যৌথ নাটক ‘জলকুমারী’ সমাচার

যৌথ নাটক ‘জলকুমারী’ সমাচার

শামীমা আক্তার মুক্তা :ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীরা একত্রি হয়ে অনেক টিভি নাটক, সিনেমা,নাচ,গান,ইত্যাদি অনুষ্ঠান  হয়েছে। কিন্তু পরিপূরক মঞ্চ নাটক এটাই প্রথম। ভাবনাটা যখন থেকে মাথায় এলো তখন থেকে ৬ মাস এই প্রকৃয়ায় লেগে থাকলাম। ভারতের হুগলী জেলার আত্ড়া গ্রামের একটি বন্ধু থিয়েটার দল এর প্রতিষ্ঠাতা তরুন চ্যাটার্জীর সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্তটা চুড়ান্ত করলাম যে আমরা মেঠোপথ থিয়েটার ( বাংলাদেশ)  ও সহজপাঠ থিয়েটার ( ভারত) এর দুই দলের শিল্পীরা একত্রিত হয়ে একটি মঞ্চ  নাটক করবো। একটি নাটক নির্ধারন করা হলো ‘ জলকুমারী ‘। নাটকের রচয়িতা দেবাশীষ ঘোষ দাদাকে নির্দেশনার দায়িত্ব ও অর্পন করলাম। নাটকের শুরুতে আর্থিক বিষয় গুলো আলাপ করে নিয়েছিলাম সহজপাঠ থিয়েটার এর প্রতিষ্ঠাতা বন্ধু তরুন চ্যাটার্জীর সাথে। আমাদের নাটক মঞ্চে নামাতে যত খরচ হবে তার ব্যায় ভার গ্রহন করব দুই দল মিলে। আমি বাংলাদেশে যখন নাটকের সব কিছু প্রস্তুত  করছিলাম তখন সহজপাঠ থিয়েটারের দলপ্রধান প্রদীপ কুমার মাইতি দাদা এবং প্রতিষ্ঠাতা তরুন চ্যাটার্জী প্রতিনিয়ত আমাকে ফোনে সাহস  দিয়ে গেছেন এবং আমার আর কি কি লাগবে সেই বিষয়ে পাশে থেকেছেন। সত্যি বলতে এই মানুষগুলো না হলে আমি সুষ্ঠুভাবে কাজটা করতে পারতাম না।

নাটকের কাজটা মোটামুটি পরিপক্ক করে বাংলাদেশে একটা টেকনিক্যাল শো করলাম ৭ জানুয়ারী ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও হলে। নাটকের সংগীত পরিকল্পনা করলেন বাংলাদেশের শিশির রহমান এবং সেট ও লাইট ডিজাইন করলেন হেন্ড্রি সেন। নাটকের ডিজাইন টা এমন ভাবে করা হলো যে দুইজন অভিনেতা ও নাটকটা করতে পারবে আবার চাইলে ৫/৬ জন মিলেও নাটকটা করা যাবে।

বাংলাদেশ থেকে দুজনকে দিয়ে নাটকটা রেডি করা হলো তারপর আমরা ভারতে চলে গেলাম। সহজপাঠের তিনজন বন্ধু নাটকে  ইন করলো। শুরু হলো মহড়া। ভারতের শিল্পীদের নিয়ে একটানা মহড়া চললো। তারপর  আরো একটি টেকনিক্যাল শো হলো। দলপ্রধান প্রদীপ কুমার মাইতি দাদার বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা হয়েছিল। আমরা কখনো বাড়ীর ছাদে কখনো সহজপাঠ থিয়েটার এর মহড়া কক্ষে মহড়া করতাম।

জায়গাটা  গ্রাম কিন্তু অসাধারন। রাতের বেলা শিয়াল ডেকে ওঠে। কখনো কখনো হনুমান দেখেছি। আর ঘুঘুর ডাকে প্রান জুড়িয়ে যায়। বিকেলবেলা হঠাৎ অনেকগুলো পাখী একসাথে ডেকে ওঠে। আবার নিস্তব্ধতা। ভোরবেলার মাশীমার পুজোর শাখ বাজানোটা কি যে মিষ্টি লাগে! এই বাড়ীটা কেমন যেনো আপন লাগে আমার। মাশীমা এতো আদুরে আদুরে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরে মনে হয় মা জড়িয়ে ধরলেন। আর দাদা নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর মাশীমা সকালে বাড়ির আঙ্গিনায় রান্না ঘর থেকে ডেকে ওঠেন ‘কৈ গো মুক্তা ঘুম হলো?  এবার স্নান করে খেয়ে নাও বেলা হয়ে এলো’ কী অসাধারন ডাক! মাশীমা নাটকের খুব ভালো বোদ্ধা দর্শক বটে । নাটক দেখে আলোচনা সমালোচনা ও করেন! মাশীমাকে এবার বলেছি পাসপোর্ট করতে বাংলাদেশে নিয়ে আসবো বলে। মাশীমা বললেন পরের বার হয়তো এসে দেখবে আমি নেই! কথাটা শুনে কেমন যেনো বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি বললাম আমি মা হারা হতে চাই না মাশীমা এসব বলবেন না।

এরই মধ্যে সহজপাঠ থিয়েটার এর একজন হয়ে উঠলাম আমি। সবাই আমাকে নিজের দিদির মতই ভাবতে শুরু করলো। বিকেলে দামোদার নদীর স্বচ্ছ পানিতে  নৌকা নিয়ে ঘোরা। পৌষ সংক্রান্তির মেলায় পানিপুরি খাওয়া, হাতে মেহেদী পরা। ওরের মটর বাইকে চড়ে দূরে চলে যাওয়া এখনো ভোলা যায় না। দামোদার নদীর পানি এতোই স্বচ্ছ যে নদির নীচের  মাটিও শেওলা উপর থেকে দেখা যায়। আমি এরকম নদী আর কখনো দেখিনি। তরুন চ্যাটার্জী ভালো লেখে। বেশ কিছু গীতি আলেখ্য লিখেছে। প্রতি বছর এই আলেখ্যগুলো প্রদর্শনী হয়। ভালো অভিনেতাও বটে। ওরা শিল্পী পরিবার। তরুন আর ওর দাদা দুজনেই যাত্রাতেও অভিনয় করে। তরুন পুলিশে চাকরি করে অথচ কি ভালো লেখনী তার। তরুনের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমার। নাটকের মহড়া শেষে ঘোরাঘুরি রাস্তায় দাড়িয়ে চা খাওয়া। ঐতিহ্যবাহি মাংস ভাজা খাওয়া আর কুয়াশা ভেদ করে মটর বাইকে ঘুরে বেড়ানো, বিবেকান্দ মহাশয়ের আশ্রম ও দিঘি দেখতে যাওয়া, চিৎকার করে গান গাওয়া সেযে কী অসাধারন সময় কাটলো বলে বোঝানো যাবে না। সহজপাঠ থিয়েটারের তারক,বাপন,সুজন,অরুন, সবাই কেমন যেনো আপন হয়ে উঠলো।

আমরা ১৪ তারিখ ‘ জলকুমারী নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী করলাম। কলকাতা থেকে বিশিষ্ট গবেষক  আশিস গোস্বামী দাদা এলেন উদ্বোধন করতে। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। আমার হাতে দিয়ে বললেন তোদের জন্য এনেছি। এই নাটকের শুরু থেকেই যে আমাকে সাহজ দিয়েছেন এই সেই মানুষ।  দাদা বললেন এতো দূর জায়গাটা! একমাত্র তোর জন্য এলাম।  এতো কষ্ট করে নাটক করছিস তাই। আহ্লাদে আটখানা হতে মাঝে মাঝে ভালোই লাগে। দুই দেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত এর মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী হলো অনুষ্ঠানের। ভারতের গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গরাও আশীর্বাদ করলেন এই উদ্যোগকে। ১৮ তারিখ আরেকটা প্রদর্শনী হলো আত্ড়া অগ্রনী সংঘের আমন্ত্রণে। অনেক দর্শক অনেক হাত তালি পেলাম। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হলো আমাদের।  আমি বন্ধু তরুন আর প্রদীপ দাদার হাতে আমার ফুলে তোরাটা তুলে দিয়েছিলাম কারন এই দুজন না হলে আসলেই কাজটা হতোনা। তাই এই সম্মান ওনাদেরই দেয়া উচিৎ।

সব কাজ শেষে দেশে ফেরার পালা। সুজনকে বললাম যাবি নাকি বর্ডারে আমাদের বিদায় দিতে? সুজন বলল আমার চোখে জল আসে আমি পারবো না!  পরের দিন শুটিং শুরু হবে তাই রাত চারটায় গাড়ীতে উঠলাম। তরুন একটা গাড়ী ভাড়া করে রেখেছিলো হুগলী থেকে বেনাপোল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। রাত চারটায় ওরা তিন জন এলো গাড়ী নিয়ে বিদায় দিতে। মাশীমা আর প্রদীপ দাদা রাস্তা পর্যন্ত এলেন। মাশীমার চোখে জল!বললেন আবার কবে দেখা হবে কে যানে! জড়িয়ে ধরলাম মাশীমাকে। দাদা স্থির দাড়িয়ে রইলেন। মনে হলো বাবার বাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছি।  তরুন ওর বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে ছিলো আমাদের বিদায় দিতে! গড়ীটা ওর সামনে থামতেই ওর দিকে তাকানো গেলো না। মনে হলো কেমন যেনো হাহাকার ওর বুকে জমে আছে। আমার দিকে খুব একটা তাকাতে পারলো না। ১০ মিনিট পর গাড়ীটা ছাড়লো। গাড়ী ছাড়ার সময় প্রার্থনার মতো করলো আমরা যাতে ভালো ভাবে পৌছাই! পৌছালাম ঠিক মতই। রেখে এলাম অনেক স্মৃতি।