ফজলুল বারী :খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, প্যারোলে মুক্তি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। এ নিয়ে আজ কিছু সরাসরি কথা লিখবো। খালেদা জিয়া অসুস্থ সত্য। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে যখন প্যারোলে মুক্তির কথা বলেন তখন বুঝতে পারি সরকার তাকে এভাবে মুক্তি দিতে চাচ্ছে। খালেদা জিয়ার বন্দী জীবন নিয়ে সরকারের প্রতিদিন ব্যয়ও কম হচ্ছেনা। নানা কারনে বিএনপি এখন একটি বিষন্ন, হতদ্যম দল। একেক নেতা একেক কথা বলেন। খালেদা জিয়া খুব অসুস্থ, মারাত্মক অসুস্থ এমন নানান কথা বললেও অসুস্থতার কারন-চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে তারা দেশের মানুষকে সত্য বলেননা। খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে তাদের হাতে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা খোলা পথ নেই। দলনেত্রীকে যদি তারা সুস্থ করতে চান, আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে চান এ ব্যাপারে বাস্তব সিদ্ধান্তটি তাদের নিতে হবে দ্রুত। সিদ্ধান্ত নিতে হবে খালেদা জিয়াকেও। এবং তা নিজেদের বাস্তব অবস্থা মাথায় রেখে। মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দল দুটির কোনটাই রামকৃষ্ণ মিশন অথবা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মতো সেবা সংস্থা না। রাজনৈতিক দল নিজেদের ভালোমন্দ চিন্তা-হিসাব করে সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের আচরন করবে এটা ভেবে বসে থাকাটা ভুল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের মতো আচরন করেনি। আওয়ামী লীগের আমলে খালেদা জিয়া জেলে আছেন। বিএনপির আমলে তারা শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
যে দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে এগুলোর উৎস সময় বিএনপির ১৯৯১-৯৬’র শাসন সময়। সাবেক সামরিক আইন প্রশাসক স্বামীর সেনানিবাসের বাড়িতে তখন খালেদা জিয়া থাকতেন। সেনা গোয়েন্দা সংস্থাই এসব মামলার কাগজপত্র তখন গুছিয়ে রেখেছিল। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন তারা এসব কাগজপত্রের হদিশও পায়নি। সেনাবাহিনী যখন রাজনীতিকদের জব্দ করতে কিছু কোথাও জমা রাখে তা নিজেদের জন্যেই রাখে। কোন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে দেয়না। এটাতো সেনাবাহিনীকে দেয়া জিয়ার শিক্ষা! ‘আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স’! রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী তথা জিয়ার কী ক্রোধ!
বিএনপির জন্মতো সেই সামরিক ঔরসেই। এরপর খালেদা জিয়ার বিএনপি ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এতিমখানা তৈরি বা টাকাগুলো যে খাতে এসেছিল সে খাতে ব্যবহারের কোন উদ্যোগও তারা নেয়নি। হয়তো এ টাকার কথা খালেদা ভুলেই গিয়েছিলেন! ক্ষমতায় থাকলে চারদিকে এত টাকা আর টাকা! কোনটা মনে রাখবেন! যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা ভাবে চিরজীবনের জন্যে এসেছে। এটা এখন বিএনপি আওয়ামী লীগকে বলে। যেটা বিএনপি তখন নিজেদের সেভাবে ভাবতো বলেই এতিমখানা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি। সেনাবাহিনী কিন্তু পুরো বিষয়কে চক্ষে চক্ষে রেখেছে। কারন কাগজপত্রে এতিমখানার ঠিকানা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি। যেখানে শুধু থাকতেন তারেক-কোকোর মতো দুই বনেদি এতিম। এসব দেখেশুনে ১/১১’এর সামরিক সরকার মামলাটির গুরুত্বপূর্ন অস্ত্র করেছে। তৈরি অস্ত্রে শিকার করেছে আওয়ামী লীগ। কে কোথায় এমন তৈরি শিকার ধরিতে না ভালোবাসে!’
এতিমখানা দুর্নীতিকে জায়েজ করতে একদল উষ্মা প্রকাশ করে বলেন যেখানে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে সেখানে দুই-আড়াই কোটির জন্যে খালেদা জিয়ার মতো একজন তিন বারের প্রধানমন্ত্রীকে জেল দেয়াটা বাড়াবাড়ি। এই উষ্মার জবাব বিএনপির আইনজীবীরা ভালো জানেন। এতো বাঘা বাঘা সব আইনজীবী বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক দলে নেই। জিয়া-খালেদার বেস্ট কালেকশন। আইনজীবীরা জানেন ডকুমেন্টেড ছোট টাকার দুর্নীতি প্রমান করা সহজ। হাজার হাজার কোটি টাকা প্রমান করা কঠিন। কারন টাকা কোন বৈধ চ্যানেলে বিদেশে যায়না। তারেক-গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিদেশি ব্যাংকের টাকার খোঁজ দিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন আদালতের মাধ্যমে জানা না গেলে বাংলাদেশ সরকার ওই খবর জানতোইনা। শেখ হাসিনার মামলা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে বলে এটা হয়েছে।
বিএনপি ক্ষমতায় এলে শেখ হাসিনাকে জেলে পাঠিয়ে খালেদার মামলা প্রত্যাহার করতো। কেউ ফেরেস্তা না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে বেহিসেবি অভিযোগ আনা হয়েছিল ওই টাকা নিতে ট্রাক লাগতো। আর মামলায় ট্রাকের জায়গায় লেখা হয়েছে সুটকেস। এরজন্যে আদালতে তা টেকেনি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ডকুমেন্টেড, ব্যাংক হিসাবের নথি জব্দ করে আদালতে দেয়া হয়েছে। এরজন্যে এই মামলা দুটিকে বিলম্বিত করতে খালেদার আইনজীবীরা কতবার সময় নিয়েছিলেন, মামলার তারিখ দেখে হরতাল দেয়া হয়েছিল, তা কী ভুলে যাওয়া হয়েছে? আইনজীবীরা হয়তো আশায় ছিলেন এভাবে দেরি করতে করতে বিএনপি ক্ষমতায় এসে যাবে, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে তা খারিজ করিয়ে নেয়া যাবে বিএনপি ক্ষমতায় এসে গেলে! কিন্তু ‘আশায় আশায় দিন যে গেলো, আশা পূরন হলোনা।‘ বিএনপি যে ক্ষমতায় আসেনি। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ ‘আর দুষ্টুমি করেনা পুতুল’ বলে খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে এ আশা কী শিশুতোষ নয়? আর খালেদা জিয়াই বা শেখ হাসিনার বুকে মাথা ঠেকবেন কেনো! তিনি কী এতোই ছোট? বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র মানুষদের ৫ হাজার টাকার ঋন শোধ না হলে ঘরের চাল খুলে নেবার নজির আছে। এই দরিদ্র লোকটিই হয়তো খালেদার কোটি টাকার দুর্নীতিতে জেলে থাকা নিয়ে উফ-আহ করে কাঁদে। রানী ভক্ত প্রজা জাতি।
খালেদার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপি নেতারা দেশের মানুষের সঙ্গে সত্য বলেননা। সেজেগুজে থাকলেও খালেদাতো একজন সত্তুরউর্ধ বয়স্কা নারী। যিনি বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। সর্বশেষ ‘ফিরোজা’র মতো বাড়িতে থাকতেন। তাঁর মূল অসুস্থতা আর্থাইটিজ এবং ডায়াবেটিস। আর্থাইটিজ তথা গেঁটে বাত বাংলাদেশের সিংহভাগ বয়স্ক নারী-পুরুষের আছে। জেলখানাগুলোতে এমন কয়েকশো বন্দী পাওয়া যাবে। এর চিকিৎসা বাংলাদেশে যা অস্ট্রেলিয়াতেও তাই। আর্থাইটিজ রোগীকে শুরুতে পেইন কিলার টেবলেট, ইনজেকশন এবং ফিজিও থেরাপি চিকিৎসা দেয়া হয়। সর্বশেষ চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। খালেদার এই সর্বশেষ চিকিৎসা তথা একাধিক অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। এখন মূলত ইনজেকশন, পেইন কিলার-ফিজিও থেরাপির মাধ্যমে আর্থাইটিজ নিয়ন্ত্রনে রাখা ছাড়া আর কোন চিকিৎসা তার নেই।
খালেদা জিয়ার আর্থাইটিজ সমস্যা কেনো বেড়েছে তা ব্যাখ্যা করে বলি। এর জন্যে ডাক্তার হবার দরকার নেই। এটি মূলত মানসিক এবং পরিবেশগত। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা যখন ব্যথা-বেদনার সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে যাই তখন ডাক্তার সবার আগে জানতে চান কোন কারনে রোগীর মন খারাপ কিনা। রোগী দুশ্চিন্তা করেন কিনা। ভালো ঘুম হয় কিনা। খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এখন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী হিসাবে কারাগারে আছেন। পাইক পেয়াদা সহ যত বনেদি বন্দিনীর মতো রাখা হোক, কারাগারতো আর ফাইভ স্টার হোটেল নয়। ফিরোজা’ও নয়। তিনি ছিলেন হিন্দি সিরিয়ালের পোকা একজন দর্শক। কারাগারে নিশ্চয় তার সে সুযোগ নেই। নিশ্চয় এসব নিয়ে সারাক্ষন তাঁর মন খারাপ থাকে। ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চয় তিনি দুশ্চিন্তা করেন। তার ভালো ঘুম না হওয়া স্বাভাবিক।
এসব কারনে তার আর্থাইটিজের সমস্যাটি বেড়েছে এবং দিনে দিনে তা শুধু জটিল হচ্ছে। ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনের গুরুত্বপূর্ন হলো হাঁটাহাঁটি। ‘ফিরোজা’য় থাকতে খালেদা জিয়া পর্যাপ্ত হাঁটতেন কিনা জানিনা। এখনতো জেলখানাতে তাঁর হাঁটার সেই পরিবেশও নেই। খুব স্বাভাবিক এর কারনে তার ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। আমার ধারনা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা ওষুধ দিয়ে তাঁর ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁকে হাঁটতে হবে। সম্ভবত সে সামর্থ্যও তাঁর এখন নেই। জেলখানায় যাবার আগেও হাঁটাচলায় তাঁর সহায়তা লাগতো। ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রনে না থাকলেও কোন ওষুধেও তার রোগ সারবেনা। এসব সমস্যা নিয়ে খালেদা জিয়া জেলখানায় যত বেশি সময় ধরে থাকবেন তত তাঁর সমস্যাগুলো বাড়বে। ইউনাইটেড হাসপাতালে নিলে সেখানে এসব সমস্যা সমাধানের জাদুকরি কোন পথ্য নেই। খামোখা ইউনাইটেড ইউনাইটেড জপে জপে বিএনপি নেতারা এ যাবত হাসপাতালটির যত প্রচার দিয়ে ফেলেছেন-দিচ্ছেন এরকারনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তারা মোটা অংকের বিজ্ঞাপন বিল দাবি করতে পারেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যে সব সুযোগ সুবিধা আছে তা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। সেখানে চিকিৎসার সুযোগ পেতে বাংলাদেশের হাজার হাজার রোগী প্রতিদিন হাপ্যিতাস করেন। ক্ষমতায় না থাকলেও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেনতো, তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালকে তিনিও গোনায় ধরেননা। বিএনপি নেতারা যেন ভুলে না যান একজন বন্দিনীর চিকিৎসা কোথায় হবে সে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। বন্দী যদি নিজের ইচ্ছায় ইউনাইটেড বা যে কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কী তা অনুমোদন করবে? যদিও জানি এরপরও বলা হবে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে কেনো সবার সঙ্গে এক কাতারে ফেলা হচ্ছে! আপনাদের এ চিন্তাটাও বর্নবাদী। আপনারা সারাক্ষন জনগনের কথা ভাবেন বলেন, কিন্তু নিজের বেলায় ভাবেন আপনারা জনগনের কাতারের কেউনা! সরি।
এখন খালেদা জিয়াকে মুক্ত পরিবেশ দিতে পথ তিনটি মুখস্ত প্যারোল, জামিন এবং আন্দোলনে সরকারকে বাধ্য করা। আন্দোলনে বাধ্য করার সামর্থ্য আপনাদের নেই। কারন আপনাদের সবাই একেকজন বিশিষ্ট অজুহাত মাষ্টার। সরকার এই দেয় না সেই দেয়না। আপনার দুধের শিশু না যে সরকার গরম দুধ ফিডারে খাওয়াবে। এটা আপনারাও খাওয়াননি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলেও তাই করবেন। জামিনে খালেদা জিয়ার মুক্তি আদায়ে ব্যর্থতা আপনাদের আইনজীবীদের। বলবেন সরকার এই দেয়না সেই দেয়না, বাধা দেয়, সরকার খারাপ। আবার বলি খালেদা জেলে থাকায় আপনারা যে ছ্যারাবেরা হয়ে গেছেন সরকার সে সুযোগ কেনো কাজে লাগাবেনা। সরকারতো রামকৃষ্ণ মিশন না। জাতির পিতার হত্যাকান্ডের বিচার আটকে রেখেছিলেন মনে আছে? কাজেই আপনারা অন্তত আইনের শাসনের গান গাইবেননা। এসবই কিন্তু বাংলাদেশের সরকার। এখন সরকার চাইলে একমাত্র প্যারোল খালেদা জিয়ার আশু মুক্তির পথ। প্যারোলে মুক্তি শর্ত সাপেক্ষ হয় বলে এটি আপনারা খুব স্বাভাবিক চাইছেননা। খালেদা জিয়াও চাইবেননা। কিন্তু এসব ডিম আগে না মুরগি আগে এসব ভেবে ভেবে যত দেরি করবেন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। জীবনহানির আশংকাও আছে। অতএব বল এখন বিএনপির কোর্টে। প্রতিপক্ষের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে সরকারতো বলেই রেখেছে বিএনপি চাইলে আমরা খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিতাম।