আবুহেনা ভুইয়া: অষ্ট্রেলিয়ার পার্থে বসে মঞ্চ নাটক উপভোগ তাও আবার স্থানীয় থিয়েটারের নিজস্ব পরিবেশনা ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চকর। সেটাই ঘটল গত ১৭ জুলাই শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে পাচটায় মারডক ইউনিভার্সিটির নেক্সাস থিয়েটারের প্রসেনিয়াম মঞ্চে। প্রবাসী বাংলা থিয়েটারের একাদশ বছরে পদার্পন উপলক্ষে নাটক ‘অতঃপর’ মঞ্চায়িত হল। গত দশ বছরে প্রতি বছর একটি করে নাটক মঞ্চায়ন করেছে বাংলা থিয়েটার। ব্রেটল্ড ব্রেখট এর দেওয়ান গাজীর কেচ্ছা, মহাত্তন মলিয়ের কঞ্জুস অন্যতম। বাংলা থিয়েটারের কান্ডারী বাপি মাযহার এই ‘অতঃপর ‘ নাটকের রচয়িতা এবং নির্দেশনাও তার। নাট্যকার বলেন নাটকের কিয়দংশ আমিরিকান লেখকের এক গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত।
প্রতিটি নাটকের একটি গল্প থাকে, থাকে বক্তব্য যা পরিবেশনা ও শিল্পীদের অভিনয় দিয়ে জীবন্ত করে তোলে। এ নাটকের গল্পটা প্রেমের মনস্তত্ত্ব ও ভালোবাসার রকমফের যা নির্ভেজাল রংগরসের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করা হয়েছে।
“অতঃপর” নামটা সাদামাটা তবে কিঞ্চিৎ, কৌতুহলীও বটে। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। এরকম একটি পূর্বভাবনা থাকলেও ভাবনায় ছেদ পড়তে বেশি সময় নেয়নি।
নাটকে গল্পটাতে দেখা যায় ,ঢাকার বারিধারার দুটো পাশাপাশি ফ্লাট বাড়ির গল্প হাত ধরাধরি করে চলে। আমাদের মস্তিষ্কের যেমন দুটো ভাগ আছে। একটি সচল এবং একটা অচল(স্থবিরতা )। বাঙালী সমাজে সচলায়তন ও অচলায়তন তেমনি দুটো চালিকাশক্তি। এ নাটকে অভয় ও অনামিকার শৈল্পিক প্রেম যেমন সামাজিক প্রেমের অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে চলে তেমনই শান্তা- আসাদের নির্লোভ ভালবাসার মধ্যে দিয়ে পারিবারিক মায়া মমতার শর্ত বিচারের চেষ্টা করা হয়। শেষে যেন দুটো গল্প এক হয়ে যায় এবং পরিপূর্ণ সমাজের প্রতিবিম্ব হয়ে ধরা দেয়।
এ নাটকের গল্পের একটা অংশ দর্শকদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করে,চিন্তা ও মননে আঘাত করে আবার আরেকটা অংশ স্বস্তি ও বিনোদন দেয়। একটা অংক গভীর ভাবনার উদ্রেক করে আবার আরেকটা অংক হাসি তামাসার গল্পের পরিনতি দিকে নিয়ে যায়।
চরিত্র রূপায়নে সকল শিল্পীর প্রানান্ত চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে অনামিকা, আসাদ, শান্তা,অভয় ও ডেভিড চরিত্রে যথাক্রমে শামা কামাল , প্রিয়ংকর ঘোষ, ফারহানা আলী সুমি,বাপি মাযহার,সাদেক রহমান যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অনামিকার চরিত্রটা জটিল। সামাজিক অচলায়তন ভেঙে এগিয়ে যাওয়া নারীর প্রেম ও তার আবেগ, আবেদন, মানসিক টানাপোড়েনে, আনন্দ, জিঘাংসা,অনুভূতিতে ভরপুর। অভিনেত্রী শামা কঠিন চরিত্রটি তার অধ্যবসায়, সংলাপ প্রক্ষেপন -অভিক্ষেপণ এবং শারীরিক গতিবিধি সামঞ্জস্য করে সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। যারা ফেরদৌসী মজুমদার এর কোকিলারা দেখেছেন কিম্বা একতলা দুতলা কোথাও হয়তো অভিনয় ধরনের অনুসরণ/মিল পেতে পারেন। অভিনয় দিয়ে চরিত্রকে জয় করার একটা চেষ্টা শামার মাঝে লক্ষ্য করা গেছে। যা আসাদ এবং শান্তা চরিত্রের ক্ষেত্রে ও সত্য।
নাটকে বহুসংস্কৃতি বহুধর্মের সম্প্রীতি তুলে ধরা হয় যা গল্পের খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
তরুণ তরুণীদের জন্য বেশ কতগুলো কালজয়ী বই এর কথা বলা হয়েছে। হয়তো তারা উৎসুক হয়ে পড়বে। বাংলা গান দিয়ে কিভাবে বিয়ের ও গায়ে হলুদের উৎসব সাজানো যায় তার উদাহরণ ছিল এই নাটকে।
অতঃপর নাটকটি প্রবাসী বাংলাদেশি প্রবীণ সদস্যদের একাকিত্ব নিয়ে ভাবাবে। হয়তো বা জাতিগত বৃদ্ধাশ্রম তৈরীর আলোচনা হবে।
নির্দেশনায় বাপি মাযহার যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখাতে পেরেছেন। দলগত সমঝোতাও ছিল বেশ। পোশাক সজ্জা আরো আধুনিক হতে পারতো। সাজ সজ্জা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। মঞ্চ সজ্জা পরিমিত ছিল।
নাটকটি যে দর্শকেরা গ্রহণ করেছেন তা হল ভর্তি দর্শক করতালির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন প্রতিটি অংকের শেষে। বাংলা থিয়েটার এই নাটকটি দেশে বিদেশে বিভিন্ন শহরে প্রদর্শন করা যেতে পারে।