ফজলুল বারী:করোনা ভাইরাস সংক্রমন আতঙ্কে কাঁপছে সারা বিশ্ব। কে কিভাবে এই মহামারী থেকে বাঁচবেন সেই চেষ্টাই সবার। এখন পর্যন্ত এই সংক্রমন থেকে আত্মরক্ষার পথ হলো পরিচ্ছন্নতা, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা। এই মহামারী থেকে কেউ আপনাকে বাঁচিয়ে দেবেনা। নিজে নিজেকে বাঁচাতে হবে। কারন চিকিৎসায় বিদেশে যে সব নিশ্চয়তা আছে তা বাংলাদেশে নেই। আপনার হাত পরিষ্কার রাখবেন, আপনি পারলে একা থাকবেন, একজনের সঙ্গে আরেকজনের দূরত্ব হবে কমপক্ষে দেড় মিটার। পারলে সব সময় মাস্ক ব্যবহার করবেন। কারন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ এক বক্তব্যে বলা হয়েছে এই জীবানু এখন বাতাসেও ভাসছে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জীবানু কখন আপনি স্পর্শ করছেন তা আপনি নিজেও জানছেননা।
বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোতে অনেক দিন আগে থেকেই হাত ধোয়ার বিজ্ঞাপনগুলো প্রচারিত হয়ে আসছে। এগুলোয় বাচ্চাদের হাত পরিষ্কার রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। কাজেই আমাদের এই রোগ মোকাবেলার একটা প্রস্তুতি আছে। কিন্তু করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে হাত পরিষ্কার রাখতে হবে শুধু বাচ্চাদের না। সবার। নোংরা হাতে নাক, চোখ, মুখে স্পর্শ করা যাবেনা। দেড় মিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে কাশির শিষ্টাচারও বজায় রাখা সম্ভব। করোনা মোকাবেলার এই সহজ পথগুলো বাংলাদেশে কিছু লোকজন খামখেয়ালির মাধ্যমে কঠিন করে ফেলেছেন! এখনও সতর্ক হলে দেশের মানুষকে বাঁচানো সম্ভব। তবে নির্দেশনা আসতে হবে সরকারি একটি কেন্দ্র থেকে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কেউ যাতে আলাদা করে কোন নির্দেশনা না দেন। এসবের প্রচারও প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে হবে।
আজ আমি একটি সরকারি প্রজ্ঞাপন পেয়েছি। তাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল গুজব ছড়ায় কিনা তা মনিটরিং এর জন্যে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব ভুল পদক্ষেপ। টেলিভিশন গুজব ছড়ায়না। কোন রাজনৈতিক-ধর্মীয় নেতা উদ্দেশ্যমূলক কিছু করলে তাদের ধরুন। টিভি চ্যানেলকে না। কিছু পত্রিকার ভূমিকা ভালো নয়।
বাংলাদেশে রোগটি দেশে নিয়ে এসেছেন প্রবাসীরা। এই প্রবাসীরা বিদেশে কষ্ট করে দেশের জন্যে অনেক অর্থ সহ ইতিবাচক নানাকিছু নিয়ে আসেন। এবার এনেছেন বিপদ! চীন থেকে রোগটি যে সব দেশে প্রথম যায় তা রেষ্টুরেন্ট-বার-ক্রুজের মাধ্যমে যায়। চীন লকডাউনের মাধ্যমে নিজের নাগরিকদের মাধ্যমে এটি ছড়াতে দেয়নি। বিভিন্ন দেশ বিশেষ বিমানের মাধ্যমে নিজের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে গিয়ে রোগটিও নিয়ে আসে নিজের দেশে। বিদেশে বাংলাদেশিদের বড় অংশ রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা-চাকরির সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকে অবৈধভাবে ওই সব দেশে গেছেন।
সেখানেও সুযোগ পেলে তারা আইন মানতে চাননা। দেশে এলেও আইন মানেননা। দেশে এসে তাদের অনেকে তথ্য গোপন করে বিয়ে সহ নানান সামাজিক অনুষ্ঠানেও গেছেন। বিয়েও করেছেন অনেকে। মূলত প্রবাসীদের এই অংশের কিছু সদস্যের খামখেয়ালি আচরনের মাধ্যমেই মহামারী রোগটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এটি ছড়াচ্ছে তাদের মাধ্যমে যারা এই ভয়াবহ বিপদের ঝুঁকির মধ্যেও ঘোরাঘুরি বন্ধ করছেননা! সবাইকে ঘরে আটকে রাখা গেলে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ার বিপদ কমবে। মা তার ছেলেকে আটকান। স্ত্রী আটকান স্বামীকে। নতুবা কিন্তু কেউ বাঁচবেননা। এটাই লকডাউন। আমরা এখন পারিবারিক লকডাউন চাই।
গত কয়েকদিন ধরে যারা গাদাগাদি বাড়ি গেছেন তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে। এদের মাধ্যমে এখন এটি গ্রামজনপদে আরও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন সরকার লকডাউন ঘোষনা না করে ছুটি ঘোষনা করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে। এবার যে লকডাউন শব্দটি বিপুল ব্যবহার হচ্ছে এর আদিনাম আসলে কার্ফু। বাংলাদেশে নিকট অতীতে কার্ফুর অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বিদেশে লকডাউন যে সব শহরে জারি হয়েছে সেগুলোয় লোকজন রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা কম করে। নিজের গাড়ি-বাইক বা গণপরিবহনে চলে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে বিপুল সংখ্যক লোক রাস্তায় থাকেন। লোকজনের রিকশা-ঠেলাগাড়ি সহ নানান বাহনে হাত দেয়া দেয়া যায়না। এম্বুলেন্সে মিথ্যা ঘোষনা দিয়ে লোকজন চলে। এখন মালবাহী ট্রাকেও বিস্তর লোকজন যাতায়াত করছেন। পুলিশ সহ নানা বাহিনীর সদস্য, কয়েকশ মিডিয়া কর্মীদের বেশিরভাগ নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব মানছেননা। শুধু ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী নন, এরাও কিন্তু আক্রান্ত হতে পারেন। এদের মাধ্যমেও মহামারী রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এরমাঝে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা বলা শুরু করেছেন মসজিদ বন্ধ করা যাবেনা। যে সব দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে পারছে তাদের যে কমান্ড আছে তা বাংলাদেশের নেই। লকডাউন করতে গেলে মসজিদ মন্দির সহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। সৌদি আরবও বন্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় বলা হয়েছে বিয়েতে ৪ জন, শেষকৃত্যে ১০ জনের বেশি লোক থাকতে পারবেনা। এরজন্যে এখানে মসজিদ-গির্জা সহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নামাজ পড়া বন্ধ হয়নি।
মানুষকে ঘরে রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নাগরিকদের জন্যে নানান প্যাকেজ সহায়তার ঘোষনা দিচ্ছে। এটা এর আগে এমন বিশ্বের দেশে দেশে দেখা যায়নি। কারন এই মহামারীর অর্থনৈতিক ভোগান্তি হবে দীর্ঘমেয়াদী। অস্ট্রেলিয়া দেশটির বেকার নাগরিকদের আগামী ছয় মাস প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশি টাকায় কুড়ি হাজার টাকার মতো করে দেবে। আমেরিকার মতো দেশও যে পরিমান অর্থ বরাদ্দের ঘোষনা দিয়েছে এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। এভাবে সবার টার্গেট নাগরিকদের ঘরে রাখা। কোথাও কোন ভিড় সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে রোগটি না ছড়ায়।
বাংলাদেশ মূলত গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে যে অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষনা দিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য। সামর্থ্যবানরা তুলনামূলক দূর্বলদের জন্যে কে কী করবেন সে প্রস্তুতি নেয়া উচিত। রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলোর যার যার কর্মীদের রক্ষার কর্মসূচি নেয়া উচিত। জেলা-উপজেলা-পৌরসভা সহ স্থানীয় নেতৃত্বকে সরকারের দিকে না তাকিয়ে জানানো উচিত কে কী করবেন। দুনিয়া জুড়ে সবাই ব্যস্ত কে কিভাবে রোগ থেকে বেকারত্ব থেকে বাঁচবেন। বাংলাদেশের লোকজনের ব্যস্ততা বাড়ি যাওয়া নিয়ে। বাড়ি যাওয়াকেই এখনও বেশি নিরাপত্তার বোঝেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকজন। বিপদে আপদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা থাকতে চান। বাড়ি যারা পৌঁছে গেছেন তারা অন্তত নিকটজনের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলুন। একজন আরেকজনকে রোগটি ছড়িয়ে দেবেননা প্লিজ।