সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতির গুঞ্জন

সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতির গুঞ্জন

অনলাইন ডেস্ক: : ০৮ জুলাই, ২০১৫

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিনভর গুঞ্জন ছিল। এদিন সকালে অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ অনুপস্থিত থাকায় প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর পরপরই ‘আশরাফকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে’- এ শিরোনামে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ প্রচার হতে থাকে। যদিও দিনশেষে এ ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘গুজবে কান না দেয়াই ভালো।’ অবশ্য এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেন।

সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ভর্ৎসনা করেন। দুপুরে সংসদ ভবনে তাকে ডেকে পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন। আশরাফ সকালে একনেকের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকায় নাখোশ হন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল। কিন্তু এতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ ভবনে সৈয়দ আশরাফকে জরুরি তলব করেন। সংসদ লবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন আশরাফ। সেখান থেকে অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে সৈয়দ আশরাফকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন।
এদিকে কিশোরগঞ্জ ব্যুরো জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিকালে ২ দিনের সরকারি সফরে এসে কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টির বাসভবনে ওঠার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গুজবে কান না দেয়াই ভালো।’ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়ার খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারের কয়েক ঘণ্টা পর সাংবাদিকদের তিনি এ পরামর্শ দেন। এ সময় তিনি আরও জানান, ‘মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।’ তাই এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
একই দিন সন্ধ্যায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শহরের সমবায় কমিউনিটি সেন্টার মিলনায়তনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন। এ ইফতার পার্টিতেও তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখেননি। আজ দুপুরে কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠেয় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা এবং সন্ধ্যায় হোসেনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে তার। সৈয়দ আশরাফের অব্যাহতির বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বলার মতো কোনো খবর আমার কাছে নেই।’ তবে গণভবনের একটি সূত্র গতকাল রাতে যুগান্তরকে জানিয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি জরুরি নথি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য গণভবনে পাঠানো হয়েছে।
সরকারের একজন শীর্ষ নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে জানান, গতকাল একনেকের বৈঠকে নির্ধারিত এজেন্ডা ছিল ‘গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প-২’। এই প্রকল্পের আওতায় সব সংসদ সদস্যকে তার এলাকায় ইচ্ছেমতো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এএনএম সামসুদ্দিন। উপস্থাপনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমার একটু কথা আছে। এত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আলোচনা হচ্ছে। তবে বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়ের দু’জন মন্ত্রীর কেউ উপস্থিত নেই। সুতরাং প্রকল্পটি ফেরত দেয়া উচিত’। তিনি বলেন, ‘আগেও প্রকল্পটি ছিল। সেটি জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হবে। এমপিদের এলাকার জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে’।
ওই নীতিনির্ধারক আরও জানান, বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা চাইলে কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রীকে চেঞ্জ করে দেব। এখানে কেবিনেট সেক্রেটারি আছেন। কাগজপত্র প্রস্তুত করুন। আজকেই বদলে দেয়ার নির্দেশনা দেব। তবে প্রকল্পটি স্থগিত করার দরকার নেই’। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পটি অনুমোদন করতে হবে। কারণ তৃণমূলের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পটি খুব প্রয়োজন। মন্ত্রীর জন্য বসে না থেকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া যেতে পারে’।
তখন ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রকল্প পাস করতে হবে। এরপর প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। একনেক বৈঠক শেষ হলে একে একে সবাইকে বের করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ আরও দু’জন সিনিয়র মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সেখান থেকে আশরাফকে ডেকে পাঠানো হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে চলে যান।
এদিকে জরুরি তলবের পর বেলা পৌনে একটার দিকে মন্ত্রিপাড়ার সরকারি বাসভবন থেকে বের হয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংসদে ছুটে যান। তিনি সোজা সংসদ লবিতে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে মনমরা আশরাফ সংসদ ভবন থেকে বের হয়ে সোয়া দুইটার দিকে আবার মন্ত্রিপাড়ার বাসভবনে ফিরে যান। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেলা পৌনে তিনটার দিকে তিনি কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন। কিশোরগঞ্জে রওনা দেয়ার কথা ছিল দুপুর সাড়ে ১২টায়।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে। তিনি টানা দ্বিতীয় মেয়াদে শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওয়ান-ইলেভেনের সংকটময় মুহূর্তে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সঙ্গে শক্ত হাতে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আশরাফ। দল ক্ষমতায় এলে তাকে দেয়া হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এরপর কাউন্সিলে ভারমুক্ত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হন আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু এ দায়িত্ব পাওয়ার পর সৈয়দ আশরাফ দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে সোনার হরিণে পরিণত হন। তাকে পাওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় এবং সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতারা আশরাফের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সৈয়দ আশরাফ সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে যান কালেভদ্রে। দলীয় কর্মসূচিগুলোতে ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থাকা শুরু করেন। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে আশরাফ সম্পর্কে কথা উঠলে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে আশরাফকে বলেন, আমার ফোনটা ধর।
এ অবস্থার মধ্যেই দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দল পুনরায় ক্ষমতায় এলে আবারও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিএনপি-জামায়াতের টানা অবরোধ-হরতালে নীরব থাকেন আশরাফ। তখন শোনা যায়, শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছের বাইরে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এতে তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে বেশ অসন্তোষ দেখা দেয়। এই ক্রান্তিকালে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে ‘দু আনার মন্ত্রী’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আশরাফের এ মন্তব্যে প্রভাবশালী দেশটি প্রকাশ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না জানালেও ভেতরে ভেতরে ক্ষমতাসীন দলের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
ভিন্ন দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি রাজনীতিক সম্পর্কে কটাক্ষ করায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সতর্ক করে দেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মন্তব্য আর না করেন সে ব্যাপারেও হুশিয়ার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর থেকেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। মাঝেমধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়। তবে সৈয়দ আশরাফ তার চিরচেনা জীবনযাপন থেকে আর বের হতে পারেননি। সর্বশেষ মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকে উপস্থিত না থেকে ভর্ৎসনার শিকার হন তিনি।
শাসক দলটির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, আশরাফকে নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি মেধাবী। আর এমন মেধাবীরা অগোছালো জীবনযাপন করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তবে অধিকাংশ নেতাকর্মী সাংগঠনিক প্রযোজনে না পাওয়ায় তার ওপর ক্ষুব্ধই রয়েছেন। সৈয়দ আশরাফের এ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং দীর্ঘ সময় ধরে অফিসে না যাওয়া নিয়ে একাধিক পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাকে নিয়ে আঁকা হয়েছে মজার মজার কার্টুন। কিন্তু সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয় ও দল। (সুত্রঃযুগান্তর, ০৮ জুলাই ২০১৫)