জাহিদ স্যার কে নিয়ে কিছু কথা না লিখলেই নয়…

জাহিদ স্যার কে নিয়ে কিছু কথা না লিখলেই নয়…

অধ্যাপক (সদ্য প্রয়াত) , তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড.শায়লা আক্তার :গত ঊনত্রিশে জানুয়ারী, ২০১৯ আমাদের ডিপার্টমেন্ট “ইইই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” (সাবেক ফলিত পদার্থবিদ্যা, ইলেকট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) এর শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জাহিদ হাসান মাহমুদ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। উনার এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। স্যার-এর প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে আমি অনেক গর্বিত আর প্রিভিলেজড। স্যার কে নিয়ে কিছু কথা না লিখলেই নয়…

ছাত্রদের সাথে প্রফেসর জাহিদ হাসান মাহমুদ

আমি যখন ২০০৪ এ অস্ট্রেলিয়া তে এপলাই করছি, কয়েকটা ইউনিভার্সিটি তে ডকুমেন্টস পাঠিয়েছি, সেইগুলো সত্যায়িত করা (ম্যাক্সিমাম) আর নিজের সুপারভাইসর ছাড়াও আরেকজনের রিকমেন্ডেশন লেটার-এর ব্যবস্থা স্যার করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ-এ কিছু শিক্ষকতা ছাড়া আর কোনো কাজের এক্সপেরিয়েন্স আমার ছিল না। তাই প্রয়োজনে যেন এক্সপেরিয়েন্স শো করতে পারি সেটার ব্যাবস্থাও উনি করে দিয়েছিলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট ছিল না তখন, আমাকে এই ওয়েবসাইট তৈরির কাজটা দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেইটা করার আগেই আমি চলে যাই অস্ট্রেলিয়াতে। ওয়েবসাইট তৈরির প্রাথমিক কিছু কাজ আর ডকুমেন্টস-এর কাজে অনেক সময়-ই স্যার-এর বাসায় গিয়েছিলাম, কখনো ডিপার্টমেন্ট-এর বান্ধবীর সাথে , কখনো বা বাবার সাথে। এমন-ও দিন গেছে যখন স্যার সময় দিতে পারবেন না তাই ছোট্ট অঞ্জন (স্যার-এর ছেলে) কে বলে দিয়েছিলেন আমাকে কিছু ফ্ল্যাশ আর গ্রাফিক্সের কাজ দেখিয়ে দিতে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কিভাবে এত ছোট একজন মানুষ টুক টুক করে ফ্ল্যাশ-এর কাজ করে দেখাচ্ছে! ব্রিলিয়ান্ট, স্যার-এর মতোই! আব্বু আসতে একদিন সময় নিয়েছিলেন, জ্যাম-এ পরে দেরি হচ্ছিলো, তাই ছোট্ট জারিন (স্যার-এর মেয়ে) আর ভাবীও আমাকে অনেক্ষন সঙ্গ দিলেন! উনারা সম্পূর্ণ পরিবার-ই আমাকে সবসমই নিজের পরিবারের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতেন – বড়োই অদ্ভুত লাগতো আর প্রিভিলেজড ফীল করতাম! আব্বুর সাথে স্যার-এর অনেক গল্প হতো – দুইজন-ই গল্প করতে অনেক পছন্দ করতেন! আব্বু আমাকে বলেছিলেন “জাহিদ স্যার ইস আ রিয়েল জেন্টলম্যান! হি ইস সো কাইন্ড! ইউ আর ভেরি লাকি টু হ্যাভ সাচ এন অ্যামেজিং মেন্টর!” এরপর অস্ট্রেলিয়া তে যাওয়ার পরেও স্যার নিয়মিত যোগাযোগ করতেন, ইমেইল করতেন। আব্বুর সাথে যোগাযোগ করতেন আমার খবর নেয়ার জন্য। আমার আরো কিছু ডকুমেন্টস-এর ব্যাবস্থাও স্যার করে দিয়েছিলেন যখন আমি অস্ট্রেলিয়া তে পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশিপের জন্য আবেদন করছিলাম। আনফর্চুনেটলি, এর কয়েক বছর পরে ব্যাক্তিগত জীবনে কমপ্লিকেসি আসাতে আমি অলমোস্ট সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, স্যার-এর সাথেও আর যোগাযোগ হলোনা…

বলে রাখতে চাই, আমার সুপারভাইসর শ্রদ্ধেয় আনিকা ম্যাডাম অন্যতম ছিলেন অবশ্যই! উনি আমাকে অনেক ভাবে সাহায্য করেছেন সবসময়! কিন্তু উনার বাইরে আরেকজনের রিকমেন্ডেশন লেটার এর জন্য আমি ডিপার্টমেন্ট-এর আরো অনেককেই রিকোয়েস্ট করেছিলাম। উনারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জাহিদ স্যার শুধু আমাকে না, আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেককেই অনায়াসেই রিকমেন্ডেশন লেটার দিয়েছিলেন।

গতকাল থেকে আমার ফেসবুকের হোমপেইজ ভরে গেছে স্যার কে নিয়ে সবার আন্তরিক লিখা দিয়ে। বুঝতে পারলাম, শুধু আমাকেই না, উনি বছরের পর বছর এইভাবে নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের জন্য করে গিয়েছেন, অগণিত মানুষের জন্য! আমাদের অনেকের-ই ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট-এ জাহিদ স্যার-এর নাম অনবদ্য। কিভাবে পারতেন এত্ত এত্ত জনের সাথে ইন্ডিভিজুয়ালি যোগাযোগ রাখতে? সবার টেক কেয়ার করতে? স্যার-এর কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনো ফিরে যায়নি। আমার তালিকায় উনি পার্সোনাল কমুনিকেশন আর অন্যতম সাহায্যকারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ, শিক্ষক হিসেবে সবচাইতে বেশি সফল! He was a miracle man, a true superhero!!

প্রফেসর জাহিদ হাসান মাহমুদ

দুঃখ হচ্ছে, আমি গত কয়েক মাস ধরেই স্যার এর সাথে যোগাযোগ করবো বলে ভাবছিলাম। কয়েক মাস আগে স্যার নিজেই আমার এক পোস্ট-এ আমার বর্তমান ইমেইল এড্রেস চেয়ে আমাকে একটা ব্ল্যান্ক ইমেইল করেছিলেন। বলেছিলেন পরে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না! ভীষণ গিল্টি ফিলিং হচ্ছে আমি কেন যোগাযোগ করলাম না! কষ্ট হচ্ছে যে উনার মতো এত্ত ভালো একজন মানুষ কেন এত কষ্ট করলেন? কেন এত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেন? উনার মৃত্যুর পরে আমরা কতজন উনাকে নিয়ে লিখেছি… কিন্তু উনি বেঁচে থাকতে দেখে যেতে পারলেন না যে আমরা এই অগণিত মানুষ উনার প্রতি এত কৃতজ্ঞ, এত্ত পছন্দ করি উনাকে! যদিও এইটা স্যার-এর কাছে ম্যাটার ছিল না কখনোই। উনি নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের জন্য শুধু করে গিয়েছেন। উল্লেখ্য, স্যার শিক্ষকতার পাশাপাশি মানবসেবা আর অনেক চ্যারিটি-র কাজ করতেন।

স্যার-এর এই তাড়াতাড়ি বিদায় নেয়া থেকে একটা চরম শিক্ষা পেলাম যে কাউকে নিয়ে লিখতে হলে তাদের জীবদ্দশায় লিখা উচিত, তাদের সাথে এখনই যোগাযোগ করা উচিত। আমি-ই তো কাল থাকবো না, কখন যাবো তার নিঃশ্চয়তা নেই।

সারাজীবন আমাদের সবাইকে নিয়ে অনেক ব্যাস্ত ছিলেন স্যার, নিজের যত্ন নিতে পারেননি। এখন নিজেকে সময় দিতে পারবেন। আমাদের সবার প্রতি আপনার এই নিঃস্বার্থ অবদান, গরিব দুঃখীদের পাশে সবসময় থাকা, সত্যিকারের দেশপ্রেম আপনাকে আমাদের সবার কাছে অমর করে রাখবে! “ওপারে ভালো থাকবেন, স্যার!”

ড.শায়লা আক্তার (সাউ পাওলো ,ব্রাজিল থেকে)
(প্রাক্তন ছাত্র,ফলিত পদার্থ ও ইলেকট্রনিক বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)