এরশাদের জাতীয় পার্টি নাচে গানে ভরপুর এক সম্পূর্ন রঙ্গিন দল

এরশাদের জাতীয় পার্টি নাচে গানে ভরপুর এক সম্পূর্ন রঙ্গিন দল

ফজলুল বারী: চলমান নানা ইস্যুর ব্যস্ততা অনেক দিন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে লেখার সময় করতে পারিনা। দেশে থাকতে আমার যে সব রিপোর্টিং বিট ছিল এর অন্যতম ছিল জাতীয় পার্টি। এরশাদ থেকে শুরু করে এর নেতাকর্মীদের অনেককে খুব কাছে থেকে দেখার জানার সুযোগ হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আমার রিপোর্ট খুব এনজয় করতেন পাঠকরা। দলটির রিপোর্টিং এর সোর্স নেতাদেরও আমি মজা করে বলতাম আপনাদের দল নাচে গানে ভরপুর একটি সম্পূর্ন রঙ্গিন দল! এর তথ্য শুনতে মজা লাগে। লিখতে মজা লাগে। পড়তে মজা লাগে। দলীয় কোন্দল-কূটনামি-অর্থনৈতিক লেনদেন-সেক্স-ক্রাইম কী এখানে নেই! মুখের ওপর এমন কথায় তারাও মনে তেমন কিছু করতেননা। আমারও মনে হতো এরশাদ থেকে শুরু করে এর নেতারা নেগেটিভ-পজিটিভ যে রিপোর্টই হোক না কেনো যে কোন ভাবে এরা মিডিয়ায় থাকতে পছন্দ করেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্ধকার দিক, এটি কতোটা অসৎ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, এর প্রমান দিতে গেলে এর অনেকগুলোর একটি হলো এখানকার রাজনীতিতে এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির এখনো টিকে থাকা। কোন মহান নীতি-আদর্শ নয়, একজন ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জেনারেলের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কৌশল হিসাবে জাতীয় পার্টির সৃষ্টি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার যারাই এখানে গেছেন তারা গেছেন পদ-বিত্তের লোভে। অথবা আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিতে তাদের জায়গা হচ্ছিলোনা। এরশাদের চারিত্রিক দূর্বলতা, অনেক বান্ধবী, বহুগামী চরিত্রের বিষয়টা ছিল ওপেন সিক্রেট। জিনাত সহ অনেকের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক কোন কল্পকাহিনী ছিলোনা। রওশনের যেহেতু সন্তান হচ্ছিলোনা তাই তিনি বিষয়গুলো মেনে চলছিলেন অথবা তাকে টাকায় ম্যানেজ করা হচ্ছিলো। চোর সাজিয়ে নিজের বিয়ে করা স্ত্রী বিদিশাকে তিনি বিদায়ও করতে সম র্থ হন। তখন বিএনপি এরশাদকে তাদের সঙ্গে নেয়ার চেষ্টা করছিল। সে কারনে তারেক-বাবর মিলে তাকে প্রশাসনিক সমর্থন দেন। তবে বিদিশাকে বিয়ে করার পর বিদ্রোহ করেন রওশন। সেই যে তারা দুই বাড়িতে থাকা শুরু করেন, এখনো এরশাদ থাকেন বারিধারায়, রওশন গুলশানে। বয়সের ভারে দু’জনেরই এখন অবশ্য থুরথুরে অবস্থা।

এমন একজন এরশাদ যখন গনআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন তখন জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সব স্তরের নেতাকর্মীরা গনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে যান। সেই দলটি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর-সিলেট অঞ্চলে চাঞ্চল্যকর ভোট পেয়েছে। জেলখানায় বসে এরশাদ জয়ী হন পাঁচটি আসনে। রংপুর অঞ্চলের ভোট ছিল তার প্রতি ‘হামার দেশের’ সহানুভূতি। আর সিলেট অঞ্চলের ভোট ছিল রক্ষনশীল পুরুষতন্ত্র। নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে তখনো অনেকে প্রস্তুত ছিলেননা। আর এরশাদের টাকার গরমতো ছিলোই। এরশাদের পতনের পর কোন দেশে তার কতো পাচার করা লুকানো অর্থ-সম্পদ, তা নিয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু কোথাও থেকে একটি টাকাও উদ্ধার হয়নি বা যায়নি। আমি যখন জাতীয় পার্টির রিপোর্ট করতাম তখনো এ দলটি চলতো পুরোপুরি এরশাদের টাকায়। এ দলের আজকের প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকে শুরু করে অনেক নেতা ছিলেন এরশাদের বেতনভূক্ত কর্মচারী। যাদের নাম লিখে লজ্জা দিতে গেলামনা।
সেই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সেই ১৯৯১ সাল ফুটবল খেলেছে কখনো বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগ। এরশাদের নামে যেহেতু অনেক মামলা, তাই তিনি নতুন করে জেল জুলুম এড়াতে সব সময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপোস করে চলেন। আর বিএনপি জোটে জামায়াত থাকায় আওয়ামী লীগের এমন একজন এরশাদের দরকার ছিল। এসবকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি বারবার ভেঙ্গেছে। যেমন ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দলটির মহাসচিব থাকা অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে এরশাদের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। জেল থেকে বেরিয়ে এরশাদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে চাপ দিলে এরশাদের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি করেন। এরশাদ তখন নতুন মহাসচিব করেন নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে। যাকে বলা হতো এরশাদের খাজাঞ্চি। ক্ষমতায় থাকতে দুর্নীতির অনেক সম্পদ এরশাদ নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নামে করেন। ওই সময়ে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-জামায়াতকে নিয়ে গঠন করা হয় চারদলীয় জোট। এরশাদ এখান থেকে বেরিয়ে গেলে খালেদা জিয়া নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে দিয়ে গঠন করান আলাদা জাতীয় পার্টি। এটির নাম হয় বিজেপি। এভাবে নিজের কাছে থাকা সম্পদ সহ নাজিউর রহমান মঞ্জুর এরশাদের কর্তৃ্ত্ব থেকে চম্পট দেন। নাজিউর রহমান মঞ্জুর মৃত্যুর ওপর ওই দল সম্পত্তির মালিক হন তার ছেলে আন্দালিভ রহমান পার্থ। রেডিমেট দল-অর্থ সম্পদ সেই সবকিছু নিয়ে পার্থ এখন বিএনপির ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আছেন।
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় মাঝে-মধ্যে এং করেঙ্গা তেং করেঙ্গা বললেও এরশাদ এখান থেকে সরতে পারেননি। কারন আওয়ামী লীগকে দিয়ে নানান মামলা মুসিবত আসান করলেও মঞ্জুর হত্যামামলাটি মাথার ওপর রয়েই গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে জাতীয় পার্টি কিম্ভূত কিমাকার রূপ নেয়। মুখে নির্বাচন বর্জন করলেও চিকিৎসা বন্দী হিসাবে তার স্থান হয় সিএমএইচে। সেখান থেকে বেরিয়ে শপথ নিয়ে এমপি এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। কিন্তু তার কোন কাজ নেই। কিন্তু মন্ত্রী পদ মর্যাদার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে অফিস-পতাকা-পদ মর্যাদা সবকিছুকে কাজে লাগিয়ে এরশাদ একটি ব্যাংকের মালিকও হয়েছেন। রওশন এরশাদ বিরোধীদলের নেতা, জাপার কয়েকজন মন্ত্রিসভায়! মুখে বিরোধীদল হলেও কাজেকর্মে স্ববিরোধিতায় আওয়ামী লীগের গৃহপালিত হিসাবে দলটির জনভিত্তি যা যেখানে ছিল সেখানেও ধস নামে।
পুরনো অভিজ্ঞতায় এবার যখন নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি নিয়ে নানান আলাপ হচ্ছিল তখন আমি হাসছিলাম। এসব আলাপ তৎপরতার কারন দল হিসাবে এটিকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করেনা। এমনকি এ দলের নেতাকর্মীরাও নয়। এরশাদ এখন সত্যি সত্যি অসুস্থ। বার্ধক্যজনিত নানান অসুস্থতা নিয়ে কর্মচারীদের নিয়ে থাকেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায়। কারো সমর্থন ছাড়া তিনি এখন হাঁটতেও পারেননা। কিন্তু এ অবস্থাতেও দুই বুড়োবুড়ি থাকেন পৃথক বাড়িতে। এর কারনে শারীরিক সমস্যায় এরশাদকে প্রায় সিএমএইচে যেতে হয়েছে। সাবেক সেনা প্রধান হিসাবে সেখানে তিনি চিকিৎসায় বিশেষ সুবিধা পান। এরমাঝে জাতীয় পার্টি তিনশ আসনের নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলছিল। আবার বলছিল আওয়ামী লীগ থেকে অত অত আসন নেয়া হবে। এসব বলে মনোনয়ন বানিজ্য করেন রুহুল আমিন হাওলাদার, সুনীল শুভ রায় প্রমুখ। রুহুল আমিন জাতীয় পার্টির ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ নেতা। সুনীল শুভ রায় এরশাদের বেতনভূক্ত কর্মচারী কাম প্রেসিডিয়াম সদস্য। এদের মনোনয়ন বানিজ্য এরশাদ জানতেননা তা আমি বিশ্বাস করিনা।
আওয়ামী এবার জাপাকে যতগুলো আসন দিয়েছে এটিই বেশি ঝুঁকিপূর্ন হয়ে গিয়েছিল। কারন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে অতগুলো আসনের জয়ের অবস্থা ছিলোনা। রংপুরও এখন আর তাদের একচেটিয়া দূর্গ নয়। এরপর মনোনয়ন বানিজ্যে যাদের থেকে টাকা নেয়া হয়েছে তাদের শান্ত করতে উন্মুক্ত আসনের নামেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী দেয়া হয়। এই জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বানিজ্য নিয়ে বেশি অসন্তোষ দেখা দিলে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। আবার সিঙ্গাপুর যাবার আগে এরশাদ সেই রুহুল আমিন হাওলাদারকেই দিয়ে যান তার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার দায়িত্ব। সিঙ্গাপুর থেকে এসে আবার দলের দায়িত্ব দেন ছোট ভাই এবং আরেক বেতনভূক্ত জিএম কাদেরকে। এটিই জাতীয় পার্টি। এটি এরশাদের দোকান। দোকানে তিনি কোন কর্মচারী রাখবেন বা রাখবেননা এটি সম্পূর্ন তার এক্তিয়ার। পোষালে থাকেন। নইলে বিদায় হন। এরজন্য একটি প্রেস রিলিজই যথেষ্ট। নামে বিরোধীদল হলে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে আরাম আর বিপুল অর্থের মালিক বনা এ দলের বর্তমান প্রভাবশালীরা গত কিছুদিনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বলতে শুরু করেন তারা আবার মন্ত্রীত্ব চান। এমন সময় এরশাদ ঘোষনা দিয়েছেন জাপা বিরোধীদলে থাকবেন। তিনি বিরোধীদলের নেতা, তার ছোটভাই উপনেতা। এরজন্যে কোন সংসদীয় দলের বৈঠকেরও প্রয়োজন হয়নি!
এরশাদ জানেন বিরোধীদলের নেতার পদটিও মন্ত্রী মর্যাদার। এটি তার থাকবে। তিনি দোকানের মালিক, ধড়ে যতোক্ষন প্রান আছে ততোক্ষন ভালো পদটির মালিকানাতো তার। জাতীয় পার্টির আরও কিছুদিন রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্যে এটি হয়তো ইতিবাচক হয়েছে। কিন্তু এখানে রওশনের কোন পদ নেই। দৃশ্যত আওয়ামী লীগও জাপার তিন-চারজনকে মন্ত্রীত্ব দেয়া থেকে বেঁচে গেলো। কিন্তু জাপার রওশনপন্থীরা তলে তলে কী ভূমিকা হয় তা এখন দেখার বিষয়। এরশাদ তার দলের মালিকানা ছোটভাই জিএম কাদেরকে দিতে চাইলেও তার স্ত্রীর সঙ্গে তথা দেবর-ভাবীর সম্পর্ক ভালো নয়। এরশাদ-রওশন দু’জনেই এখন বয়োঃবৃদ্ধ। দু’জন যতোক্ষন বেঁচে আছেন এ দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে। আর গত নির্বাচনে প্রার্থী পরিচয়ের সময় শেখ হাসিনাতো বলে রেখেছেন আগামীতে লাঙ্গল তথা জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের তিনি তুলে নেবেন নৌকায়।