‘বাংলাদেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কাজ করতে চাই’  -অধ্যাপক ডা. রেজা আলী  

‘বাংলাদেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কাজ করতে চাই’  -অধ্যাপক ডা. রেজা আলী  

অধ্যাপক ডা. রেজা আলী

অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি চিকিৎসকদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন পরিচিত একটি নাম অধ্যাপক ডা. রেজা আলী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বর্তমানে সিডনির ব্ল্যাকটাউন হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্তব্যরত। দীর্ঘ বছর ছিলেন এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পরিচালক। তাঁর নেতৃত্বে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের প্রিমিয়ার অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেছে। একই সঙ্গে তিনি অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি চিকিৎসকদের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল সোসাইটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। বাংলাদেশের জরুরি সেবার মানোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন তিনি। এ নিয়ে অধ্যাপক ডা. রেজা আলীর সঙ্গে সিডনিতে কথা বলেছেন কাউসার খান।

প্রশ্নঃ জরুরি সেবা একজন রোগীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

রেজা আলী: জরুরি সেবা একটি হাসপাতালের প্রধান প্রবেশদ্বার। এই জায়গাতেই যদি সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যায়, তাহলে পরে অনেক জটিলতা, বাড়তি চিকিৎসা ও খরচ এড়ানো সম্ভব। জরুরি সেবার মাধ্যমে রোগীকে ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। আবার প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাবে সেবার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আর মূল পার্থক্যটা হলো একজন চিকিৎসক হয় হার্ট অ্যাটাক অথবা পেটব্যথা যেকোনো একটা ধরে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু একজন প্রশিক্ষিত জরুরি সেবার চিকিৎসক দুটি অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে সেবা দিতে সক্ষম। আর জরুরি সেবা চালুর পর থেকে উন্নত বিশ্বেও রোগী মৃত্যুর হার কমেছে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের জরুরি সেবার পরিস্থিতি এখন কেমন আর কতটুকু উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করছেন?

রেজা আলী: বাংলাদেশের জরুরি সেবার সাংগঠনিক রূপ নেই, নেই কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণপদ্ধতি। জরুরি সেবার জন্য চিকিৎসকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, সেটা নামমাত্র, যা মানসম্মত নয়। তাই বাংলাদেশে চিকিৎসক যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও জরুরি সেবা কীভাবে দিতে হবে, এই সঠিক ধারণার অনেক কমতি রয়েছে। ফলে চিকিৎসকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত শিক্ষার মাধ্যমেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে। কার্ডিওলজি বা সার্জারির একটা কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকে একটি কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিতে নিয়ে আসাটাই এখন আসল কাজ। আমাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর এর ফলাফল পরের দিনই পাওয়া যাবে না, সময়ের প্রয়োজন হবে। আর তখন বাংলাদেশি সেবাগ্রহীতারা সুফল ভোগ করতে পারবেন, পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।

প্রশ্নঃ জরুরি সেবার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

রেজা আলী: সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে আমি জানার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশে এখন কী আছে, কতটুকু পরিবর্তনের প্রয়োজন এবং শূন্যস্থান কতটুকু। আমি দেখেছি আমরা অস্ট্রেলিয়ায় জরুরি সেবার জন্য যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করি, এর প্রায় সবই রয়েছে বাংলাদেশে। আর আমাদের বাংলাদেশের চিকিৎসকেরাও যোগ্য। আমি শূন্যস্থান পেয়েছি শুধু প্রশিক্ষণের। একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট একটি প্রশিক্ষণ পদ্ধতি চালু করতে পারলেই বাংলাদেশের জরুরি সেবার মান অস্ট্রেলিয়াআমেরিকার পর্যায়ে চলে আসতে পারে।

প্রশ্নঃ আপনার উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে পারে বলে আপনার মনে হয় কি?

রেজা আলী: আমি আমার পেশাগত দিক থেকে বলব, বাংলাদেশের জরুরি সেবাকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসাটা খুব বেশি কষ্টের হবে না। কিন্তু এতে দরকার কিছু সদিচ্ছা আর লেগে থাকা। পাঁচছয় বছর যদি আমরা লেগে থাকতে পারি, তাহলে মানোন্নয়ন সম্ভব। যেমন আমি লেগে আছি ১৫ বছর ধরে, চাই বাংলাদেশে সঠিক জরুরি সেবাকে পরিচয় করিয়ে দিতে। চিকিৎসক, কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন সবাইকে এক টেবিলে এনে যদি বোঝানো যায় ‘ইমার্জেন্সি মেডিসিন কারিকুলাম ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ এবং সবার সম্মতি হলে চালু করা সম্ভব। আর তখন কয়েক বছর পর ঢাকা মেডিকেল হোক আর গ্রামের সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ হোক, রোগী কতটা উন্নত চিকিৎসা পাবে, তা অকল্পনীয়।

প্রশ্নঃ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত জরুরি চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। আপনি কীভাবে এই সমস্যাটিকে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থায় অবদান রাখার পরিকল্পনা করছেন?

রেজা আলী: শুরুতেই আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আর এই প্রকল্প শুরু করতে বিদেশ থেকে সহযোগিতা আনতে হবে, যেটা কঠিন কিছু নয়। প্রথমে আমরা পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে দুএকটা হাসপাতাল দিয়ে কাজ শুরু করতে পারি। প্রশিক্ষকেরা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা এমন দেশ থেকে আসতে পারেন। দুই বছরের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম দিয়ে আমরা যে চিকিৎসকদের গড়ে তুলব, তাঁরাই তখন পরবর্তী প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ‘ট্রেইন দ্য ট্রেইনার’ প্রকল্প দিয়ে আমরা যে কয়টি হাসপাতাল ও জরুরি বিভাগ প্রশিক্ষিত করব, তারা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে যাবে।

প্রশ্নঃ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণে উৎসাহিত করতে কী পরিকল্পনা রয়েছে?

রেজা আলী: দেশের একজন চিকিৎসক যখন এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করবেন, এর জন্য অবশ্যই তাঁকে কিছু বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে সরকারি পদক্ষেপ থাকতে হবে। একজন চিকিৎসকের দুই বছর প্রশিক্ষণ করার পর কী হবে, এই চিন্তা তাঁর যেন না করতে হয়। যেমন কেউ কার্ডিওলজি নিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে স্পেশালিস্ট কার্ডিওলজিস্ট হতে পারেন। এ জন্য যদি এমন করা যায় যে জরুরি সেবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কনসালট্যান্ট হতে পারবেন, পরিচালক হতে পারবেন, তখন একজন চিকিৎসকের একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর উৎসাহ তৈরি হবে।

প্রশ্নঃ আপনি অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা চিকিৎসকদের একরকম নীরবেই প্রশিক্ষিত করে যাচ্ছেন, যা প্রথম আলো ছুটির দিনের প্রচ্ছদে প্রকাশের পর ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে আপনি কীভাবে ভাগ করার পরিকল্পনা করছেন?

রেজা আলী: অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করার একটি সংস্কৃতি রয়েছে, এটা বাংলাদেশে তেমন একটা চর্চা হয় না। নতুনদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা, অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এগুলো আমরা করে থাকি। এই ধরনের মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, সাপোর্ট প্রোগ্রাম বাংলাদেশেও আছে, তবে সর্বজনীনভাবে সবাইকে অভ্যস্ত করাতে পারলে আমাদের আগামী হবে আরও উন্নত। এ ছাড়া চিকিৎসক হিসেবে রোগীর দায়িত্ব নেওয়ার যে মানসিকতা অস্ট্রেলিয়ায় আছে, এটাও আমি বাংলাদেশে প্রচলনের পরিকল্পনা করেছি।

প্রশ্নঃ আপনার পরিকল্পনা সফল করে তুলতে আপনি সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো সহযোগিতা আশা করছেন কি?

রেজা আলী: জরুরি সেবার প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে চালু করতে সরকারের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। আর যে চিকিৎসকেরা প্রশিক্ষণ নেবেন, তাঁদের সুবিধাটিও সরকারের পক্ষ থেকে আসতে হবে। এ ছাড়া জরুরি সেবাকে যদি একটি স্বাধীন উপবিশেষত্ব হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া যায়, তাহলে এর মান অনেক বাড়বে।

প্রশ্নঃ আপনি বললেন আপনি অনেক বছর লেগে আছেন, এত বছরের আপনার চেষ্টায় আপনি কি কোনো প্রতিবন্ধকতা পাচ্ছেন?

রেজা আলী:নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আসলে সবারই সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু সবাইকে এক টেবিলে এনে আলোচনা করা, একটা সিদ্ধান্তে আসা কিছুটা কঠিন, এটারই একটা অভাব পাচ্ছি। ‘রাইট টাইমে, রাইট পারসন’ পাচ্ছি না। বাংলাদেশে জরুরি বিভাগের উন্নয়নে নিজের তাগিদে কাজ করার মতো লোক খুঁজছি আমি।

প্রশ্নঃ জরুরি সেবার বাইরে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত নিয়ে আপনার আর কোনো পরিকল্পনা আছে কী, যা সুযোগের অভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না?

রেজা আলী: বাংলাদেশের নার্সিং সেবার মানোন্নয়নে আমাদের করার অনেক কিছু রয়েছে। নার্সরা চিকিৎসকদের সহকর্মী। কিন্তু বাংলাদেশে একজন নার্স কতটুকু যোগ্য এবং তাঁর প্রাপ্য সম্মান তিনি পাচ্ছেন কি না, তা ভাবনার বিষয়। এ জন্য নার্সদের নিয়েও আমার একটা প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা রয়েছে। আবার তাঁদের মধ্যে কেউ অস্ট্রেলিয়ায় এসে এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলেও একদিকে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মান বাড়বে অন্যদিকে নার্সদেরও সম্মান বাড়বে।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের মানোন্নয়নের ভাবনার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণা কী?

রেজা আলী: আমরা যাঁরা বিদেশে এসে কাজ শিখেছি, কাজ করছি, আমাদের সবারই ইচ্ছা থাকে যে দেশের জন্য কিছু একটা করার। আমি যেহেতু জরুরি সেবাতেই ক্যারিয়ার গড়েছি, নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কাজ করি, সে জায়গা থেকেই বাংলাদেশের জরুরি সেবার মানোন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। আর আমি বাংলাদেশে জন্মেছি, বড় হয়েছি, সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছি, আমার বাবা একজন সার্জন ছিলেন, তাঁর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। দেশকে এখন কিছু ফেরত দিতে চাওয়াটাই বড় অনুপ্রেরণা।