ফজলুল বারী: ধান-চালের দাম নিয়ে দেশে অস্বাভাবিক বিব্রত একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের চড়া সুরের একটি রাজনৈতিক বক্তব্য হচ্ছে ন্যায্যমূল্যে সার দাবি করায় কৃষকদের গুলি করে হত্যা করেছে বিএনপি সরকার। আর আওয়ামী লীগ কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করেছে। অনেকদিন ধরে এই বক্তব্যটি আর দেয়া হচ্ছেনা। কিন্তু ফসলের ন্যায্যমূল্য দাম না পেয়ে কৃষক যখন ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে তখন এর পিছনে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।! এই খাদ্যমন্ত্রীটা কে? ইনি একজন বিশিষ্ট চালকল মালিক। যে চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে দেশের কৃষকদের বঞ্চনা আর খাদ্যশস্যের দামবাড়ানোর সিন্ডিকেট পরিচালনার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে বিমান মন্ত্রনালয় দেয়া হয়নি। কারন তার তখন ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবসা ছিল। দুনিয়া জুড়ে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তত্ত্বে এটিই অনুসরনীয় নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশে যে নিয়মটি ভেঙ্গে পড়েছে তা চালকল মালিককে খাদ্যমন্ত্রী করাটা এর দৃষ্টান্ত।
তৈরি পোশাক শিল্প বা প্রবাসীদের রেমিটেন্স ঘিরে যত গালভরা পরিসংখ্যান দেয়া হোক না কেনো এখন পর্যন্ত কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রান। ধান-ফসল ভালো হলে দেশ-মানুষ-অর্থনীতি-সরকার ভালো থাকে। একবার ধান-ফসল ভালো না হলে সরকারের সব সুনাম শেষ। পারিপার্শ্বিক নানা সমীকরনে দেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার এর কৃতিত্ব নেয়। কিন্তু আদতে বাংলাদেশের কৃষিতে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নেপথ্যে সরকারের অবদান কম। কৃষকের অবদান বেশি। কারন কৃষক তার কাজ শতভাগ আন্তরিকতা সহ করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সিংহভাগ কৃষি কর্মকর্তা চাকরি রক্ষা এবং নানান কিসিমের টুপাইস কামানোর ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন বেশি।
উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির কারনে দেশে সব ধরনের ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। ধান ছাড়ও পাট-গম-ভূট্টা-আখ-তামাক সহ যার যেখানে সম্ভব তা চাষ করেন কৃষকরা। যশোর অঞ্চলে ফুল চাষের বিপ্লব ঘটেছে। এক সময় এক ফসলের পর আরেক ফসলের আগ পর্যন্ত মাঠ খালি থাকতো। দেশে এখন সে অবস্থা আর নেই। মাঠ কখনো খালি থাকেনা। সব্জি চাষের বিপ্লব ঘটেছে দেশজুড়ে। সারা বছর ধরেই প্রায় সব ধরনের সব্জি পাওয়া যাচ্ছে সারাদেশে। এভাবে কৃষক-কৃষিই এখনও দেশের প্রানভোমরা। দেশে সেই কৃষকদেরই এখন মরনাপন্ন অবস্থা!
কৃষি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। সাইফুর রহমান বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সংসদে তার বিতর্কিত বক্তব্য ছিল দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হলে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবেনা! আওয়ামী লীগ দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ন করার নীতি নেয়। কারন এখন সেই পুরনো কালের বিদেশি সাহায্য পাবার যুগ নেই। বাংলাদেশের সে দরকারও এখন নেই। আওয়ামী লীগ আমলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হয়েছে এটি সরকারের গর্বের একটি দাবি ছিল। কিন্তু সেই দাবিটির এখন কী অবস্থা?
এবার মতিয়া চৌধুরীকে বিদায় করে একজন কৃষিবিদ দেখে আব্দুর রাজ্জাককে কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছে। ইনি আবার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামেরও সদস্য। আর দেশের কৃষক যখন ফসলের দাম না পেয়ে ক্ষেতে আগুন দিচ্ছে তখন এই কৃষিমন্ত্রী বলছেন, ‘উন্নত বিশ্বের কৃষকরাও এমন প্রতিবাদমূলক নানাকিছু করে’! ‘তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষকদের আত্মহত্যার কোন ঘটনা নেই’! ‘যদি এখন হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের ক্ষতি হতো তাহলে কী করা যেতো’! ‘এবার আমরা কৃষকদের জন্যে কিছু করতে পারবোনা, আগামীতে করবো’! কি ভয়ংকর সব নির্লিপ্ত কথাবার্তা দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের কৃষিমন্ত্রীর! তার এসব কান্ডজ্ঞনহীন ঘৃতাহুতিমূলক বক্তব্যের পর দেশজুড়ে তখন প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন কৃষিমন্ত্রী বলছেন কৃষকদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে!
এর মানে তারা আস্তেধরে সিটিং দিয়ে মিটিং করবেন এরপর ব্যবস্থা নেয়া হবে! ততক্ষনে কৃষক শেষ মানে ফতুর! এটা কী দেশের কোন কৃষিবান্ধব রাজনৈতিক সরকার বা এর মন্ত্রীর বক্তব্য হতে পারে? জবাবদিহির তাগিদ থাকলেতো এতোক্ষনে এই কৃষিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হতো বা লজ্জাশরম থাকলে তিনি পদত্যাগ করে চলে যেতেন। বাংলাদেশের মন্ত্রীদের লজ্জাশরম থাকে কম। এমন পরিস্থিতির দায় নিয়ে কোন মন্ত্রী কোনদিন পদত্যাগের কোন নজির নেই। প্রতিটি কৃষি মৌসুমেই বাংলাদেশের কৃষকদের অসহায় অবস্থার প্রকাশ ঘটে। এবার সেই অসহায়্ত্ব সীমা ছাড়িয়েছে। এক বিঘায় ধান চাষে কৃষকদের গড়ে খরচ হচ্ছে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। আর ফসল বিক্রি করে কৃষক ৬ হাজার টাকাও পাচ্ছেনা।
বাংলাদেশের ফসলের বাজারের চোরাগোপ্তা অবস্থাটা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। প্রতিবার সরকার ধান-চাল কেনার একটি ঘোষনা দেয়। কিন্তু প্রতিবারই সরকারি দরের সুযোগ সুবিধা নেয় ফড়িয়া ব্যবসায়ী, মিল মালিকরা। এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী মিল মালিকরা আবার যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারিদল করে। সে হিসাবে এখনকার সব মধ্যস্বত্ত্বভোগী আওয়ামী লীগার। মিল মালিকদেরতো এখন একজন খাদ্যমন্ত্রীও আছেন! আর সরকার দাবি করে তারা কৃষকবান্ধব! তা আপনাদের বন্ধু কৃষক নিঃস্ব ফতুর হয়ে মরে গেলে আপনারা বন্ধুত্ব করবেন কার সাথে? না শ্লোগান বদলে নতুন শ্লোগান লিখবেন আমাদের সরকার ফড়িয়া ব্যবসায়ী-মিল মালিক বান্ধব!
একটা কথা আমি আমার বিভিন্ন লেখায় লিখি। তাহলে বাংলাদেশে একমাত্র পেশাজীবী গোষ্ঠী যারা তাদের কাজে কখনো ফাঁকি দেয় না সে হলো কৃষক। ফসলের দাম পাক বা না পাক চাষবাস সে করবেই। কারন তার সংসারের পোষ্যদের জন্যে চাল লাগে। পাট সহ নানাকিছু লাগে। আমাদের কৃষকরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তাদের কাজটা মনোযোগের সঙ্গে করে। বীজ, সার, কীটনাশক সহ নানাকিছু বাকিতেও কেনে। বড় আশায় থাকে ফসল ভালো হলে তা বিক্রি করে বাকির শোধ দেবে। কিন্তু কার্যত তারা ফসলের দাম না পেয়ে দিনে দিনে শুধুই নিঃস্ব হয়। এভাবে দিনে দিনে পরিণত হয় ভূমিহীন কৃষকে। আর রাষ্ট্র বক্তৃতায় বানীতে তাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলে উপহাস করে।
এবার ধান-চালের দাম নিয়ে কৃষক বিরোধী একটি পরিস্থিতির মধ্যে কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে তার মন্ত্রনালয়ের বিশৃংখল অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। ধান ভালো হলে কিভাবে কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার মতো দাম দিতে হবে এ নিয়ে মন্ত্রনালয়ের আগাম প্রস্তুতি থাকবেনা? তাহলে তার মন্ত্রনালয়ের কাজ কী? বক্তৃতাবাজি করা? এখন বলা হচ্ছে আলুর দাম নিয়েও একই পরিস্থিতি হবে! তাহলে আলু চাষীদের ন্যায্যমূল্য দিতে তার মন্ত্রনালয়ের প্রস্তুতি কী? ঘোড়ার ঘাস কাটা? এখন বলা হচ্ছে কৃষককে দাম দিতে খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করা হবে। এতে নাকি কৃষক উপকৃত হবে! কৃষকতো এরমাঝে শেষ। এখন বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে কী দলের ফড়িয়া ব্যবসায়ী মিল মালিকদের উপকৃত করার ধান্ধা? মন্ত্রী যখন চাল রপ্তানির বাগাড়ম্বর করছেন তখনও কিন্তু দেশে বিদেশ থেকে চাল আমদানি হচ্ছে! দেশের কোন তথ্যই কী মন্ত্রীদের কাছে নেই?
খাদ্য রপ্তানি নিয়ে বাংলাদেশের কথাবার্তায় আমার ভয়ও করে। কারন ধান্ধাবাজ কৃষি ব্যবস্থাপনার কারনে আমাদের সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমানের খাদ্যশস্য মজুদ থাকেনা। এক মওসুমে ফসল ভালো হয়েছে তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন অবস্থা। পরের মওসুমে দেখা গেলো প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসল ভালো হলোনা। তখন শুরু হয় খাদ্য আমদানির প্রক্রিয়া! তখন ব্রাজিলে গিয়ে কেনা হয় পচা গম! বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ক্রটি সমূহ চিহ্নিত করে টেকসহ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোন উদ্যোগ নেই। কারন রাজনৈতিক সরকার এখানে দূর্নীতিবাজ আমলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত। নানা সিদ্ধান্ত হয় দলীয় ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের হৃষ্টপুষ্ট করার জন্যে। ফতুর কৃষক শুধুই ফতুর হয়।
বাংলাদেশের এতো টাকা যে দেশ নিজের টাকায় পদ্মাসেতু বানায়, আকাশে স্যাটেলাইট পাঠায় কিন্তু দেশের কৃষক বাঁচাতে জরুরি উদ্যোগ কেনো নেই? কেনো কৃষকের কান্নার মঞ্চের দূরে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীরা ষড়যন্ত্র খুঁজতে বেশি প্রতিভা দেখান? কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘এইবার না পরেরবার’! না ফতুর কৃষককে দশ টাকা সের চাল খাইয়ে প্রচার প্রপাগান্ডায় তারা বেশি পটু? প্লিজ সাফ সাফ কথা বলুন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান। চলতি পরিস্থিতি কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় দেশের কৃষকহত্যা কর্মসূচি ছাড়া আর কিছু নয়। আপনাদের কৃষকলীগ সহ নানান সংগঠন, এত লাখ লাখ নেতাকর্মী এদের কেউ এখন আর কিন্তু কৃষকবান্ধব নয়। কৃষক বান্ধব হলে কিন্তু এই সংগঠনগুলো দেশের বিপন্ন কৃষকদের পক্ষে গিয়ে দাঁড়াতো। একদিন আওয়ামী লীগের পরিচয় ছিল দেশের প্রধান তৃণমূল সংগঠন। এখন সে অবস্থাটা কী টুটে গেছে? কৃষক কী দেশের তৃণমূলের প্রান নয়? আওয়ামী লীগকে সতর্ক করছি। কৃষক না বাঁচলে কিন্তু আওয়ামী লীগ, এই সরকার এর কিছুই বাঁচবেনা। সরকার না বাঁচলে আপনারা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী এসব উদযাপন করবেন কী করে?