগ দিলে জাসদে আশ্রয় নেয়া স্বাধীনতা বিরোধীরাও যার যার সুবিধাজনক জায়গায় ফিরে যায়। আর বিএনপি-জাতীয় পার্টিতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিলেও কর্তৃ্ত্ব সবসময় স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে। সে কারনে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে মহাসচিব করে বিএনপি গঠিত করা হলেও প্রধানমন্ত্রী করা হয় স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে তদবির করতে গিয়েছিলেন।
জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এরজন্যে বিএনপির অনেকে সোহাগ করে তাদের দলকে মুক্তিযোদ্ধাদের দল বলতে চান! আমি তা বলিনা। মুক্তিযোদ্ধাদের দল যদি এটি হবে তাহলে মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগানের বদলে এ দলের শ্লোগান কেনো হবে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ? বাংলাদেশ বেতারের নাম পাল্টে রেডিও পাকিস্তানের আদলে করা হবে রেডিও পাকিস্তান? কেনো বাংলাদেশের সংবিধান পালটে ফেলা হলো? মুক্তিযুদ্ধের ম্যাগনাকার্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষনকে কেনো নিষিদ্ধ রাখা হয়? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে জিয়ার আমলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিষিদ্ধ ছিলেন, এটি কি কোন মুক্তিযোদ্ধার কাজ ছিলো? ক্ষমতায় থাকতে মুক্তিযুদ্ধকে উপহাস করতে আরেকটি ধংসাত্মক কাজ করেছেন জিয়া। সংসদ ভবন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী খান এ সবুর, মশিউর রহমান যাদু মিয়া এদের কবরস্থান করা হয়েছে! একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে তার পূর্বসূরী জিয়ার সবকিছু অনুসরন করেন। স্বামীকে স্বভাবসুলভ অনুসরন করেন খালেদা জিয়া। নইলে বিএনপিতে এত লোকজন থাকতে ক্ষমতায় এসে তার কাছে একাত্তরের রাজাকার বরিশালের শান্তি কমিটির প্রধান আব্দুর রহমান বিশ্বাসকেই রাষ্ট্রপতির পদে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি মনে হলো?
খালেদা জিয়া ক্ষমতা এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকি বিচার পন্ডের অপচেষ্টায়! এই বিচার ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারী করা হয় সোহরাওয়ার্দি উদ্যান এলাকায়। জনতার বাধভাঙ্গা অংশগ্রহনে পন্ড হয় সে অপচেষ্টা। কিন্তু এরপর আক্রোশে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সহ ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে। একাত্তরে স্বামী-সন্তান হারানো ক্যান্সারে আক্রান্ত শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, খালেদা জিয়ার সেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরন করেছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভায় স্থান দেন চিহ্নিত দুই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদকে! একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকার পাতায় পাতায় আছে মুক্তিযোদ্ধাদের দুস্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে কতলে তাদের ঔদ্ধত্ব্য। নিজামী-মুজাহিদকে সরকারি প্লট দেবার সুপারিশপত্রে খালেদা জিয়া নিজের হাতে লিখেছিলেন, ‘দেশ ও জাতির জন্যে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখার জন্যে’! নিজামী-মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছেন পাকিস্তান না বাংলাদেশের জন্যে? এটি কী কোন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’র কাজ? মূলত এসব কাজ-তৎপরতায় বিএনপি দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষজনের ক্রোধের শিকারে পরিণত হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে বিপুল ভরাডুবির পর জামায়াত সঙ্গ নিয়ে বিএনপির ভিতরেও কথাবার্তা উঠেছিল। কিন্তু দোকানটি খালেদা জিয়ার। তার অনাগ্রহে তাদের থামতে হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে রেখেই ২০০৮ সালের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। সংসদের প্রথম বৈঠকেই এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাশ হয়। এরপর থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের একে একে গ্রেফতার, বিচার ও তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। একদিন আমরা যারা এই বিচারের স্বপ্ন দেখতাম তাদের কাছেও বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য। আর এটি সম্ভব হয়েছে নির্বাচনী ইশতেহারের ওয়াদা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার একক দৃঢ়তায়। আর খালেদা জিয়া এবং বিএনপি শুরু থেকে এই বিচারের বিরোধিতা করেছে! বাংলাদেশের সব বিচার দেশের সিভিল আদালতে হয়। আর খালেদা জিয়া এবং বিএনপি শুধুমাত্র এই বিচারে দাবি করে স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মান! খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন হন যুদ্ধাপরাধীদের হেড উকিল। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গণজাগরন মঞ্চ গড়ে উঠলে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ টিভিতে বলেন ইচ্ছা হয় ওখানে ছুটে যাই। আর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে খালেদা জিয়া বলেন কিসের গণজাগরন, এটাকে গণজাগরন বলেনা। ওখানে কিছু গাজাখোর, নাস্তিক লাফালাফি করছে। এভাবেই দিনে দিনে দেশের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিএনপি।
একেকটি যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির পর সারাদেশের বিপুল প্রতিক্রিয়ার মুখে বরাবর কুলুপ এঁটে চুপ মেরে বসেছিল বিএনপি। আর মাঝে মাঝেই বলেছে আওয়ামী লীগেও যুদ্ধাপরাধী আছে। আওয়ামী লীগ আগে তাদের বিচারের আওতায় আনুক। তাদের বিচার করুক। অতঃপর যখন জামায়াতের প্রার্থীদের বিএনপি পরিচয়ে ধানের শীষে প্রার্থী করা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তখন বিএনপি প্রকাশ করলো আওয়ামী লীগের রাজাকার নামের ২২ জনের একটি তালিকা! এর মাধ্যমে বিএনপি কী স্বীকার করলো যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার মানে একটি খারাপ অস্তিত্ব! না ভাবখানা আমাদের এখানে যেমন আছে আওয়ামী লীগেও আছে! তাই কাটাকাটি! বিএনপির পন্ডিতদের বলছি আওয়ামী লীগের যে তালিকাটি দিয়েছেন তাদের কারো বিরুদ্ধে একাত্তরে মানুষ খুন-ধর্ষনের কোন প্রমান যদি থাকে তা আমাকে দিন। আমি তা লিখবো। তাদের বিচার চাইবো। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তমাখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বে আমরা কোন যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ক্ষমতায় বসতে দেবোনা। বিএনপির ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে এখানেই আমাদের মূল আপত্তি। এতোকিছুর পরও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত সঙ্গ তারা ছাড়তে নারাজ। যুদ্ধাপরাধীদের নিবন্ধনহীন দল জামায়াতের পঁচিশজনকে প্রার্থী করার বিতর্কের মধ্যে বিএনপি নির্বাচন কমিশনে বলে এসেছে এরা জামায়াতের না বিএনপির প্রার্থী! বিএনপি তাদের মনোনয়ন দিয়েছে! এই হলো কথিত মুক্তিযোদ্ধাদের দল বিএনপির আসল চেহারা!