শেরপুর সোহাগপুরের ৫৭ জন বিধবার কথা আমরা জানি। জানে দেশের মানুষ। তাদের জন্যই এখন সোহাগপুরের নাম হয়েছে বিধবাপল্লী। আর সেই পল্লীতে তাদের মধ্যেই আছেন ১৩ জন বীরাঙ্গনা। তারাও একাত্তরের ২৫ জুলাই তাদের স্বামীকে হারিয়েছেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে তারা তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা তখন চেপে রেখেছেন। আর এখনও তাদের নীচু চোখে দেখা হয়। বলা হয় ‘কলঙ্কিনী’। হায় তাদের কপালে মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও।
সোহাগপুরের বিধবাপল্লীতে গিয়ে কথা বলতে বলতে জানা যায় এই বীরাঙ্গনাদের কথা। আমরা জানতে পারি যাদের সঙ্গে কথা বলছি তাদের মধ্যেই আছেন তারা। কিন্তু সবার সামনে কথা বলতে চান না। তারা যে বীর, তাও প্রকাশ করতে চান না। যদিও বিধবাপল্লীর সবাই জানেন। জানেন আশপাশের গাঁয়ের লোকেরা। আর এই জানা তাদের জন্য স্বামী হারানোর ওপর ডেকে এনেছে নতুন দুর্যোগ।
তবুও কথা হয়। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন বীরাঙ্গনা কথা বলতে রাজি হন। আর আলাদাভাবে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ওজুফা বেওয়া। জানালেন, একাত্তরের ২৫ জুলাই তার স্বামী হাতেম আলীকেই শুধু হত্যা করেনি পাক হানাদার আর রাজাকাররা, তার ওপরও নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন। তিনি অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। উঠে দাঁড়াতে পারেননি এক মাস। স্বামীর লাশও দেখতে পারেননি।
আর যখন সুস্থ হলেন, তখন দেখেলেন তার জীবনে আরেক দুর্যোগ। ওজুফা জানান, ‘বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কেউ আর কাজ দিতে চায় না তখন। কাজের জন্য গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। বলত কলঙ্কিনী। এমনকি এই গ্রামে নিজের পরিবারের অন্য সদস্যরাও তখন আমাকে গ্রহণ করতে চায়নি।’
তারপর দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান শিশু সন্তানদের নিয়ে। এখনও সেখানেই থাকেন নিজে। তবে তার সন্তানরা বিধবাপল্লীতেই থাকেন।
পরিস্থিতি কি ৪৪ বছরে বদলেছে? অজুফা বললেন, ‘না বদলায়নি। আমাদের আলাদা বাঁকা চোখে দেখা হয় এখনও। যদি আমার ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা বলি, তাহলে অনেকেই বলেন আমরা এটা নিয়ে ব্যবসা করছি।’
একই রকম নির্মম আর করুণ গল্প বীরাঙ্গনা জোবেদা বেওয়ার। তিনি বলেন, ‘পাশবিক নির্যাতনের কথা লুকিয়ে রেখেও তখন কাজ হয়নি। লোকজন জেনে গেছে। আর নিন্দা করেছে। তাড়িয়ে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, স্বামী ফজর আলীকে হারিয়ে যখন দেখি সব অন্ধকার। গ্রামের লোক কাজ দেয় না। বসতে দেয় না, কথা বলতে চায় না। তখন বাজারের রাইস মিলে কাজ করতে গেলেও কাজ হয়নি। সেখানেও ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে।
এক অস্পৃশ্য জীবন যন্ত্রণা বয়ে চলছেন জোবেদা। এখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতেও ‘নষ্ট মেয়েছেলে’ এই অপবাদ দূর হয়নি।
তার কোনও সন্তান নেই। আর নতুন করে সংসার পাতারও সুযোগ হয়নি। বেঁচে আছেন সব মিলিয়ে এক হাজার ছয়শ’ টাকা ভাতার ওপর। এই বয়সে কাজ করতে পারেন না। ‘তবে পারলেও আমাকে কেউ কাজ দেবে না’- বললেন বীরাঙ্গনা জোবেদা।
বীরাঙ্গনা সমলা, মহিরন, হাফিজা; এদের সবার জীবনকাহিনিই একই রকম। স্বামী হারিয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সমাজে হয়েছেন ‘কলঙ্কিনী’। আর শেষবয়সে মৃত্যুর দুয়ারে এসেও তাদের সেই কলঙ্কের বোঝা নামেনি।
হাফিজা বেওয়া এখন বুঝতে পারেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তারাও দেশের জন্য চরম আত্মত্যাগ করছেন। বরং তাদের ত্যাগ আরও বেশি। স্বামী হারিয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন। তাই তার প্রশ্ন ‘তারপরও কেন আমাদের অবহেলা? কেন আমরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাইনি।’
সমলা জানান, ‘আমাদের জন্য আমাদের সন্তানদেরও খারাপ চোখে দেখা হয়। তাদের এখনও নানা আপত্তিকর কথা বলা হয়।’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, যেন আমরা অপরাধী। যেন আমরা বড় কোনও পাপ করেছি। আর আমাদের ‘পাপে’ পুড়ছে আমাদের সন্তানরাও। হয়তো আরও পুড়তে হবে।’’
তারা বলেন, ‘আমরা শুনেছি সরকার বীরাঙ্গনাদের সম্মান দিচ্ছে। দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। কিন্তু আমাদের কথা কী সরকার জানে? আমাদের কথা কী কেউ বলেছে? বলেনি।’
তাই এই বীরাঙ্গনাদের এখন দাবি, ‘আমাদের কলঙ্ক মুক্ত করা হোক। মরার আগে কলঙ্কমুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চাই। কলঙ্ক নিয়ে কবরে যেতে চাই না।’
সূত্র ( বাংলা ট্রিবিউন,প্রকাশিত: