লারকানা হাউজ ৭১: অনেক তথ্য অজানা

লারকানা হাউজ ৭১: অনেক তথ্য অজানা

অনলাইন ডেস্কঃ বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল একমাস আগে। আর সেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাড়ি লারকানা হাউজে। তখন পাখি শিকারের কথা বলে বৈঠক ডেকে তিনি লারকানাতেই ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তানি জেনারেলদের নিয়ে। ইতিহাসবিদ আর গবেষকরা বলছেন- লারকানার সেই ষড়যন্ত্রের এখনও অনেক কিছু অজানা। তবে এটা নিশ্চিত যে বাংলাদেশে গণহত্যার পরিকল্পণা প্রথম জুলফিকার আলি ভুট্টোর মাথা থেকেই আসে।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন একটি রাজনৈতিক দলের(পাকিস্তান পিপলস পার্টি) প্রধান হলেও গণহত্যার প্রথম পরিকল্পনা তিনিই করেন। তিনি ইয়াহিয়াকে শিকারের কথা বলে তার নিজ বাড়ি লারকানা হাউজে নিয়ে যান। সেখানে আরও কয়েকজন জেনারেলও গিয়েছিলেন। সেই বৈঠকেই বাংলাদেশে গণহত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’ নামে বিস্তারিত পরিকল্পনা করে তা বাস্তবান করা হয়।”
এছাড়া পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার বইয়ে লারকানা হাউজ ষড়যন্ত্র নিয়ে কিছুটা তথ্য পাওয়া যায়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা টিব্রিউনকে বলেন ‘যতটুকু জানা যায়, সেসময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো লারকানায় ‘পাখি শিকার’ করতে আমন্ত্রণ জানান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে। আর সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লারকানায় ভুট্টোর বাড়িতে ইয়াহিয়া, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ, প্রধান স্টাফ অফিসার লে. জে. এসজিএমএ পীরজাদাসহ আরও পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা একত্রিত হন। সেখানেই বাংলাদেশে গণহত্যার প্রথম পরিকল্পনা হয়, যা পরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিনগত মধ্যরাতে।’

বাঙালি হত্যার এ পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল আহসান এবং ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সম্মত হননি। তাই তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এর আগে বেসামরিক মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাখি শিকারের কথা বলে ভুট্টো জেনারেলদের লারকানা হাউজে ডেকে একমাস আগেই যে গণহত্যার পরিকল্পনা করেন তা পাকিস্তানি অনেক সাবেক সামরিক কর্মকর্তার স্মৃতি কথাতেই উঠে এসেছে। কিন্তু এ নিয়ে তারা বিস্তারিত কিছু লেখেননি। আমরা যা জানি তা তাদের স্মৃতি কথা থেকেই। তবে এটা নিশ্চত যে- লারকানা ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নই হলো ‘অপারেশন সার্চলাইট।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে একযোগে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয় ঢাকার তখনকার বিডিআর (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। তারা গোলা নিক্ষেপ করে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে, হামলা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি এলাকায়। ইতিহাসের এই নির্মম নিধনযজ্ঞ সেই রাতেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে, বাংলাদেশে। ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নারা।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যা ষড়যন্ত্রে যারা অংশ নিয়েছিলেন সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল হামিদ মনে করেছিলেন, ‘২০ হাজার মানুষ হত্যা করলেই ভয় পাবে বাঙালি, স্বাধীনতা এবং স্বাধিকারের কথা আর বলবে না।’
কিন্তু ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই রাজারবাগ থেকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
শাহরিয়ার কবির জানান, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম রাজা ও গুল হাসান খান তাদের আত্মজীবনীমূলক বইয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর কথা বলেছেন। কারা এই গণহত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের নামও লেখা হয়েছে খাদিম রাজার ‘স্ট্রেঞ্জার ইন ওন কান্ট্রি’ বইটিতে। আর পাকিস্তান সরকার নিজেই মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ক্রাইসিস ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে। তাতে একপেশে তথ্য পরিবেশন করা হলেও গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝা যায়।’1971BookKhadim
১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছিল। হামিদুর রহমান কমিশনের ওই রিপোর্ট সরকারিভাবে কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু রিপোর্টের অনেক তথ্যই এখন জানা যায়। তাতেও ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের গণহত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ ও টিক্কা খানকে দায়ী করা হয়। আর তদন্ত রিপোর্টে ৯ মাসের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মেজর(অব.) শামসুল আরেফিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লারকানা ষড়যন্ত্র নিয়ে অনেক কথা হলেও তেমন কোনও গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ফলে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনও অপ্রকাশিত। তবে গবেষণা হতে পারে। আমরা শুধু জানি বাঙালি নিধনের প্রথম পরিকলল্পনা হয় লারকানা হাউজে।’
শাহরিয়ারর কবির বলেন, ‘লারকানা হাউজ ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া কঠিন। কারণ কেউ প্রমাণ রেখে ষড়ন্ত্র করে না। তবে উদ্যোগ নিলে হয়তো আরও তথ্য জানা সম্ভব।’
আর অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে বসে সেই ষড়যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা এখন বেশ কঠিন। পাকিস্তানের কেউ করলে তার জন্য সহজ হবে। তবে গবেষণা প্রয়োজন। আমি মনে করি, বাংলাদেশে গণহত্যার অজানা অধ্যায় আছে লারকানা ষড়যন্ত্রে। ইতিহাসের জন্য হলেও এই গবেষণা প্রয়োজন।’

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাঙালি নিধনের প্রথম পরিকল্পনা হয়েছিল যে লারকানা হাউজে, ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল ফাঁসিতে মৃত্যুর পর সেখানেই জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দাফন করা হয়। ( সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউনে)