ঢাকার মাটিতে প্রথম পা ফেলেছিলাম ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর। উদ্দেশ্য ছিল চিল্লায় যাওয়ার। সঙ্গে হাইস্কুলের এক স্যার ছিলেন। এর পরেরবার এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম ওঠাতে। একাই ছিলাম সেবার। ঢাকা শহরের আসল চেহারা তখনই স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাই।
অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, ঢাকাতে পা রাখাটাও ছিল একটা স্বপ্ন। আমাদের এলাকা থেকে দুই ধরনের লোক যেত ঢাকায়। একটা দল রোজগারের আশায়। তাদের বেশির ভাগই ছিল ঝরে পড়া (drop out) কিংবা নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষ। এই দলের মানুষগুলো যখন ছুটি কাটাতে গ্রামে আসত তখন তাদের হাবভাবই বলে দিত তারা ঢাকাইয়া পার্টি। সারা জীবন হুক্কা খাওয়া কিংবা বিড়ির মোথা টানা ছেলেগুলোকে দেখতাম ফিল্টারওয়ালা সিগারেট ফুঁকছে। ঢাকায় বসবাসের সময়কাল এক-দুই মাস না হলেও সব কথাতেই ঢাকাইয়া টান দিত। মুখটা হা করে, চোখগুলোকে বড় বড় করে তাদের মুখে ঢাকার বয়ান শুনতাম। দিবাস্বপ্নও দেখতাম মাঝে মাঝে। দেখতাম আমিও ঢাকা ফেরত ওদের মতোই ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলছি। তখন কল্পনাতেও ছিল না যে আমিও ঢাকায় যেতে পারব! আজ যখন ফ্লাশ ব্যাকে দেখি, মাটির রাস্তায় জার্নির একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ফিরছি আমি, আকালু কাকা পাশ কেটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, কি বাহে টুলু ঢাকাত থাকি আলু (টুলু, ঢাকা থেকে এলি?)। আমারও মুখ থেকে বের হতো, হ কাকা, কেনকা আছেন? (কেমন আছেন?)। একবারের তরেও ঢাকাইয়া টান আসেনি আমার মুখে!
আর এক দলে ছিল ধনীর ছেলে ও শিক্ষকেরা। ছেলেগুলো যেত এফডিসির গেটে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখতে আর স্যারেরা যেতেন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে। স্যারেরা বেশি দিন থাকতেন না ঢাকায়। কাজ শেষ হলেই কিংবা পকেট খালি হলেই চলে আসতেন। আব্বাকেও মাঝে মাঝে ঢাকায় যেতে দেখতাম। আমাদের জন্য কোনো স্কলারশিপ জোগাড় করা যায় কি না, কিংবা সহকর্মীদের ফরমায়েশ নিয়ে। কোনো কোনো বার হাসি মুখে, হাতে কিছু ফল নিয়ে (বেশির ভাগ সময়েই আনারস) ফিরতেন। তবে অনেক সময়ই বিষণ্ন মুখে ফিরতে দেখতাম। তখন বুঝতাম না এখন বুঝি। যে টাকা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন তাতে মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের পকেট ভরাতে পারেননি। কাজ অর্ধেক রেখেই চলে আসতে হয়েছে। ধনীর দুলালদের দেখতাম নতুন প্যান্ট, নতুন জুতা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরতে। নতুন জুতায় ফ্যাশন করতে যেয়ে পায়ে ফোসকা বানিয়েছে। ওদেরকে দেখতাম আর মনের গভীরে একটা গোপন ইচ্ছাকে লালন করতাম। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকলাম। আমাদের গ্রাম থেকে তখনো কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। যে দু-একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেখেছি তারাও গিয়েছিলেন রাজশাহীতে। আলম ভাই, লেবু ভাই ভর্তি হলেন রাজশাহীতে। এক বছর পর সিরাজুল ভাই ভর্তি হলেন ঢাকায় আর সাজু ভাই জাহাঙ্গীরনগরে। আমার সুপ্ত বাসনাটাও একটু উঁকি দেওয়া শুরু করল।
টিনের বেড়ার সরু ছিদ্র দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া আলোকরশ্মি যেমন আশা জাগায় একটা ঝলমলে দিনের, আমিও তেমনি আমার আশার গাছটিকে তরতাজা হতে দেখি। আমাদের গ্রাম থেকে মানুষ শুধু চাকরি কিংবা বেড়াতে যায় না ঢাকায়, শিক্ষার জন্যও যায়। তাও আবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে পড়ার সময় তাই সুযোগ পেলেই সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতাম ভর্তির ব্যাপারে। সবকিছুই ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু বাধ সাধল বন্যা। এইচএসসি পরীক্ষার পর হলো বড় একটা বন্যা। ভর্তির পরীক্ষার প্রস্তুতি তো দূরের কথা, ঘুমানোর জায়গাও নেই। পানির তোড় এতই প্রবল ছিল যে আমাদের সবাইকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল বেড়ি বাঁধে। কলেজের হোস্টেল থেকে ফেরার সময় ট্রাংকের (টিনের বাক্স) ভেতর বই-খাতাগুলোকে যেভাবে গুছিয়ে রেখেছিলাম ঠিক সেভাবেই ছিল তিন মাস। বন্ধুদের অনেকেই ভর্তি কোচিং করতে ঢাকা গিয়েছিল। আব্বাকে বলার সাহস পাইনি যে বন্ধুদের মতো আমিও কোচিং করতে চাই। এইচএসসির রেজাল্ট হলো, ফলাফল যেরকম হওয়ার কথা ছিল সেই রকমই হলো। আমার আশার গাছটিও শাখা প্রশাখা বাড়ানোর গ্যারান্টি পেল। রেজাল্টই বলে দিল ঢাকা যাওয়ার টিকিট বুকিংয়ের যোগ্যতা আমার হয়েছে।
আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করার জন্য ছোটখাটো মিটিং বসল আমাদের আঙিনায়। বড় ভাই বললেন, ওকে ডাক্তার বানানো হোক। মেজো ভাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢোকার উপদেশ দিলেন। বড় ভাইয়ের শ্বশুর ব্যাংকে চাকরি নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। হাজি মামা বললেন, উকিল হ বাহে। আব্বা মেরিন নাকি জিডি পাইলটে গেলে ভালো হবে সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে চুপ করে থাকলেন। আমি সবার কথা শুনছি আর হ্যাঁ সূচক শব্দ করছি। সবাই না জানলেও আমি জানতাম সব কিছু হতে চাইলেও সহজে হওয়া যাওয়া না। ভর্তি পরীক্ষা নামক একটা খাঁড়া পাহাড়ের বাধা আছে সামনে। অতিক্রম করার দম আছে কিন্তু গ্যারান্টি দেওয়ার সাহস ছিল না। টার্গেট আমার একটা ছিল আর সেটা হলো আমাকে ঢাকা যেতেই হবে এবং পড়াশোনা করলে ঢাকাতেই তা না হলে গাইবান্ধা ডিগ্রি কলেজে।
মিটিং শেষে আব্বা আমাকে একা পেয়ে বললেন, প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারির চাকরি করবু। আব্বার মুখের ওপর খুব কম কথাই বলতাম। সেদিন আর দেরি করলাম না। সোজা বলে উঠলাম, আব্বা, আমি আরও একটু পড়াশোনা করতে চাই। কি জন্য আব্বা আমাকে সেদিন সেই কথাগুলো বলেছিলেন আমার জানা ছিল না। কোনো দিন জিজ্ঞেস করাও হয়নি। অনার্স করার আগেই আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। হয়তো ওপর থেকে কোনো ইশারা পেয়েছিলেন চলে যাওয়ার। পড়াশোনা যাতে মাঝপথে থেমে না যায় সেই চিন্তাই করেছিলেন।
যেহেতু ঢাকা ছাড়া অন্য কোথাও পড়ব না তাই বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম নিয়েছিলাম। ঢাকাতে পড়াশোনা করতে চাওয়ার অনেক কারণ ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল টিউশনি করা। বাড়ির অর্থনীতির কথা চিন্তা করেছি অনেক। যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বাড়ি থেকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট। ওই ভয়টা ছিল সবচেয়ে বেশি। কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় সিনিয়র ভাইদের কাছে গল্প শুনতাম যে অনেকেই টিউশনি করেই পড়াশোনা করেন। বাই চান্স টাকা আসা বন্ধ হলে যাতে কনটিনিউ করতে পারেন পড়ালেখা।
কোচিং নাই, গাইড নাই, কেমন হবে এই ভয় ছিল সর্বদাই। অঙ্কে নিজেকে পণ্ডিত মনে করতাম। ভাবটা এমন ছিল বুয়েট আমাকে আটকাতে পারবে না। যমুনা নদীর চরে ২৪ ঘণ্টা আটকে থেকে, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ম্যাথের প্রথম প্রশ্ন দেখেই আমার পাণ্ডিত্য উধাও হয়ে গেল। পরীক্ষার রুমেই কনফার্ম করলাম টিকব না।
বাকি থাকল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি পরীক্ষা খুব একটা ভালো দিতে পারি নাই। এসএসসি ও এইচএসসি মার্কসের বদৌলতে চান্স পেয়েছিলাম। ভর্তি হলাম ক্লাসও শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, ভাবই আলাদা! প্রথম দিনের ক্লাসেই বুঝলাম বিশ্ববিদ্যালয় কি! এ আর খান স্যারের প্রথম ক্লাসই বুঝিয়ে দিল কোন সমুদ্র পাড়ি দিতে এসেছি আমার ভাঙা তরী নিয়ে। থিওরি অব রিলেটিভিটি দিয়ে শুরু করলেন তিনি তার ক্লাস। রিলেটিভের মানে জানতাম, রিলেটিভিটি আবার কি জিনিস? বাপের বড় ভাই হলো জেঠা আর ছোট ভাই হলে চাচা কিংবা কাকা জানতাম। এ রিলেটিভিটি আবার কীভাবে ডিফাইন করবে সম্পর্ক? মুই কি হনুরে ভাবটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
ডাবলিং দিয়েই শুরু হয়েছিল হলো লাইফ। সিরাজুল ভাইয়ের স্যাক্রিফাইস ভুলব না যত দিন বাঁচব। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলাম, তাই গোলাগুলির শব্দ বুঝিনি। সৃষ্টিকর্তা আমার এই অপূর্ণ ইচ্ছেটাকে পূরণ করেছেন অভি–ইলিয়াসের বন্দুকযুদ্ধ দেখার সুযোগ করে দিয়ে। টেবিল টেনিসের টেবিলের নিচে শুয়ে কতবার যে কলেমা পড়েছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। পরবর্তীতে অবশ্য উপভোগ করেছি গোলাগুলি। গোলাগুলির মহড়া শুরু হলেই, বারান্দায় রেলিংয়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে ওয়ান মোর বলে উৎসাহ দিতাম সেই সব যোদ্ধাদের।
জ্ঞানভান্ডার থেকে জ্ঞান বেশি আরোহণ করতে পারিনি, তবে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একজন মানুষ বানিয়েছে। পুরোপুরি না হলেও মানুষ হওয়ার রাস্তাটা দেখিয়েছে। হলের লাইফটাই শিখিয়েছে ত্যাগ, ধৈর্য ও সহমর্মিতা বিষয়গুলোকে। রুমমেটদের ক্যালচার ও স্ট্যাটাসে মিল ছিল না। নিশাচর প্রাণী থাকলে ভোরের পাখিও ছিল। এর মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি ৬-৭ বছর। শিখেছি অনেক কিছু।
আজ যখন জাপানিজদের এক হাতে সিগারেট অন্য হাতে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখি। ক্যাম্পাসের ছবিটা ভেসে ওঠে। দেখতে পাই তারিক, রুবেল, অনুপ, মহিবুর, বিলু ও সজ্জু ভাইয়ের সিগারেট হাতে চা পানের দৃশ্যটাকে। চৌরাস্তার মোড়ে জাপানের নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা দেওয়া দেখলেই হালিমের ভাষণের কথা মনে পড়ে। পার্থক্য শুধু হালিমের বক্তৃতা শোনার শ্রোতা থাকত। এখানে জাপানিজ নেতাদের ভাষণ শোনার শ্রোতা থাকে না। ট্রেনের সিটে বই হাতে মগ্ন কোনো মেয়েকে দেখলেই ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে বসা রুমানা কিংবা তিথির কথা মনে পরে। ছুটির দিনগুলোতে বিকেলে ঘুমোতে গেলে, ওই কানা বলে ডাক শুনতে পাই রিপনের। লিকু ও রিপন ভাইয়ের কার্ড নিয়ে ঝগড়ার শব্দও কানে আসে কতেকবার। রাতে হাঁটতে বেরোলেই অফিস ফেরত বিধ্বস্ত জাপানিজকে দেখলেই আজমের কথা মনে পড়ে। টিউশনি শেষে ফিরতে ওর রাত দশটা বেজে যেত।
১ জুলাই পত্রিকার পাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের খবরটা দেখে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই সব দিনগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের খবরটা বড় বেশি নস্টালজিক বানাল আমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ছাদের নিচে ক্লাস করা আমরা সবাই আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি বিভিন্ন দেশে। এসএমএস-এর বদৌলতে প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ হয়। সবাই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কিছুদিন আগে এ আর খান স্যারের চিরবিদায়ের খবর পেয়েছি। থিওরি অব রিলেটিভিট হয়তো পড়াবে তারই হাতেগড়া কোনো ছাত্র। কিছুই থেমে থাকে না, থাকবে না।
মান্না দের সেই কালজয়ী গানটা কানের কাছে গুনগুন করছে: আজও সে বাগানে ফুটেছে নতুন কুঁড়ি/ শুধু সেই সেদিনের মালি নেই…।
(লেখকঃ মো. মাহবুবর রহমান, সফটওয়্যার প্রকৌশলী,জুলাই ০৮, ২০১৫,)