পার্থে নাটক “লাভ ইন কেরানীগঞ্জ” মঞ্চস্থ

পার্থে নাটক “লাভ ইন কেরানীগঞ্জ” মঞ্চস্থ

আবুহেনা ভুইয়া : গত মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পার্থে অনুষ্ঠিত হল নাট্য সপ্তাহ।  সপ্তাহান্তের ব্যবধানে তিন তিনটি নাটক ছিল পার্থবাসি বাঙালীদের জন্য বিরাট পাওয়া।একটি ছিল সম্পুর্ন নতুন প্রজন্মের শিল্পী দের নিয়ে। যাদের নিয়ে বিনির্মান হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশি- অষ্ট্রেলিয়া সমাজ৷ এই নাট্য সপ্তাহ আয়োজনের কৃতিত্ব পার্থের প্রবীন সংগঠন বাওয়ার।

‘লাভ ইন কেরানীগঞ্জ’  পার্থ প্রবাসী বাংলা থিয়েটারের একদশতম একক পরিবেশনা। মঞ্চস্থ হল ১৩ ই মে মারডক ইউনিভার্সিটির নেক্সাস থিয়েটারের প্রসেনিয়াম মঞ্চে।  এর আগে বাংলা থিয়েটারের ব্রেটল্ড ব্রেখট এর দেওয়ান গাজীর কেচ্ছা,  মহাত্তন মলিয়ের  কঞ্জুস এবং সর্বোপরি ২০২১ সালে তাদের নিজস্ব পরিচালনা ও পরিবেসনায় ‘অত:পর” নাটকগুলো  দর্শক  সমাদৃত হয়েছিল ।
‘লাভ ইন কেরানীগঞ্জ ‘ নাটকটি পাকিস্তানের তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাসিক ও নাট্যকার ফাইজা ইফতিখার এর অন্যতম সৃষ্টি  “প্রেম গলি’ র রুপান্তর। এই রুপান্তর করেছেন বাংলা থিয়েটারের কান্ডারী বাপি মাযহার। নাটকের নির্দেশনাও তারই।
লাহোরে জন্ম নেওয়া,  রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিত পাকিস্তানের তুমুল জনপ্রিয় নাটক ও টিভি সিরিজ রচয়িতা ফাইজা ইফতিখার।  যিনি টিভি সিরিজ রচনার জন্য মর্যাদাপূর্ণ লাক্স স্টাইল পুরস্কার পেয়েছেন। ফাইজা তার নাটকে সমাজের অচলায়তন গুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বাল্যবিবাহ,  বিধবাদের পুনর্বিবাহ, ধর্ষিতার মানষিক যন্ত্রণা ও সামাজিক দায়, বন্ধ্যাত্ব ও তার সামাজিক প্রভাব ইত্যাদি তার লিখার উপজিব্য। তিনি গাম্ভীর্য ও কমেডিকে আশ্রয় করে সামাজিক দায়- দায়িত্ব কে কষাঘাত করেন তার লিখায়।  দিল লাগি, আন জারা ইত্যাদি জনপ্রিয় টিভি সিরিজের রচয়িতা।  টিক বাটন নামে একটি সিনেমার গল্প তার অনবদ্য সৃষ্টি।
মঞ্চ নাটকের সুতিকাগার প্রাচীণ গ্রিসে নাটকের প্রচারণায় দুটি মুখোশ এর ছবি থাকতো প্রতিক হিসেবে। যার একটা কমেডি আর অন্যটা  বিয়োগান্ত নির্দেশ করতো। লাভ ইন কেরানীগঞ্জ নাটকটি প্রথম ধাচের। কুমারী  চুমকি ও তার বিধবা নানু, স্বামী পরিত্যক্ত খালা ও মাকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের গলিতে বসবাস করছে। বিবাহে ব্যর্থ পরিবার হিসেবে সামাজিক বৈষম্য সামাল দিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখছে। পরিবারের সবাই একমাত্র কুমারী মেয়ে চুমকির জীবন যেন বিবাহে ব্যর্থ না হয় তার চেষ্টায় ব্রত। এর পরই রংগমঞ্চে আবির্ভূত হয় হৃদয় ও তার বিপত্নীক দাদা, অকৃতদার চাচা, স্ত্রীবিহীন বাবা বাসা ভাড়া নিয়ে আসেন চুমকিদের পাশের বাড়ি।  হৃদয় এর দাদা চায় নাতিকে বিয়ে করাতে কারন একাকিত্বের অভিশাপ তিনি জানেন। হৃদয় আর চুমকির ভাললাগা আর ভালবাসার সাথে সমাজ ও পরিবারের নিয়মেয় সংঘাত থেকে বের হওয়ার কলা-কৌশল নিয়ে এগিয়ে যায় নাটক। বাংলা নাটকের ঘরানায় কমেডি নাটকের পরিনতি মিলনাত্মক হয়। এই নাটকেও তার ব্যতিক্রম নয়। মিলনের মধে দিয়ে সমাজ তার অচলায়তন ভেংগে এগিয়ে যায় এবং আবার নতুন সামাজিক গন্ডি তৈরি করে। এটাই সামাজিক রীতি।  তাই সমাজভেদে এর রীতি ভিন্ন হয়।
এই নাটকে মানুষের আবেগ ও আত্ব-সংযমের  দন্দ্ব হৃদয় ও চুমকির চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই সমাজ যেমন বিবাহ ব্যর্থতার সামাজিক দায়ভার মেয়েদের দিয়ে  বহন করায়,  আবার একই সংগে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অর্থনৈতিক সাচ্ছন্দ এর থেকে মুক্তির দিক নির্দেশ করে। যার উদাহরণ বাড়িওয়ালা লাইলি। অন্যদিকে  বিবাহ ব্যর্থতার সামাজিক দায় কিম্বা ভার কোনটাই পুরুষ বহন না করলেও পুরুষদের বহন করতে হয় তার একাকিত্ব।  নাট্যকারের মুন্সিয়ানা এটাই যে তিনি সামাজিক অচলায়তনের সাথে সাথে নৈর্ব্যক্তিক জীবনের গল্প দান্দ্বিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন। একদিকে সামাজিক অবমুল্যায়ন, অসচ্ছলতা, নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে চুমকিদের পরিবার। অপরদিকে পারিবারিক ও নৈর্ব্যক্তিক একাকিত্ব নিয়ে হৃদয় এর পরিবার। এ যেন তিন প্রজন্মের বিবাহ সংক্রান্ত সামাজিক ও নৈর্ব্যক্তিক বাধাকে অতিক্রম করার চেষ্টা।
বাংলা সাহিত্যে নাটককে বলা হয় দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়। দৃশ্য গুলো ভালো বলেই যথেষ্ট লম্বা হয়া সত্বেও এই নাটক দর্শকদের ধরে রাখতে পেরেছে। প্রতিটি দৃশ্যেই চরিত্র গুলো যেন সংযোগ করেছে দর্শকদের সাথে। নাটকের সংলাপ ছিল দারুণ ও মঞ্চোপযোগী। শ্রব্য কাব্যের যথোপযুক্ত ব্যবহার মঞ্চ নাটককে সবকিছু থেকে  আলাদা করে থাকে। যেমন এই নাটকেও সংলাপ প্রক্ষেপনে দাদা  চাচা, চুমকির মা ও লাইলি বেগম নজর কেড়েছেন।   মঞ্চসজ্জা ভালো ছিল। পোশাক সজ্জা ও সাজ সজ্জা বাহুল্য বর্জিত ছিল । অভিনয়ে চুমকির মা হিসেবে সোহেলা সিলভি চমৎকার অভিনয় করেছেন। সংলাপের মাঝে আবেগ এবং গাম্ভীর্য ধরে রেখে কমেডি করা সত্যি কঠিন।  যা তিনি অনায়াসে করে গেছেন। লাইলি চরিত্রে ফারাহ ওবায়েদ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। কন্ঠশৈলী ও অভিনয় এ পারংগমতার ছাপ রেখেছেন।  চুমকি চরিত্রে শামা ও হৃদয় চরিত্রে অভিষেক এর অভিনয় চরিত্র উপযোগী ছিল। এছাড়াও প্রিয়ংকর, সুমি, সোয়েব ভাল করেছেন।
এই নাটকের বিশেষত্ত হল চরিত্র গুলোর আলাদা আলাদা গল্প যা তাদেরকে পরিপূর্ণ  করেছে। আবার প্রতিটি গল্পই এক একটি সামাজিক কিম্বা নৈব্যক্তিক অচলায়তনকে নির্দেশ করে। যা এই রচনাকে উচ্চ মার্গে নিয়ে যায়। বাংলা থিয়েটারের এই পরিবেশনাকে সাধুবাদ জানাই। ঢাকায় যখন প্রতি ৪০ মিনিটে একটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে তখন এই নাটক অবশ্যই সময়োপযোগী। প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্যেও