ফজলুল বারী: করোনা ভাইরাস মহামারীর দু’বছরব্যাপী তান্ডবের পর বাংলা বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা ফিরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। এতে করে যেন দম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়া মানুষজনের ধড়ে প্রান ফিরেছে। সঙ্গে ফিরেছে ইসলামী তরিকার নামে বাংলা নববর্ষবরণের বিরুদ্ধে পুরনো হুমকি বিতর্কও।
ফেসবুকে দেখবেন এখন আপনার বন্ধু তালিকার লোকজনও মঙ্গল শোভা যাত্রা নিয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন! এদের চিনে চিনে ব্যবস্থা নিতে পারায় আমি খুশি। বন্ধুত্ব সমমনা মানুষের মধ্যে হয়। ফেসবুক কোন ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম নয়। আত্মগোপনকারীরা যত চিহ্নিত রিমুভড হবে, তত আমাদের সমাজ পরিচ্ছন্ন-মুক্ত হবে।
এবার চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে র্যাব-পুলিশের কড়া প্রহরার ছবি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে জাত গেলো জাত গেলো বলে চিৎকারের কিছু নেই। রোজার মধ্যে এবার বৈশাখ উৎসব উদযাপন নিয়ে মৌলবাদী হামলার হুমকি ছিল। নিরাপত্তা বাহিনী তাই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
সাবধানের মার নেই। এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখে কারও কিছু ঘটাবার খায়েশ থাকলেও তারা সাহস করেনি। প্রমান হয়েছে তারা ভয় দেখানো চেষ্টা করলেও নিজেরা আসলে ভীতুর ডিম। আবার আত্মঘাতী কিছু যদি ঘটতো তাহলে এরাই বলতো, কেনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি!
মৌলবাদী সন্ত্রাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইন শৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতাও বেড়েছে। নিরাপত্তার গ্যারান্টি তৈরি হওয়ায় দিনে দিনে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রানের উৎসবে পরিণত হয়েছে। মানুষের মধ্যে উপার্জনের পাশাপাশি উপভোগের মানসিকতাও সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলা বর্ষবরণও তাদের কাছে তেমন একটি উৎসব উপভোগের নাম। আপনি এই উপভোগ পছন্দ না করেন সেটা আপনার বিষয়। যারা পছন্দ করে তাদের মন্দ বলার ভয় দেখানোর আপনি কে? সাবধান হন। আজ না হোক কাল মানুষকে ভয় দেখানোর দায়ে আপনি ধরা পড়ে যাবেন। আপনাকে ধরতে আপনার হাতের মোবাইল ফোনটাই এখন যথেষ্ট।
আমাকে একবার চাঙ্গি প্যারেড দেখাতে সিঙ্গাপুর ট্যুরিজম বোর্ড সে দেশে নিয়ে যায়। চীনা নববর্ষ উপলক্ষে সেটি ড্রাগন নৃত্যের মেলা। এটি দেখাতে তারা সে বছর বিশ্বের ৮৬টি দেশ থেকে সাংবাদিক নিয়ে গেছে। সেটি দেখে আমার মনে হয়েছে আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা অনেক সুন্দর।
সম্রাট আকবর আমলে প্রজাদের খাজনা আদায়ের সূত্রে চালু করা হয় এই বাংলা বর্ষবরণ। পহেলা বৈশাখের আগে-পরে গ্রামগঞ্জে নানান মেলা হয়। এসব আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। এসব জমায়েত কোন ওয়াজ মাহফিল নয়। সবকিছুতে ধর্ম খুঁজতে আসবেননা।
আমাদের গ্রামে যে অগ্রাহয়নের ফসল ওঠার পর সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে হোগলা পাতার পাটিতে বসার ব্যবস্থা করে ওয়াজ মাহফিল হয়, সেটিও আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অংশ। গ্রামের অনেক মাদ্রাসার সারা বছরের খরচ চালানোর তহবিল সংগ্রহের জন্যে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
ভোর পর্যন্ত চলে এসব ওয়াজ মাহফিল। মাঝে মাঝে ওয়াজ থামিয়ে সাহায্য প্রাপ্তির ঘোষনা দেয়া হতো। ‘খাদিজা বেগম একটা লাউ পাঠিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহপাক তার দান কবুল করুন। সবাই বলুন আমিন।‘ ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে খাবার দোকান সহ নানান দোকানপাটে এলাকা জুড়ে মেলার আবহের সৃষ্টি হয়।
হযরত শাহ জালালের মাজার সহ নানান মাজারের একটি চিত্র আপনার নজরে আসবেই। অনেক হিন্দু লোকজনও সেখানে প্রার্থনা করতে যান। এটাই আমাদের বাঙালি সমাজ। এটাই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। যার বিশ্বাস তার কাছে। হিন্দু পরিবার থেকেও নানা মাজারে মানতের দান আসে।
হিন্দু পরিবার থেকে দান আসে গ্রামের মাদ্রাসার ওয়াজ মাহফিলেও। এরজওন্যে তাদের ধর্ম ধংস হয়ে যায়না। একটি সমাজের গ্রামীণ সংস্কৃতির কারনে কোন ধর্ম যদি ধংস হয়ে যেতো তাহলে বংশপরম্পরায় ফতোয়াবাজ এখনও মুসলমান আছেন কি করে? যে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে ফতোয়া দেয়, আদতে সে নিজেই বিচ্ছিন্ন হয়।
আমাদের শৈশবে দেখা ওয়াজ মাহফিল থেকে কেউ কাউকে হুমকি দিতোনা। সাম্প্রতিককালে সমাজে দুর্নীতি অপকর্ম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের নামে ভারতে হিন্দু ধর্মের নামে হুমিকদাতা বেড়েছে! সৃষ্টি হয়েছে কিছু ইউটিউবার মাওলানার!
এদের দাপট বেশিদিন চলবেনা। ধর্মের নামে যারা হুমকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীর সংখ্যাও বেড়েছে। ভারতে গরুর মাংস খেতে হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের আপত্তি, তাদের অনুসারীদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেককে গরুর মাংস খেতে দেখেননি? ধর্মে তারাও কিন্তু হিন্দু।
গরুর মাংস খাওয়ায় তাদের হিন্দুত্ব খারিজ হয়ে যায়নি। এরপরও তারা পুজায় গেছেন। পুজা করেছেন। ধর্মের নামে হুমকিদাতাদের পরিণতি ভুলে যাবেননা। ইউটিউব যুগেরও আগে জঙ্গি বক্তা হিসাবে বিশেষ পরিচিত ছিল যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর।
তখন সাঈদী সারাক্ষণ অমুককে অমুককে হুমকি দিতেন! এভাবে বেশি খেলতে খেলতে খেলোয়াড় নিজেই একদিন কট এন্ড বোল্ড হয়ে যান! হুমকি দিতে দিতে তিনি আমেরিকা-ব্রিটেনে নিষিদ্ধ হন। ইরাকে মার্কিন হামলার পর কক্সবাজারের এক মাহফিলে মার্কিনিদের ওপর হামলার কথা বলেছিলেন!
সেই বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপ মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে চলে যায়। আমেরিকার জন্যে বিপদজ্জক ব্যক্তি হিসাবে মার্কিন ‘নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জারস তালিকায়’ নাম উঠে সাঈদীর। বাংলাদেশ সরকারকে তারা পত্র লিখে! স্টপ দ্য ম্যান! এই লোক যাতে আমেরিকাগামী কোন ফ্লাইটে চড়তে না পারে।
বিএনপি-জামায়াত সরকার তখন দেশে ক্ষমতায়। এমন চিঠি সরকার লুকোতে জানে! কিন্তু সেই চিঠি লুকিয়ে কোন লাভ হয়নি। ফজলুল বারী’র হাতে চলে আসে! এটেনশন ফজলুল বারী লিখে ফ্যাক্সে এসেছিল সে চিঠি। সোর্সের পরিচয় কোন দিন জানা যায়নি। জানার দরকারও নেই।
সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস এমন গোপন সোর্সরা আছে বলে অনেক ব্রেকিং নিউজ হয়! জনকন্ঠে ছাপা হয় সে রিপোর্ট। যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আর কোন দিন আমেরিকায় যেতে পারেনি। সেখানে তার ভালো মার্কেট ছিল। আমেরিকায় বাস করা রাজাকারের আন্ডাবাচ্চারা ডলারে টিকেট কেটে তার ওয়াজ শুনতে যেত।
কিন্তু কক্সবাজারে এক জোশের বক্তৃতার পরিণতিতে সেই রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বিলাতেও তার তেমন ভালো একটা মার্কেট ছিল। কিন্তু শেষবার বিলাত যাবার পর কক্সবাজারের বক্তৃতার ভিডিও ফুটেজ প্রচার করে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ফোর তাকে নিয়ে রিপোর্টে বলে এই বিপদজ্জনক ব্যক্তি বিলাতে প্রবেশের ভিসা পেয়েছে কি করে!
প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব লন্ডনের বিখ্যাত রেষ্টুরেন্ট রেডফোর্টের কর্নধার আমিন আলীর পরামর্শে খবর পাঠানো হয় সাঈদীকে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাকে গ্রেফতার করে আমেরিকার হাতে তুলে দেবার চিন্তা করছে! এমন খবর পেয়ে বিলাতের সব ওয়াজের কর্মসূচি বাতিল করে সাঈদী দেশে ফিরে যান।
এভাবে মেশিনম্যানের ডলারের পর তার পাউন্ড রোজগারের পথটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপরতো যুদ্ধাপরাধী মামলার দন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে তার দিন কাটছে। রাত কাটছে। চাঁদে দেখা গেছে গুজব ছড়িয়েও রক্ষা হয়নি। লইট্যা ফিশ, সোনা পাখি ময়না পাখি বলে তার আর পরকীয়া ফোন করা হয়না।
রাজাকারদের অনুসারী কিছু ইউটিউবার মৌলভী বাংলা বর্ষবরণ বিরুদ্ধে নানান ফতোয়া দিচ্ছে। আগেও তারা নানা সময়ে নানান ফতোয়া দিত। এখন লাইক ফলোয়ার বাড়াতে ফতোয়া মানতে আক্রমনও করছে। আক্রমনের উস্কানিও দিচ্ছে! এরা বেশি বাড়তে পারবেনা। আইডি ডিজেবলড হয়ে যাবে।
প্রতিবছর একুশের প্রভাত ফেরী, বাংলা বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ জাতীয় সব উৎসব-আয়োজনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশের পক্ষে ব্রিফিং করা হয়। এবারের ব্রিফিঙে বলা হয়েছে বাংলা বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় মৌলবাদী জঙ্গি হামলা হতে পারে, এমন একটি সতর্ক বার্তা তারা বিদেশি রাষ্ট্র থেকে পেয়েছেন।
এরজন্যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ না পরা, মাঝপথ থেকে অংশ না নেয়া, বৈশাখ উৎসবের সময় সীমা সংকোচন সহ নানান সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয় পুলিশের ব্রিফিঙে। অনেকে এর সমালোচনা করে লিখেছেন, এভাবে মৌলবাদীদের ভয়ে সরকারি উদ্যোগে বাঙালির উৎসব সংকুচিত করা হচ্ছে।
সরকার সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেনা। বাউল উৎসব সহ নানাকিছু বন্ধ করলেও ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করছেনা সরকার। ইত্যাদি।‘ আবার যদি বৈশাখের অনুষ্ঠানে কোন হামলার ঘটনা ঘটতো, তাহলে এদেরই অনেকে লিখতেন সরকারের আগেভাগে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
সাধারনত বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ নানান তথ্য বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে শেয়ার করে। এমন আগেও করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ আগেভাগে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিল। বঙ্গবন্ধু এসবে আমল না দেয়ায় গোটা পরিবারের জীবন দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অকালে সপরিবারে হারিয়ে আমাদেরও তাতে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর পিতার পার্থক্য হলো তিনি সবার কথাকে গুরুত্ব দেন। সবার কথা শোনেন। তাঁর প্রতি দেশের মানুষজনের অগাধ আস্থা।
এই একজন শেখ হাসিনার কারনে এতগুলো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আমরা যাদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলাম। ফাঁসির স্বপ্ন দেখতাম। ফাঁসি সত্যিই হবে অতটা আশা করতে করতামনা। রিসোর্ট মামুনুলরাও জেল খাটছে শেখ হাসিনার কারনে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় নিরাপত্তা পাহারার ছবি হলেও তাতে আমাদের জাত যাবেনা।