ফজলুল বারী:বিমান ছিনতাইর চেষ্টাকারী পলাশ নামের ছেলেটি আত্মাহুতির মৃত্যুর মাধ্যমে এখন সবকিছুর উর্ধে। মাঝখানে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে বাংলাদেশের বিমান বন্দর আর সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের আনস্মার্ট, ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। ঘটনাটির পর মিডিয়ার সামনে বিমান প্রতিমন্ত্রী, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান আর বিমানের এমডিকে যেভাবে হতভম্ব আনস্মার্ট দেখা গেছে এদের নেতৃত্বে এরচেয়ে বেশিকিছু আশা করা অনুচিত। অথবা এটিই আমাদের স্টান্ডার্ড। তবে বিমান প্রতিমন্ত্রী টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সরল স্বীকার করেছেন তিনি কিছুই জানেননা পারেননা, সবকিছুই জানেন পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছিনতাইর ঘটনা শুনে তিনি চলে গেছেন গনভবনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসে দেখেছেন তার কাজও করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সহজাত দক্ষতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু সামাল দিচ্ছিলেন।
যাক, বিমান ছিনতাইর চেষ্টাকারী পলাশের আদ্যপান্ত নানা বিষয় মিডিয়ায় পড়ে আমার এক ফ্যান্টাসি প্রিয় আত্মঘাতী তরুনের পাগলামো নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করলো। সর্বশেষ এক টিভি চ্যানেলের ফেসবুক পেইজে ছেলেটির একটি মিউজিক ভিডিও, তার গাওয়া গান দেখে-শুনে মন আরও খারাপ হয়। এমন একটি ছেলে, তার একজন ভালো অভিভাবকের দরকার ছিলো। কিন্তু তাকে কেউ গাইড করতে পারলোনা। অথবা সে সুযোগও পেলোনা। মিথ্যার বেসাতিতে ভরপুর এমন একটি এলোমেলো এলোপাতাড়ি জীবন যাপন করতে গিয়ে সর্বশেষ হয়ে গেলো দেশদ্রোহী আত্মঘাতী। মানুষের ঘৃনার পাত্র হয়ে শেষ ঘটলো তার। আমি পলাশের বয়সী ছেলেপুলেকে নিয়ে কাজ করি। পলাশ বা তারচেয়ে কমবয়েসী যারা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসে, তাদের কাউকে কাউকে ম্যানেজ করতে অনেক সময় বেগ পেতে হয়। বাংলাদেশের মতো একটি আইন অমান্যপ্রবন দেশ থেকে একটি আইনানুগ দেশে এসে পদে পদে এদের কেউ কেউ সারাক্ষন আইনলংঘনের চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গেই এখানে আমার বন্ধুত্ব হয়। ভালোবাসা দিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে তাদেরকে আমি বেপুথো হতে দেইনা। পলাশ চরিত্রটি সৃষ্টির কারনগুলোও সে কারনে আমি ধারনা করতে পারি।
নারায়নগঞ্জের এক গ্রামের এক সাধারন পরিবারের ছেলে পলাশ। বাবা থাকতেন বিদেশে। ছেলেকে হয়তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়তে পাঠয়েছিলেন মাদ্রাসায়। আমাদের দেশের অনেক শহরের অভিভাবকও এখন পর্যন্ত পড়াশুনায় ছেলেপুলের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেন কম। মা-বাবা ঠিক করে দেন ছেলেকে এই পড়তে হবে সেই পড়তে হবে। পেতে হবে জিপিএ ফাইভ । এই হতে হবে সেই হতে হবে। আর পলাশতো গ্রামের ছেলে। মাদ্রাসা শিক্ষাও অত সহজ নয়। পলাশ মাদ্রাসায় থাকলোনা। কলেজে এসে ভর্তি হলো। এখানেও পড়াশুনায় ধারাবাহিক থাকলোনা। মালয়েশিয়ায় গেলো। সেখান থেকেও ফিরে এলো। তার যে পড়াশুনা, মালয়েশিয়ায় নিশ্চয় সে শ্রমিকের কাজ করেছে। কিন্তু তার গান ভালোবাসা, অভিনয়ের জগত ভালোবাসা, তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, অর্থনৈতিক ভিত্তি, সব মিলিয়ে ধারনা করতে পারি, বাস্তবেও সে অনেক অভিনয় করতো। মিথ্যার ফ্যান্টাসিতে ঢেকে রাখতে চাইতো নিজেকে এবং তার চারপাশ। ফেসবুকে নিজের পরিচিতিতে লিখে রেখেছিল সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। স্কটল্যান্ডে থাকতো। এমন মিথ্যার বেসাতিতে ঢেকে রেখেছিল নিজেকে। নামটাও পৈত্রিক নয়। বাবা নাম রেখেছিলেন মোঃ পলাশ আহমদ। নিজের নাম নিয়েছিল সে মাহাবি জাহান।
এমন চারপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে মিথ্যার মোড়কে অভিনয় করতে করতে শেষ অভিনয়টা করেছিল বিমান ছিনতাই চেষ্টার দিন। খেলনা পিস্তল আর নকল বোমায় সবাইকে অভিনয়ে বোকা বানাতে চেয়েছিল। ওই বিমানের এক বিজনেস ক্লাসের যাত্রী ফেসবুকে লিখেছেন আকস্মিক ছেলেটি এসে বসে বিজনেস ক্লাসে তার সামনের একটি ফাঁকা আসনে। ব্যাগ থেকে নকল পিস্তল, বোমাসদৃশ বস্তু বের করে তার সামনেই সে বিমান ছিনতাইকারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ভয়ে তখনই তিনি এবং তার স্ত্রী অর্ধেক হয়ে যান। সে পাইলটকে চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছিল যাতে বিমানটি চট্টগ্রামে অবতরনের চেষ্টা করা না হয়। চট্টগ্রামে অবতরন করাতে গেলে সে বিমান উড়িয়ে দেবে। চট্টগ্রাম তখন মাত্র ১৫ মিনিট দূরত্বে। পাইলটও তাই তার কথা না শুনে চট্টগাম বিমান বন্দরকে পরিস্থিতি জানিয়ে বিমানও সেখানে অবতরন করান। যাত্রীদেরও জরুরি ব্যবস্থায় বিমান থেকে নামানো হয়। এরপরই সাঙ্গ হয় মিথ্যার বেসাতিতে পরিপূর্ন মাহাবি জাহান পলাশ ওরফে মোঃ পলাশ আহমদের জীবন।
একজন বিমান ছিনতাইকারী হিসাবে কমান্ডোদের হাতে নিহত হবার পর টেলিভিশনে সাবেক স্ত্রী সিমলার ইন্টারভ্যুতে মনে হয়েছিল মিথ্যার ফ্যান্টাসিতে পলাশ ওই নায়িকাকেও কাবু করেছিল। সিমলা জানতো পলাশ বিদেশে মানে স্কটল্যান্ডে থাকে। মালয়েশিয়া মানে স্কটল্যান্ড! একজন প্রযোজক হিসাবে সিমলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কবর’ নামের একটি শর্ট ফিল্মের প্রযোজক ছিল সে। জসিম উদ্দিনের কবর’ কবিতার চিত্ররূপ সেই শর্ট ফিল্মে সেই দাদু’র চরিত্রে অভিনয়ও করেছে। আর সেই শর্ট ফিল্মের প্রযোজকের বিনিয়োগের পরিমান ছিলো মাত্র সাড়ে ছয় লাখ টাকা। আর নায়িকা সিমলা এই ‘বিদেশে থাকা প্রযোজকের অভিনয়ে’ এতোটাই কাবু হয় যে পলাশে মুগ্ধ হয়ে নায়িকা নিজেই প্রস্তাব দিয়ে তাকে বিয়ে করেছে! আর র্যাব বলেছে পলাশ তাদের কাছে এক অপহরনের ঘটনার আসামী হিসাবে নথিভূক্ত ছিল। মুক্তিপনের জন্যে এক তরুনীকে সে অপহরন করে জেলও খেটেছে। ‘বিদেশে থাকা প্রযোজকের অভিনয়’ও ধরতে পারলেননা ঢাকাই ছবির নায়িকা!
সিমলা যখন টেলিভিশনে তাদের বিয়ের কাহিনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলছিলেন, পলাশের অর্থ কী আছে না আছে তা জানার চেষ্টা তিনি করেননি, পলাশের অর্থের ওপর নির্ভরশীল হবার তার দরকার ছিলোনা, তখন ভাবলাম পলাশের শারীরিক ক্ষমতায় হয়তো তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই বিয়ের আগে এবং পরে দুই দফায় নায়িকা তার এই ফ্যান্টাসি স্বামীর বাড়িও গিয়েছিলেন। এই নায়িকা আবার শুরু থেকে পলাশকে জানতেন তার পোশাকি অথবা ছদ্মনাম মাহিবি জাহান নামে। তাড়াহুড়ার জীবনে এর আগে বগুড়ায় বিয়েও করেছিলেন পলাশ। সেই সংসারে তার একটি ছেলেও আছে। নায়িকা অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে পলাশের পাসপোর্টে স্কটল্যান্ডের কোন ভিসা দেখলেননা। কিন্তু সবচেয়ে আঘাত পেলেন প্রথম বিয়ের তথ্য গোপনে। এতবড় সাহস তার সঙ্গে প্রতারনা করে! অতএব বাদ। নিজের থেকে প্রস্তাব দিয়ে ‘অভিনেতা’ পলাশকে বিয়ে করেছিলেন সিমলা। কিন্তু তার অভিনয় তথা অজস্র মিথ্যা, বিশেষ করে প্রথম বিয়েও তথ্য গোপন করার বিষয়টি ধরা পড়ার পর সিমলাই তাকে ডিভোর্স দেন।
এতে বিমর্ষ ‘অভিনেতা মাহিবি জাহান পলাশ’ গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার নামাজে মন দেন। ওই কয়েকদিন তিনি মসজিদে আজানও দিয়েছেন। এরপর আবার বিদেশ তথা দুবাই যাবার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরোন। চট্টগ্রামের টিকেট কেটে দুবাইগামী বিমানেও তিনি চড়েছিলেন। পাইলটকে হুমকি দিয়ে তিনি বলছিলেন বিমান যাতে এর প্রথম গন্তব্য তথা চট্টগ্রামে অবতরন করানো না হয়। খেলনা পিস্তল আর নকল বোমার অভিনয়ের মাধ্যমে ছিনতাই করা বিমানেই কী তিনি দুবাই যেতে চেয়েছিলেন? প্রধানম ন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তিনি কী চাইছিলেন সিমলার স্বামীত্বে ফিরতে?
না সিমলার সঙ্গে কথা বলে তিনি হুমকি দিতে চেয়েছিলেন তুমি আবার আমাকে স্বামী না করলে আমি বিমান উড়িয়ে দেবো? না ভেবেছিলেন যাত্রী সমেত বিমানটি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী-পাইলট বা কর্তৃপক্ষ তার সিমলার স্বামীত্বে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন? ‘অভিনেতা মাহিবি জাহান পলাশ’ ওরফে পলাশ আহমদ নিহত হওয়ার এসব কোন প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর জানা গেলোনা। মিথ্যার বেসাতিতে এভাবেই পলাশদের সৃষ্টি হয়। একবার একটি মিথ্যা বললে তা ঢাকতে গিয়ে বলতে হয় অনেক মিথ্যা। তার চাঞ্চল্য ঘটিয়ে নিহত হবার পর পুলিশ বলেছে এলাকায় তার একটি প্রতারক ধাচের পরিচয় ছিল। বিদেশ যাবার বা বিদেশ নেবার নামে নানান লোকজন থেকে টাকা নিতো। পলাশের বাবা তা অস্বীকার করে বলেছেন, ছেলে তার বখে গিয়েছিল ঠিক, কিন্তু টাকা তিনিই দিতেন। আর সিমলাকে তিনি বলেছিলেন তার স্বামীকে সুপথে আনতে। ‘বিদেশ থাকা প্রযোজক’ স্বামীর এমন প্রতারক চরিত্র জানার পর নায়িকার মন কী আর থিতু থাকে!
প্রিয় প্রজন্ম, পলাশ চরিত্র থেকে শেখার আছে অনেক। তার গানের প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তাড়াহুড়া আর মিথ্যার বেসাতি ঢেকে দিয়েছে সব প্রতিভা। কোন অবস্থায় মিথ্যা বলা যাবেনা। একটা মিথ্যা ঢাকতে অনেক অথবা অবিরাম মিথ্যা বলতে হয়। তোমার প্রতিভা আছে। নিষ্ঠা থাকলে এর বিকাশও হবে। কিন্তু তাড়াহুড়ায় বা মিথ্যার বেসাতিতে নয়। যার যা শিক্ষা ও সামর্থ্য মাথায় রাখতে হবে। স্বপ্ন দেখবে সঙ্গতি অনুসারে। পলাশের জন্যে শোক। খুব রাগ-কষ্টও হচ্ছে। তার সঙ্গে দেখা পরিচয় হলে কাউন্সিলিং করতাম। বোঝাতাম। যথাযথ গাইডেন্স পেলে সে এমন বেপরোয়া বিধবংসী হয়ে উঠতোনা। আমাদের চারপাশে এমন অনেক পলাশ আছে। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, অভিভাবকত্ব দিয়ে তাদের নিরাপদ বিকাশমান পথে নিয়ে আসা সম্ভব।