ফজলুল বারী: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বিজেপির মতো সরকার ক্ষমতায় ছিলোনা। এরপরও তখনও আজকের মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলো বাংলাদেশ চায়নি। শুধু চায়নি নয়, এরা তখন সশস্ত্রভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। অথচ সত্তুরের নির্বাচনে তাদের পক্ষে কোন রকম গণরায় ছিলোনা। এখনও কোন নির্বাচনে তারা তাদের কর্মকান্ডের পক্ষে গণরায় পায়নি। তখনও তারা নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে জোর জবরদস্তি করার অপচেষ্টা করেছে। এখনও করছে।
নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা পুরনো পাকিস্তানি রোগের নতুন রূপ। পাকিস্তানপন্থী মোল্লাদের বিরোধিতা স্বত্ত্বে একাত্তরে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো তখন অনিচ্ছার মধ্যে তারা বাংলাদেশ মেনে নেয়। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল তারা লন্ডনে অথবা পাকিস্তানে-মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যায়। গণপিটুনিতে নিহত হয় তাদের অনেক নেতা-কর্মী। অনেকে আত্মগোপন করে অথবা গ্রেফতার হয়। অনেকে ভাসানী ন্যাপ-জাসদ এসব সংগঠনের সঙ্গে মিশে যায়। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। তখন থেকে বাংলাদেশ পিছন হেঁটে মুখে বাংলাদেশ বললেও অন্তরে পাকিস্তানের পক্ষে ফিরে যায়।
রেডিও-টিভি সহ সবকিছুতে জয় বাংলার জায়গায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চালু হয়। জিয়াউর রহমান দল গঠন উপলক্ষে দালাল আইন বাতিল করে গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দেয়। তাদের অনেকে জিয়ার বিএনপিতে যোগ দেয় বা যার যার জামায়াত সহ নিজস্ব রাজনৈতিক দলে। জাসদে, ভাসানী ন্যাপে যারা যোগ দিয়েছিল তারা বিএনপিতে যোগ দেয় অথবা ফিরে যায় যার যার দলে। এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলে বেড়েছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের সামাজিক-রাজনৈতিক ঔদ্ধত্ত্য। একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও মুক্তিযুদ্ধের অনেক মৌলিক জায়গায় ফিরতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে পর্যাপ্ত সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছাড়াই আওয়ামী লীগ দূর্বলভাবে ক্ষমতায় ফেরায় জাতীয় পার্টি-জাসদের(রব) সমর্থনে সরকার গঠন করে। এরপর আবার যখন ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ফিরলে অবশিষ্ট আওয়ামী লীগকে ধংস করতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের সব নেতাদের হত্যার চেষ্টা হয়। অতঃপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও দেশকে পুরোপুরি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে পারেনি। এরমাঝে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক চেহারায় আমূল পরিবর্তন আসে। হিজাব এখন প্রায় অনিবার্য একটি পোশাক। এক সময় ইসলামী ছাত্র সংঘ বা ছাত্র শিবির বা ছাত্রী সংস্থার সদস্য-সদস্যাদের চিহ্নিত করার পৃথক কিছু চেহারা-পোশাক ছিল। এখন তাদের আলাদা করা কঠিন। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির প্রসার নিয়ে অনেকে ফেসবুকে রাজা-উজির মারেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো রাস্তায় নামেননা। তাদের তত্ত্ব সবকিছু করবে আওয়ামী লীগ। আর কারও কিছু করার দায়-দায়িত্ব নেই। সব ব্যর্থতা শুধু আওয়ামী লীগের। আর কারও কোন ব্যর্থতা নেই। এভাবে কিন্তু ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির প্রতাপ বন্ধ হবেনা।
কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি চলতে পারেনা। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার মাশুল এখন বাংলাদেশ দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে একাত্তরে পরাজিত মোল্লারা প্রচার শুরু করে বাংলাদেশকে অনৈসলামিক পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারনে রক্ষা পেয়েছে ইসলাম! এখনও সেই মোল্লাদের দখলেই দেশের সিংহভাগ মসজিদ-মাদ্রাসা। এরা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গায় না। জাতীয় কোন কর্মসূচিতে অংশ নেয়না। এসব তারা মানেনা। তাদের মানতে বাধ্য করার কোন রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন নেই। বিএনপি-জাতীয় পার্টির মতো দল তাদের পক্ষে। আওয়ামী লীগও যেন তাদের ঘাটাতে চায় না। প্রশাসন-পুলিশের অনেকের মনের ভিতরটা তাদের পক্ষ। ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির উত্থান নিয়ে ফেসবুকে যারা রাজা-উজির মারেন তারাও মসজিদে যান। কিন্তু তারা সেখানে এসবের প্রতিবাদ করেননা। একটি সরকারের পক্ষে শুধু পুলিশ দিয়ে এ পরিস্থিতির মোকাবেলা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের কোন কর্মসূচি না নিয়ে এবারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরোধিতায় দেশের পাকিস্তানপন্থী মোল্লা-মৌলভী, বামপন্থীরা একজোট হয়।
বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবীরাও বক্তৃতা-বিবৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লেখায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরোধিতায় মদদ দেয়। এদের সবার মদদে তারা হাটহাজারী থানা আক্রমন করেছে। লুট করেছে অস্ত্র। পুড়িয়ে দিয়েছে হাটহাজারীর ভূমি অফিস। তারা ব্রাহ্মনবাড়িয়া স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! অনেকদিন ধরে ব্রাহ্মনবাড়িয়া যেন দেশের বাইরের কোন অঞ্চল! অথচ আইনমন্ত্রী ব্রাহ্মনবাড়িয়ার। দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদ যে নামাজের জায়গা, উগ্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জায়গা এটা নয় সরকার সহ সবাইকে নতুন করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ধর্মপ্রান মুসল্লীরা যদি জাতীয় মসজিদের পবিত্রতা রক্ষায় একজোট হতে না পারেন সর্বনাশ হয়ে যাবে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের নিয়মিত মুসল্লীদের সিদ্ধান্ত নিতে তাদের মসজিদের পবিত্রতা তারা কিভাবে রক্ষা করবেন। মসজিদ শুধু নামাজ এবং ধর্মীয় কর্মকান্ডের জন্যে সীমাবদ্ধ রাখুন। মসজিদে জমায়েত হয়ে রাজনীতি করতে চাইলে সেই ইশতেহার সহ নির্বাচনে ম্যান্ডেট নিয়ে আসুন। ভোট নিয়ে কারও কোন বোঝাপড়ার থাকলে সেটি সরকারের সঙ্গে করুন। মসজিদের মুসল্লীদের সঙ্গে নয়। জাতীয় মসজিদ ভিত্তিক চারপাশ কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সভা-মিছিল নিষিদ্ধ করতে হবে। থানায় হামলা, স্টেশনে যারা আগুন দিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল যারা আগুনে পুড়িয়েছে তাদের বিচার করতে হবে। সব ঘটনার পর একটি রা’ উঠে এটি আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের অমুক অমুক করেছে! এর মাধ্যমে আসল ক্রীড়নকদের আড়াল করা হয়। আর কত ঘটনার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে যে হেফাজত সহ ধর্মীয় সংগঠনগুলো কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন নয়। চরমপন্থী সংগঠন। সব চরমপন্থী সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে আইন দিয়ে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ দিয়ে নয়।
বিচার বিভাগতো বিভিন্ন সময়ে দেশের মানুষকে রক্ষায় সুয়োমোটো ব্যবস্থা নেয়। বিচার বিভাগ এখানে কেনো নীরব? এখনকার হেফাজত সহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো বাংলাদেশের মূল চেতনা বিরোধী পাকিস্তানপন্থী দল। মুখে নরেন্দ্র মোদীর সফর বিরোধিতার কথা বললেও এদের মনে পুরনো পাকিস্তানি কষ্ট। বংশপরষ্পরায় এরা কিন্তু ৫০ বছরেও পাকিস্তানি কষ্ট ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও কখনও হেফাজত কখনও ভিন্ন নামে পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে টিকে আছে। সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ না করে এদের দৌড়ের ওপর রেখেছে। আর তারা হেফাজত-নুরুদের পিছনে দাঁড়িয়ে দৌড়ের ওপর রেখেছে সরকারকে! এই চোর-পুলিশ খেলা বন্ধ করুন। এদের নিষিদ্ধ করুন। যারা ফেসবুকে বসে নিষিদ্ধ চান তারা শঠতা বন্ধ করে সরকার সহ সকল প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে আসুন।