ফজলুল বারী:আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কী এখনও রিপোর্টারদের সঙ্গে রাতে আড্ডা দেন? এক যুগেরও বেশি সময় আগের কথা লিখছি। প্রতি রাতে ঢাকার সোনারগাঁও, ইন্টারকনে (তখনকার শেরাটনে) পছন্দের রিপোর্টারদের সঙ্গে প্রাক ডিনার আড্ডায় বসতেন জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সেখানে বসেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলতেন দেশের কী খবর বলোতো ফজলুল বারী! যেন ভাবখানা এমন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দেশের কোন খবর জানেননা! তেমন এক আড্ডায় মানিক মিয়া পুত্র এক রাতে বলেছিলেন, দেশেতো শেখ হাসিনা ছাড়া কোন রাজনীতিক নেই! তিনি কিছুদিন পরপর একটি রাজনৈতিক চাল চালেন! সেটি নিয়ে আমরা কিছুদিন লাফাই! এভাবে লাফাতে লাফাতে টায়ার্ড হয়ে গেলে তিনি নতুন আরেকটি চাল চালেন! দেশের নানা সময়ে আমার আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা মনে পড়ে।
এই মূহুর্তে দেশে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে সিনিয়র সক্রিয় এবং সর্বক্ষনিক রাজনীতিক! একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের সরকার প্রধান এবং দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের প্রধান। অনেক রাজনীতিক দেশে আছেন। কিন্তু তাদেরকে ব্যবসা-নানান কামাইর ধান্ধা অথবা রুটি রুজির যোগাড় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। শেখ হাসিনা সারাক্ষন রাজনীতি এবং দেশ পরিচালনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘আমারতো আর কোন কাজ নেই। তাই সারাক্ষন দেশের কাজই করি।‘ প্রধানমন্ত্রী কেনো সবকিছু করবেন, তাহলো এত মন্ত্রীর দরকার কী? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এমন একটি জবাব দিয়েছিলেন এক সংবাদ সম্মেলনে। আমি দেশের নানাকিছুতে সারাক্ষন শেখ হাসিনার নানা কার্যক্রম অনুসরন, তাঁর বড ল্যাঙ্গুয়েজ দেখি। উত্তর পেয়ে যাই। আমি দেখি একজন আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্রনায়ককে। যিনি তাঁর বিবেকের কাছে স্বচ্ছ-স্পষ্ট।
এবং আমি শেখ হাসিনাকে একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসাবেই দেখি। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্নাসিনী তিনি নন। দেশের জন্যে তিনি যা করতে চান এরজন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দরকার। তাঁকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা চান তারা ফেরেস্তা নন। তারাও বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৭ সাল থেকে আমি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতার ভিতরের বাইরের লোকজনকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। ক্ষমতায় থাকা সাধু-চোর প্রায় সবাইকে চিনি জানি। ক্ষমতার বাইরে থাকা সবাইও সাধু নন। ক্ষমতায় থাকতে তাদের অনেকে এত কামিয়েছেন যে কয়েক পুরুষ ধরে বসে খেতে পারবেন। এসব নানান হিসাব-নিকাশ শেষে শেখ হাসিনা আমার কাছে মন্দের ভালো। তিনি নিজে সব লোভ-দুর্নীতির উর্ধে। এটা প্রমান করে তাঁর বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ। একজন মানুষ নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ হলেই এমন দৃঢ়ভাবে কথা বলতে পারেন। তবে তাঁর কাজের স্টাইলটি হলো দলীয় দুর্নীতিবাজ অনেককে তিনি ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। সবাইকে গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখিন করেননা। এ নিয়ে তাঁর প্রতি আমার অনেক ক্ষোভও জমা আছে। তবে নিজের দলের যত লোকের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ব্যবস্থা নিয়েছেন, এটিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নজিরবিহীন।
এখন এ লেখা যে উদ্দেশে সে প্রসঙ্গে আসি। প্রায় তিন যুগ ধরে শেখ হাসিনাকে অনুসরন করে করে আমার ধারনা হয়েছে শেখ হাসিনা যেভাবে জনগনের মনের ভাষা পড়তে পারেন, সময়ের গত প্রকৃতি বুঝতে পারেন তা দেশের রাজনীতিকদের সিংহভাগ তা পারেননা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধানের যা খুশি পরিবর্তনের অবস্থা করার মতো অবস্থা আওয়ামী লীগের ছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কমিটি সেভাবেই কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা ভেতর থেকে বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে বুঝতে পারেন। তাই সুরঞ্জিত সহ ওই কমিটির লোকজন যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তাদের যে তালিম দেন, পরে সেভাবেই সবকিছু চলে। সংবিধানে জিয়ার বিসমিল্লাহ এরশাদের রাষ্ট্র ধর্ম রেখেই বলা হয় ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা। বাজার অর্থনীতিতে অটল থাকলেও সংবিধানে আবার লেখা হয় সমাজতন্ত্র! এসব জখাখিচুড়ি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা জানেন তাঁর বাবা-মা, ভাই-ভাবী সহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ধর্মের দোহাই হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ওই অবস্থায় শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনানিবাসে চলে গিয়েছিলেন। বিডিআর বিদ্রোহের সুযোগে কী করার চেষ্টা হয়েছিল তা ওয়াকিফহালরা জানেন। বেগম জিয়া চলে গিয়েছিলেন আত্মগোপনে। একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মতো করে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে সবকিছু সামাল দেন।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফেরার পর তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম গণআন্দোলন ছিল মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলের আন্দোলন। সেখানে বিমান বন্দর করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। আমি তখন লিখেছিলাম একদিন আড়িয়াল বিল থাকবেনা। গোটা এলাকায় বাড়িঘর হয়ে যাবে। কিন্তু বিমান বন্দর হলে বদলে যাবে গোটা এলাকা। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা মানুষের আন্দোলনের বিরুদ্ধে জেদাজেদি করেননি। এলাকার মানুষ যখন চাইছেনা তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে স্থগিত করেন সেখানে বিমান বন্দর নির্মানের সিদ্ধান্ত। দশ বছরে পরে এসে সে এলাকাতেই জনমত গড়ে উঠেছে নতুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পক্ষে। দশ বছর আগের আড়িয়াল বিলও আর সেখানে নেই।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপি দেশে বিশেষ একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পেট্রোল বোমায় একের পর এক মানুষ মারা হচ্ছিল। রাস্তাঘাটে পুলিশ মারা হচ্ছিল। পরিস্থিতির কারনে শাসকদলের অনেকে ভয়ও পেয়ে যান। সরকার সমর্থক একটি টিভি চ্যানেল লন্ডন থেকে সম্প্রচারের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সাহস এবং দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেন। ঠিক একইভাবে হেফাজতের শাপলা চত্বর অভিযান, কোটা আন্দোলন, ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন এসবও শেখ হাসিনা সামাল দেন একক দৃঢ়তায়। বিশ্বব্যাংকের শঠতাপূর্ন অবস্থানের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা এখন একজন বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। নানান প্রতিবন্ধকতা, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ অগ্রসরমান অর্থনৈতিক শক্তি। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ-কৃষক-শ্রমিক লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তনে যে পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন তা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের চিন্তার বাইরের ঘটনা।
গত নির্বাচনের আগে তিনি রাজনৈতিক সংলাপ, নিজের মতো করে নির্বাচনও করেছেন। বেগম জিয়াকে কারাগারে নিয়ে গেলে কী যে হয় এমন ভয় ছিল ক্ষমতাসীনদের অনেকের। শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন দেশের মানুষের কাছে তাঁর প্রতিপক্ষ অথবা বিকল্প কেউ নেই। প্রতিপক্ষ বিকল্প কেউ থাকলে মানুষকে পথে নামাতে দাওয়াত দিতে হয়না। মানুষ পথে নামলে তিনি যে তাকে গুরুত্ব দেন তা কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে এর প্রমান দিয়েছেন। বিএনপির ব্যর্থতা তারা কোনভাবে মানুষের আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি।
করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে মুজিব বর্ষের কর্মসূচি নিয়ে জেদাজেদিতে না গিয়ে আবার রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচয় দিয়েছেন শেখ হাসিনা। নরেন্দ্র মোদী আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু এবার দিল্লীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবার মোদীর সফরের বিরুদ্ধে দেশের ধর্মীয় সংগঠনগুলো দেশে বিশেষ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলে। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বড় বড় সমাবেশ হচ্ছিল। এরপরও সরকার চাইলে এর ভিতরেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে মুজিব বর্ষের প্রধান কর্মসূচি সম্পন্ন করে ফেলতে পারতো। কিন্তু এরমাঝে দেশে করোনা ভাইরাসের রোগী পাওয়া যাওয়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শে নিজে নিজেই আপাতত কর্মসূচি পালন থেকে সরে আসে। এতে মোদীর সফরের বিরুদ্ধে সক্রিয়রা বৈদ্যুতিক শক খাবার মতো থ’ বনে যায়। বাংলাদেশ সরকার কর্মসূচি স্থগিত করার ভারত সরকার মোদীর সফর বাতিল করেছে। দুই সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলো হয়। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন বিদেশিরা সফর বাতিল করছে দেখে সরকার করোনা রোগীদের তথ্য প্রকাশ করেছে! বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্য ভারতেও গেছে। এভাবেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে পরাজয় ঘটে মির্জা ফখরুলদের। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সেই কথাটি আবার বেদবাক্যের মতো কানে বাজে! বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছাড়া কোন রাজনীতিবিদ নেই!