বিদ্যুৎ সংকটের এই সময় জাতীয় দুর্যোগের, হাসি তামাশার নয়

বিদ্যুৎ সংকটের এই সময় জাতীয় দুর্যোগের, হাসি তামাশার নয়

ফজলুল বারী: ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখন বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশ মাত্র পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে এখন আবার গরমকাল। বিদ্যুৎ না থাকলে গরমকালের কষ্ট যারা ভুলতে বসেছিলেন এই পরিস্থিতির  কষ্ট তারা বুঝছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরমে কর্মকর্তাদের স্যুট-কোট না পরতে বলেছেন।

কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকের ছবি যেটি পত্রিকায় এসেছে তাতে দেখা গেলো স্যুট-কোট পরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ছবি! কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। খরার সময় বাংলাদেশে বৃষ্টির জন্যে নামাজ-দোয়া হয়। বিদ্যুত না পেলে গালি হয়। কানসাট হয়েছিল বিএনপির সময়।

ইউক্রেনে হামলার শাস্তি দিতে রাশিয়ার তেল-গ্যাস সহ নানাকিছুর বিপননে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকার রাশিয়া সাইজ মিশনকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সাধারন মানুষ আজ সাইজ! বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর তেল-গ্যাস জ্বালানি সহ নানাকিছু কিনতে পারাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

জরুরি এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাল দিতে হবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া বাংলাদেশ কোন দিনই জাতীয় দুর্যোগে একসঙ্গে চলেনি বা চলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেশের সিংহভাগ মোল্লা-মৌলভী-জামায়াতে-নিজামে ইসলামীরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তারা এখনও এই সরকারের বিপক্ষে।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে উচ্চ জ্বালানি সংকট-মূল্যের চলতি পরিস্থিতি যুদ্ধকালীন জাতীয় দুর্যোগের চেয়ে কম নয়। কারন এরসঙ্গে খাদ্য সহ নিত্য ব্যবহার্য সবকিছুর দাম বেড়েছে। আরও বাড়বে। এখন যে সমস্যা দেখছেন, আগামী এক-দুই-তিন মাসে পরিস্থিতি আরও অনেক কঠিন হতে পারে।

বাংলাদেশ বরাবর বাইরে থেকে ডলারে বেশি দামে জ্বালানি কিনে এনে ভুর্তকি দিয়ে কমদামে দেশে বিক্রি করতে অভ্যস্ত এক দেশ। এরসঙ্গে চুরি-দুর্নীতি-অপচয়-অদক্ষতাতো আছেই। কিন্তু এখন বিশ্বের বাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম এত বেড়েছে যে বাংলাদেশের তা কিনে ভুর্তকি দিয়ে দেশের মানুষকে খুশি রাখাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু কঠিন এই সময়ে বাংলাদেশে একদল যেন এটিকে করেছে হাসি তামাশার বিষয়! বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন, এবার লোডশেডিং ইস্যুতেই সরকারের পতন ঘটে যাবে! আরেক নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন সরকার দেখন হুড়মুড় করে পড়ে যাবে।

এভাবে ইস্যু খুঁজতে খুঁজতে তেরটি বছর কেটে গেলো। তবুও যে সরকারের পতন ঘটলোনা। এবার এই ইস্যুতেও সরকারের পতন ঘটবেনা। এখনও কিন্তু সরকার চাইলে দেশজুড়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত-জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু এতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির যে দাম পড়বে তা কী ভোক্তারা দিতে পারবেন?

যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদের দেশের মানুষের আয় বেশি। ডলারে ঘন্টায় ২৫-৫০ ডলার আয়। তাই দাম যেটা যেখানে বেড়েছে তা সে সব দেশের মানুষজন সামাল দিতে পারছে। কিন্তু একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারগুলোর জনপ্রিয়তা কমছে।

বাংলাদেশের পজিটিভ দিক হচ্ছে সরকার সমস্যা লুকোয়নি। সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে কবুল করায় নানান ব্যবস্থা নেয়ায় প্রতিকার আসবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বক্ষনিক নেতৃত্বতো আছেই। এর কারনে বাংলাদেশ বিস্ময়করভাবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে।

এখন মসজিদে এসি থাকবে কি থাকবেনা এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাহাস হচ্ছে। এসি থাকবেনা বা এসি বন্ধ রাখতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাঁর বক্তব্য লাইভ সম্প্রচার করেছে। এখন একদল তা ধরে ট্রল শুরু করায় আরেকদল চিৎকার করে বলছে গুজব রটাবেননা!

নামাজ যখন চালু হয় তখন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা-বৈদ্যুতিক-পাখা-এসি এসব ছিলোনা। মরুর দেশে কষ্টের ভিতর চালু হয়েছে ইসলাম ধর্ম-নামাজ সহ নানানকিছু। আমাদের শৈশবে বাড়িতে-স্কুলে-অফিসে বিদ্যুৎ ছিলোনা। হাত পাখা ছিল জনপ্রিয় মাধ্যম। বিয়েতেও সেলাই করে ফুলতোলা পাখা উপহার দেয়া হতো।

স্কুলে-অফিসে বিশাল সব পাখার ব্যবস্থা ছিল। এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত! পাখা টানার লোক ছিল। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তো পাখা টানাওয়ালা! পাখা টানার লোকের পাঁচ-দশ টাকার বেতন শুনে আমরা আহ-উফ করতাম। এই প্রজন্ম অফিস-আদালত-স্কুলের সেই বিশাল সব টানা পাখা-পাখাওয়ালাও দেখেনি। ইতিহাস ভিত্তিক ছবি-নাটকে দেখে থাকতে পারে।

কুপি, মোমবাতির আলোয় আলোকিত হতো মসজিদ-মাজার। মসজিদে-মাদ্রাসায় পাখা দিয়ে বাতাস করা, ওস্তাদের গা টেপার সংস্কৃতি তখনকার। এখন আলোর ইশারায় অনেক কিছু ধরা পড়ছে। আগে অন্ধকার থাকায় ধরা সহজ ছিলোনা। এত সিসিটিভি ক্যামেরাও ছিলোনা তখন।

মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল-গরমে শীতে শীতাতোপ নিয়ন্ত্রিত। জেনারেটর-হ্যাজাক বাতিতে ওয়াজ মাহফিল-ওরস মাহফিল, যাত্রা-মেলার প্যান্ডেল আলোকিত করার বিষয়টিও হয়ে গেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কারনে বিদ্যুতের আলোর জগতে পা রাখে দেশ। ঢাকার রাস্তায় নিয়ন বাতিও এসেছে এরশাদ আমলে। বিএনপি আমলে কানসাটে কোন ঘটনা ঘটেনি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা ছাড়া খাম্বা শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন, কারও কারও নামের আগে খাম্বা বিশেষন যুক্ত করা ছিল মিডিয়ার সৃষ্টি!

এই সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মানের আগে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন তখন না করে উপায় ছিলোনা। কিন্তু এগুলো নিয়ে দুর্নীতিও হয়েছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের ধকল এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে দেশ।

এখন ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতির কারনে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন-সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় মসজিদের এসি নয়, সংকট হবে তৈরি পোশাক সহ নানাকিছুর উৎপাদন ব্যবস্থায়। কৃষিতে। কৃষি উৎপাদন ব্যয় বাড়াতে খাদ্যদ্রব্যের দাম আরও বাড়বে। বিদ্যুতে অভ্যস্ত মানুষের অসুখ-বিসুখ বেড়ে যাবে।

এই সময়ে দায়িত্বশীল লোকজনের কথাবার্তায় সাবধান হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস জরুরি পরিস্থিতিতে মসজিদের এসি বন্ধ রাখার জরুরি কথাটিই বলেছেন। এখন তাঁর কথাটিকে ব্লান্ডার মনে করলে তাকে না শাসিয়ে মানুষকে মিথ্যাবাদী বলে শাসাচ্ছেন কেনো!

অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও নামাজের পর মসজিদের বাতি-এসি সব বন্ধ করা হয়। চার্চ সমূহতো প্রার্থনার দিন ছাড়া খোলেইনা। এই দুর্যোগ মোকাবেলায়ও মানুষের পক্ষে থাকুন। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে পক্ষে রাখুন। এলাকা ভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং এর যথাযথ বন্টনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযথ প্রচার-শৃংখলার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আস্থায় রাখতে হবে মানুষকে।

মানুষকে দেখাতে হবে কষ্ট সবাই মিলে করছেন। গণভবন বা মন্ত্রিপাড়ায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ রেখে যদি আশেপাশের মানুষজনকে অন্ধকারে রাখেন তাহলে মানুষ ক্ষিপ্ত হবে। মানুষকে ক্ষিপ্ত করার লোকজন কিন্তু সক্রিয় থাকবে সারা সময়। মোটকথা সবকিছুতে মানুষকে আস্থায় রাখতে হবে।

সারাদেশ জুড়ে এত মডেল বানিয়েছেন, সেই সব মসজিদের উপকারভোগী ইমাম-মুয়াজ্জিন-মুসল্লিদেরও এই সময়ে সঠিক পরিস্থিতি বোঝাতে মানুষকে আস্থায় রেখে সংকট পাড়ি দিতে কাজে লাগান। সংকট সামাল দিতে বাংলাদেশের মানুষজনের কিন্তু অদভূত কিছু গুণ আছে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই পরিস্থিতিও উতরে যাবে বাংলাদেশের মানুষজন।