আমাদের কালে মুরুব্বিরা মনে করতেন, সন্তানদের মানুষ করতে প্রয়োজন পেট ভরে তিনবেলা আহার আর সাথে কায়দা মতো একবেলা প্রহার। আমার মা অমল মাষ্টারকে বললেন, এই চাইর বান্দর আপনার হাতে তুইলা দিলাম। আমারে হাড্ডিগুলা দিয়া বুজাইয়া দিয়া গেলেই চলবে। অর্থাৎ সন্তানদের তিনবেলা আহারের কাজটুক আমি ঠিকমতোই করছি। এখন আপনার ভাগের প্রহারেরটুকু পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োগ করতে পারলেই ছেলেমেয়েগুলো একদিন হাতী ঘোড়া হয়ে বের হবে। আমার মায়ের ধারনা ছিল, পড়ানোর সময় মাষ্টারের চড়, থাপ্পড়, কানমলা, বেতের বারি এসব বিদ্যাচর্চারই একটা অংশ। কোন মাষ্টার যদি আমাদের না পিটাতেন তাহলে মা ভাবত, শিক্ষাদান খুব ধীর গতিতে চলছে। বেতের বারি হলো শিক্ষা নামের পালতোলা নৌকার পেছনে এক ইঞ্জিন। সে ইঞ্জিন যতো গর্জে উঠবে শিক্ষা তখন বেগে ছুটবে।
অমল স্যারকে বাহির থেকে দেখলে যে কেউ চট করে বলে বসবে, আহা এমন নিরীহ মাষ্টার জগতে বিরল। পড়ানোর সময় স্যারের মুখে কোন প্রকার উচ্চবাচ্চ, হৈচৈ শোনা যেতো না। কিন্তু আমরা কয়জন ছাত্রছাত্রীই শুধু জানতাম, জ্ঞানদানের সাথে কি নিদারুণ অত্যাচারই না করতেন এই মাষ্টার মশাই। তাঁর অত্যাচারের ধরনটা ছিল একটু ব্যাতিক্রম। তিনি বেত ব্যবহার করতেন না, কোন চড় থাপ্পড়ও মারতেন না। পড়া না পারলে প্রথমে খপ করে পেটের চামড়া টেনে ধরতেন। এরপর চোখ, মুখ বিকৃত করে, দাঁত খিঁচ দিয়ে সে চামড়া দুই আঙ্গুলে ডলতেন আর বলতেন, কি? কেমন? তখন মনে হতো পেটের চর্বি গলে প্রাণটা বুঝি বেরিয়ে গেলো। প্রচণ্ড ব্যাথায় যখন কেউ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠবে, ঠিক তখন পেটের চামড়ায় একটু ঢিল দিয়ে অত্যাচারের দ্বিতীয় পর্বটা শুরু করতেন। দ্বিতীয় পর্বে তিনি কানের কাছে মুখ এনে পিনপিন করে ভয়ঙ্কর ভাষায় কিছু বিষবাক্য ছাড়তেন। সে যন্ত্রণা পেটের চর্বি গলানোর চেয়ে কম ছিল না। অমল স্যারের গালিগুলো ছিল অদ্ভুত ধরনের। হাতী বন্দর, ঘোড়া বান্দর, অকাল কুসুমান্ড, বুরবাক, আজগাই বলদ, ধানী বলদ এই সব। প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকে তিনি আবার বিশেষ নামে ডাকতেন। প্রহারের সময় অত্যাচারের গতি বাড়াতে তিনি সেসব নাম ব্যবহার করতেন। আমাকে ডাকতেন মিচকা বান্দর। স্যার পেটের চামড়া ডলতে ডলতে বলতে থাকতেন, কি মিছকা বান্দর? আমার সঙ্গে চালাকি, হুহ? করবি আর চালাকি? এরপর শুরু করতেন অশ্রাব্য গালিগালাজ। সেসব শব্দ কানের মধ্যে দিয়ে একাবারে কলিজায় গিয়ে সূচের মতো বিঁধতো। সাপ শিকার পেঁচিয়ে ধরে প্রথমে প্রচণ্ড এক চাপ দেয়। সাথে কামড় দিয়ে বিষও ঢেলে দেয়। তীব্র চাপে শিকারের হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার পর যেটুকু প্রাণ অবশিষ্ট থাকে তা আবার বিষের জ্বালায় ছটফট করতে থাকে। অমল স্যার পেঁচিয়ে ধরলে আমাদের হতো সেই দশা।
জীবনে চলতে ফিরতে কতো মানুষের কাছেই তো কতো গালি, মার, লাথি, থাপ্পড়, কতো অপবাদ শুনেছি। তা সব ভুলেও গিয়েছি। কিন্তু পেটের চর্বি ডলতে ডলতে মিচকা বান্দর নামের যে অপবাদটি অমল স্যারের কাছ থেকে শুনেছিলাম তা মন ও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গিয়েছিল। এতো সব অত্যাচারের পরে আমরা মনে মনে কোন শাপ, অভিশাপ যে অমল মাষ্টারকে দিতাম না তা বলে আজ মহৎ সাজার চেষ্টা করবো না। আমাদের শিশু মন মাষ্টারকে জব্দ করতে ঠিকই নানান ফন্দি ফিকির খুঁজতো। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক পৃথিবীর মধুরতম সম্পর্কের একটা। সে সম্পর্কে হয়তো সাময়িক দুঃখ, কষ্ট, অভিমান থাকে। নাইলে ছাত্র মানুষ হবে কিভাবে? খনির হিরা অতি মূল্যবান কোহিনুর হয়ে ওঠে তাকেও অনেক কাঁটা ছেড়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয়।
কিন্তু কোন এক আষাঢ়ে সন্ধ্যায় অমল মাষ্টারের টর্চার সেলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মনে মনে বলেছিলাম, এই ব্যাটাকে চরম শিক্ষা না দিয়ে আমার যেন মরণ না হয়। বাসার সামনের বাঁশঝাড়ের তখন একটা তক্ষক ডেকে উঠেছিল, ঠিক ঠিক ঠিক। সেই সন্ধ্যায় শিশুমনের আকুতিটা এভাবে ফলে যাবে, কল্পনাও করতে পারিনি। এর কিছুদিন পরেই অমল মাষ্টারকে আমাদের বাসা থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়েছিল। তাঁর বিদায়ে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, তা আজও মন থেকে দুর হয় নাই।
আমাদের ছোট চাচা তখন এসেছেন আমাদের বাসায় বেড়াতে। ছোট চাচা তখন বয়সে তরুণ। বার দুয়েক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ফেল মারার পর একদিন উত্তেজিত হয়ে বললো, লাল্টু, মন্টুর মতো গাধারা লেখাপড়া না করেই পাশ। আর আমি করেছি ফেল! আমি কি কিছুই জানি না? জ্ঞান বুদ্ধি কি আমার এতোই কম? এই মাষ্টার জাতটাই যতো নষ্টের গোঁড়া। এগুলারে ঠ্যাঙ্গানো অতি আবশ্যক। কিন্তু যে মানুষ সব বিষয়েই ফেল করে সে কয়জন মাষ্টারকে ঠ্যাঙাবে? শেষে ঘোষণা দিলো, যেহেতু তাকে পড়ানোর মতো শিক্ষক এই শহরে অনুপস্থিত, তাই আপাতত তাঁর পড়াশুনা স্থগিত। পরের বছর আমার দাদু অনেক অনুনয় বিনয় করে পরীক্ষা দিতে পাঠালেন। সেবারও সফলভাবে তৃতীয়বারের মতো ফেল মারার পর দেশের পড়াশুনার মান ও পরীক্ষা পদ্মতির যে ভীষণ গলদ আছে সে বিষয়ে ছোট চাচা নিশ্চিত হলো। তারপর এসব বাজে সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে লেখাপড়ায় চিরতরে ইস্তফা দিয়ে ঘরে উঠলো। এরপর একদিন লাল, নীল রঙের জামা পড়ে, চিকন বেল বটমের প্যান্ট হাঁকিয়ে, চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে, কোমরে মোটা বেল্ট, গলায় রুমাল বেঁধে, মাথায় লম্বা লম্বা চুল উড়িয়ে কোন এক পার্টি অফিসে যোগ দিলো। ছোট চাচার আচার আচারন ছিল ষণ্ডা ধরনের। এখানে ‘ষণ্ডা’ শব্দটাই ব্যবহার করলাম। কারণ, নিজ চাচাকে তো আর গুন্ডা বলা যায় না। তিনি সব সময়ই মারমুখী একটা ভাব নিয়ে থাকতেন। পার্টি অফিসে প্রথম দিনেই কোন এক নেতাকে ঘুষিয়ে রক্তাক্ত করে পার্টি অফিস ছাড়লেন। ছোট চাচার সবচেয়ে প্রিয় যে কাজগুলো ছিল তা হলো ম্যাটিনি শোতে বাংলা সিনেমা দেখা, হাকিমপুরী ব্রান্ডের গুল খাওয়া আর মানুষ থাপড়ানো। কাউকে থাপড়ানোর পর অতি সহজে পাড় পাওয়া যায়, এমন খুব কম মানুষই ছিল যে তাঁর হাতের মার খায় নাই। আমার বাবা ছাড়া আর কাউকে কোনদিন ভয় পেতে দেখিনি। এই ছোট চাচা এলেন আমাদের বাসায় বেড়াতে। ছোট চাচা এলে আমাদের বাসায় আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো। কারণ, তিনি আমাদের প্রচণ্ড ভালবাসতেন। আমাদের সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। বেলায় বেলায় চালতা, বড়ইর আচার, কটকটি, চানাচুর, সন্দেশ, বিস্কুট, বাদাম নিয়ে আসতেন। আমার ছোট বোন টুনি ছিল তার জানের টুকরা। টুনিকে তিনি সারাদিন কোলে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। টুনিও ছোট চাচা ছাড়া কিছু বুজতো না।
অমল স্যার এমনিতে টুনিকে তেমন বকাঝকা করতেন না। সেদিন মনে হয় কোন কারণে স্যারের মেজাজ ছিল খারাপ। কি কারণে যেন টুনির গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলেন। আর অমনি টুনিও চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ ভ্যা ভ্যা করার পর যখন টুনির কান্নার বেগ কমে এসেছে ঠিক তখন ছোট চাচা ঘরে ঢুকল। ছোট চাচাকে দেখে টুনি যেন অভিমানে ফেটে পড়লো। সে কান্না আবার প্রথম থেকে শুরু করলো। কান্নার অনুযোগটা আসলে ছোট চাচাকে উদ্দেশ্য করে। তাঁকে লক্ষ্য করে যেন বলছে, দেখো আব্বু মেরে আমাকে শেষ করে দিলো। এর একটা বিহিত করো। ছোট চাচাকে আমরা ছোট চাচা ডাকলেও টুনি ‘আব্বু’ ডাকতো। টুনির কান্নার শব্দ শুনে ছোট চাচা পেছনে হাত বেঁধে গম্ভীরভাবে অমল স্যারের সামনে দিয়ে একবার মহড়া দিয়ে চলে গিয়েছে। অমল স্যার টুনিকে যতই বলছেন, এই চুপ! টুনি ততো উচ্চস্বরে চেঁচাতে লাগলো। স্যার ভীষণ বিরক্ত হয়ে আরেকটা চড় বসিয়ে দিলেন টুনির গালে। এবার টুনিকে আর পায় কে? সে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আব্বু’ ‘আব্বু’। ছোট চাচার মাথায় যেন হঠাৎ আগুন ধরে গেলো। সে মুহূর্তের মধ্যে ভিতরের রুম থেকে উড়ে এসে এক লাফে টেবিলের উপর উঠে অমল স্যারের কলার চেপে ধরলো। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, হ্লা, তুই টুনির গায়ে হাত তুললি? পড়াতে এসেছিস না কি গুণ্ডামি করতে আসছিস?
কথায় কথায় ‘শালা’ গালি দেয়াটা ছিল ছোট চাচার একটা রোগ। কিন্তু রেগে গেলে সে আর শালা বলতে পারত না, বলত হালা। আর অতি রেগে গেলে ‘হ্লা’ ‘হ্লা’ করত। অমল স্যারের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছোট চাচা বলতে লাগল, হ্লারপুত, এই দেখ মাস্তানি কারে কয়? বলে এ গালে ও গালে সমানে ঠাসঠাস থাপড়াতে লাগল। মার খেয়ে ছোট খাটো অমল মাষ্টার টেবিলের তলায় ঢুকে পড়লেন। ছোট চাচা কলার ধরে টেনে উপরে উঠিয়ে আবার শুরু করল। হৈচৈ শুনে মা ভিতর থেকে ছুটে এসে চিৎকার করে ছোট চাচাকে টেবিল থেকে টেনে নামালো। অমল স্যার তখন টেবিলের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন ‘কু’ ‘কু’ করছেন। সবাই মিলে স্যারকে টেবিলের তলা থেকে টেনে উদ্ধার করলাম। স্যারের জামার কলার ছিঁড়ে গেছে। ছেড়া কলার হাতে নিয়ে অমল স্যার কাঁপতে লাগলেন। ছোট চাচার কঙ্কালের মতো হাতের পাঞ্জার দাগ অমল স্যারের ফর্সা গালে লাল হয়ে বসে আছে। ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেলো। আমরাও হতভম্ভ হয়ে গেলাম। মা ছোট চাচাকে ভিতরে নিয়ে ভীষণ বকাবকি করতে লাগল। স্যারের কাছে বারবার হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল। বলল, রাতের খাবার খেয়ে যাবেন। আজকে বিশেষ রান্না আছে। অমল স্যার কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। ছাত্রছাত্রী সামনে এমন অপমান অমল মাষ্টার কেন, কোন মাষ্টারের ইহজীবনে আর হয়েছে কি না সন্দেহ। অমল স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর ধীরে ধীরে উঠে এক হাতে জামার ছিঁড়া কলার আরেক হাতে ছাতিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। জীবনে প্রথম আমরা স্যার চলে যাওয়ার পরেও টেবিল ছাড়লাম না। অনেক রাত পর্যন্ত হতভম্ভ হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।
পরেরদিন স্যার এলেন না। বাবা অমল স্যারের খোঁজে মেসে গিয়ে শুনলেন, তিনি মেসের কাউকে কিছু না বলে কাঁথা বালিশ নিয়ে কোথায় যেন চলে গেছেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর আর কোন সন্ধান মেলেনি।
অমল মাষ্টার বেঁচে আছে কি না জানি না। খুঁজে পেলে এ অপরাধের দায় থেকে মুক্তির একটা উপায় ঠিকই বের করতাম। কারণ, শিক্ষকের এতো বড় অভিশাপের দণ্ড মাথায় নিয়ে সুদীর্ঘ শিক্ষা জীবন পাড় করা বড় কঠিন। এরপর জীবনে যখনি লেখাপড়ায় লাড্ডু মেরেছি, তখনি মনে হয়েছে এ নিশ্চয়ই অমল মাষ্টারের অভিশাপের ফল। শিক্ষকরা কি ছাত্রদের অভিশাপ দেয়? মনে হয় না। অভিশাপ কাউকে দিতে হয় না। মানুষের অপরাধবোধই মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায়।