বলা যেতে পারে মূলতঃ প্রবাস জীবনে উইকেন্ড মানেই, একটুখানি প্রাণের ছোঁয়া, বাড়তি কিছু ফুয়েল যোগ, অন্তত বাকি পাঁচটা কাজের দিন ফুল গিয়ারে চলবার জন্যে।
আমার বাস্তবতা অন্য কিছু কিছু মানুষের মতোই আলাদা। মানে প্রয়োজনেই উইকেন্ডে কাজ করি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো প্রতি সপ্তাহে না হলেও মাসে এক/দুইটা থাকেই। গানপাগল মানুষ আমি, সঙ্গীতের কোন আসর তাই পারতপক্ষে মিস করিনা।
একটু ভূমিকা দিতেই হচ্ছে আজ, কারণ আমার এই ডেডিকেশনে আমি নিজেই অবাক হই মাঝে মাঝে। একটা প্রোগ্রাম দেখতে যাওয়ার পেছনেও থাকে গল্প। প্রিয় পাঠক, আজ প্রিয় এক শিল্পীকে ঘিরে, তাঁর কাছে পোঁছানোর আগের এবং পরের সময়গুলোর প্রিয় কিছু অনুভব তুলে আনবো বলেই লিখতে বসা।
‘’শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ’’ গান বুঝে উঠার পর থেকেই আমার প্রিয় তালিকায় থাকা একজন! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবারই তাঁর একটি লাইভ সন্ধ্যা রোকেয়া হলের কোন এক প্রোগ্রামে দেখার সুযোগ এসেছে। এরপর টিভি আর ইউটিউবে লোড হওয়া গান নিয়ে বানানো তাঁর প্রিয় গানের প্লে লিস্টই আছে সঙ্গী হয়ে যখন তখন।
সেই কুমার বিশ্বজিৎকেই অস্ট্রেলিয়ার যে শহরে আছি, সেখানে পাবো এমন ঘোষণা শুনেই উদগ্রীব হয়ে থাকি। নিজের ঐ দিন সন্ধ্যার কাজ থেকে কিভাবে ছুটি ম্যানেজ করা যায় সব আগেভাগেই করি কিনারা।
হায় উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলোনা আমার তাহলে, কেন নেমে এলো এমন অশনি সংকেত? মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া, ১৩ জুলাই উনি আসছেন, কয়েক মাস আগে থেকে এমন ঘোষণা বদলে হয়ে যায় ২০ জুলাই… ফলাফল আবার সেইরকম এক চাপ হয়ে যায় আমার জন্যে!
কিন্তু ঐ যা বলি আমি, এখন এই সময়ে এসে জীবনে যা যা মিস করেছি শুধু প্রায়োরাটাইস না করতে পেরে এখন তা যতোটা পারি করে নিচ্ছি উশুল আরকি !
২০ জুলাই কাজে আবার ছুটি নেয়ার স্কোপ ছিলনা। তবে যেটা করতে পারলাম, কাজের সময়টা একটু নিলাম বদলে।
স্বামী সন্তানের ডে অফ, তাদের নিজেদের প্ল্যান আমার সাথে না মেলানো গেলে জোর করে মেলাবো তেমন মানুষ আমি নই। তাই তাদের না ঘাটিয়েই চলে যাই এমন কোন প্রোগ্রামে অনেক সময় একাই।
এবার কাজের জায়গায় বাংলাদেশী এক কলিগকে প্রোগ্রামের দিন সকালেই জিজ্ঞেস করছিলাম, আপা আজ কুমার বিশ্বজিৎকে দেখতে যাবো, যাবেন নাকি। উনি একদম সময় না নিয়েই হয়ে গেলেন রাজি এবং এই প্রথম নূতন এক সঙ্গী পাই। অনুষ্ঠান শুরু বিকেল ৫টায়, ভেন্যু থেকে থাকি ২০/২৫ মিনিট দূরত্বে কিন্তু আমাদের রওনা দিতে দিতেই বেজে যায় ৫.১০ এর মত।
আমার নূতন সঙ্গী, কলিগ আপা আমাকে ইনটাইমই পিক করতে আসেন। আমি আবার এমন বাংলাদেশী কোন প্রোগ্রাম দেখতে যাবো আর প্রিয় কোন শাড়ী জড়াবোনা গায়ে এটা ভাবতেই পারিনা। হাতে সময় কম তারপরও কাজ থেকে ফিরে অন্য সব কাজ দ্রুত সেরে শাড়ী সংক্রান্ত বিষয়টার জন্যেই কিনা বাড়তি সময়টুকুন নেয়া।
এমন কোন কনসার্টে যাওয়াটা হলে, শুরু থেকেই আমি চেষ্টা করি মাথা থেকে সব টেনশন আপাত চাপা দিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও উপভোগ্য করে তোলা।
২০ জুলাই, শনিবার… বাসার সামনের রাস্তা থেকে বের হয়ে ফ্রী ওয়েতে উঠেই দেখি কী ভীষণ সুন্দর একটা বিকেল ছোঁয়া আবীর মাখা ধূপ ছায়া সন্ধ্যা। বুক ভরে একটা আনন্দ নিঃশ্বাস নেই। কলিগের সাথে খোশ মেজাজে গপ্পো, আর বাইরের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখেই মাতোয়ারা আমি একটু দেরী হয়ে গেছে, এই নিয়ে কোন চাপ আর নেইনা…
কিন্তু এ কী, আজ সন্ধ্যেটা আমার কোন কারণে খারাপ হতে যাচ্ছে কি? কেন, কেন কেন… ইয়ে না মানে, ছবি উঠাবো দেখি মোবাইল ফেলে এসেছি বাসায়।
ঐ যে বললাম, এমন গানের কোন প্রোগ্রাম দেখতে যাওয়ার আগে কিছুতেই মুড অফ করবোনা, আবার ব্যাক করি। আমার নূতন সঙ্গী কলিগ আপা, শামীমা, উনিও সুপার কুল এক মানুষ। বলে উঠেন, ব্যাপার না, চলেন, নিয়ে আসি। আরো প্রায় ৫/৭ মিনিট নষ্ট হয়ে যায়। কী আর করা…
কিন্তু ভ্যেনুতে পোঁছে দেখি তখনও দর্শক বাইরেই বেশী, চলছে খোশ মেজাজে গপ্পো সপ্পো, ভরসা পাই। কলিগ আপাকে নিয়ে বাইরের কনকনে বাতাসে আধা মিনিট হেঁটে অডিটরিয়াম ফটকের সামনে দাঁড়াতেই আমাদের চায়ের তৃষ্ণা পেয়ে যায় এবং এ দেশীয় ভ্রাম্যমাণ টঙ্গের দোকানের তরুণীর হাতে বানানো ক্যাপাচিনোতেই আপাত স্বস্থি নিয়ে আমরা হই তৃপ্ত।
পরিচিত এবং ফেসবুক পরিচিত অনেককেই বলি, হাই হ্যালো, এর মাঝেই। ছোট করে কেউ কেউ শাড়ীর প্রশংসা বা আমারই (ধরে নেই) করতে কার্পন্য করেননা, আমিওনা, অনেকেই কী সুন্দর করেইনা সেজে এসেছেন!
অডিটরিয়ামে ঢুঁকেই দেখি মঞ্চে উঠে এসেছেন উপস্থাপিকা, ঘড়িতে বোধ হয় সন্ধ্যে ৬টা ছুঁই ছুঁই। উপস্থাপিকার কন্ঠ সপ্রতিভ, কিন্তু শুরুতে সক্কলের মনঃসংযোগের কাজটা আসলে এমন অনুষ্ঠানে ভীষণই এক কঠিন কাজ। সবাই সবার সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। বাচ্চাদের ছুটোছুটি… উপস্থাপিকা, ‘মুনা’ যার নাম… চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার সাধ্যমতন।
যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্যে বলি, কুমার বিশ্বজিৎ এর এই কনসার্টের শ্লোগান ছিল, চার ছক্কা ICC Cricket World Cup Celebration with Kumar Bishwajit। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেমন শুরু করেছিলো, কি জানি অনেক ক্রিকেট ভক্ত বাংলাদেশী দর্শকদের মত আয়োজকদের মনেও হয়তো সে আশাই ছিল, বাংলাদেশ শেষমেশ দারুণ কিছু চমক রাখবেই।
হয়নি, তবে এই স্লোগানের জন্যেই হোক বা আমাদের এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের ব্যক্তিগত সাফল্য গাঁথাগুলো সেলেব্রেশনেই হোক উপস্থাপিকা কুমার বিশ্বজিৎকে নিয়ে অল্প বিস্তর কথা বলেই ক্রিকেট নিয়ে আসেন মঞ্চে।
একটা কুইজ শো, ক্রিকেট নিয়ে… উপস্থাপিকা শুরু করেন তবে আমি নিশ্চিত আমার মত অল্প কিছু সময় কেউ বুঝতেই পারেনি কী হতে যাচ্ছে। মানে একটু অগোছালোই হয়ে যায় বিষয়টা। তবে ঐ যে, আমি আর আমার কলিগ আপা আজ কিছুতেই মনে নেবোনা কোন চাপ… নো নেগেটিভিটি। কুইজ শেষ। সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তরে একটু হাউকাউ মজা করে কজন জিতে নেয় পুরষ্কার। উত্তরগুলো আমারও জানা ছিল, এতোই পিছনে বসেছি, তাই অংশ গ্রহণ… তাছাড়া!
থাক সে কথা, কাংখিত মুহূর্ত এলো এবার। মঞ্চের পেছন এবং দু পাশে রাখা মনিটরে ভেসে উঠে প্রিয় কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর প্রোফাইল। ইউটিউবে কিছু অংশ আগেই দেখা ছিল, তারপরও সব মিলে তাঁকে নিয়ে সাধারণ এবং বিশিষ্ট কিছু মানুষের বলা, তাঁর গান কী ভীষণ ভালোবেসে ছোট্ট অবোধ শিশু থেকে এই সময়ের জনপ্রিয় তরুণ নোবেলের কন্ঠে উঠেছে তারই এক ঝলক উঠে আসে। তাঁকে ভালোবেসে যারা শুনতে গেছেন তাঁদের যে মন ছুঁয়ে যাবে এ তো বলবার অপেক্ষা রাখেনা।
শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথের যন্ত্রীরা আগেই উঠে আসেন মঞ্চে। তবে এই শিল্পীর সাথে বিশেষ করে ড্রাম, ঢোল এবং তবলার মত নানান বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে যে তরুণ আমাদের অনেকের কাছে খুব প্রিয়, সে মিঠুন চক্র। মঞ্চে তাঁর উপস্থিতিতে দর্শকদের উল্লাসই বলে দেয় সবাই তাকে কতোটা পছন্দ করেন।
‘’সালাম বাংলাদেশ’’ মঞ্চের নেপথ্য থেকেই কন্ঠে তুলে কুমার বিশ্বজিৎ উঠে আসেন দর্শকদের মধ্যমণি হয়ে তুমুল আনন্দ উল্লাস ধ্বনির মধ্য দিয়ে।
গানের রেশের মাঝেই তিনি প্রথমেই মেলবোর্ন দর্শকদের অভিবাদন জানান ‘’রেমিটেন্স যোদ্ধা’’ হিসেবে। প্রবাসীদের বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে ভূমিকা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন একজন বাংলাদেশী হিসেবে। আমার পাশে বসা এক দর্শক বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, আমি ওভাবে দেশে টাকা পাঠাইনা যদিও, এই কৃতজ্ঞতাটা হয়তো আমি ডিজার্ভ করিনা, কিন্তু অনেকেই করেন আমি জানি, তারপরও উনি আজ এভাবে বললেন, অন্যরকম এক গর্ব হচ্ছে।
আমাদের গর্বিত করেই আবার ফিরেন তাঁর গান ও কথায়, কী শুনতে চাই আমরা জানতে চান! যা হয়, তাঁর অসংখ্য প্রিয় গানের লিস্ট থেকে প্রায় সব দর্শকই যা চান, তা হচ্ছে ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার’। কজন সমস্বরে বলার চেষ্টা করার আগেই তাঁর রসিকতা, ও আচ্ছা তাইলে পরে এই একটা গান গাইলেই হচ্ছে।
কুমার বিশ্বজিৎ গাইছেন, আমি আসলে হঠাৎ চলে যাই তাঁকে দেখা আমার লাস্ট স্মৃতিতে। ভেন্যু রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ। গান করছেন একের পর এক, চির তরুন এই গায়ক, মেয়েরা উন্মাতাল হয়ে উপভোগ করছে, সেই সঙ্গীত সন্ধ্যা।
প্রায় শেষদিকে এসে যখন ধরলেন ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’’ মঞ্চে তখন কৃত্তিম একটা ধোঁয়া… আমরা যারা মফস্বল শহর থেকে পড়তে এসেছি তাঁদের জন্যে এটা নূতন অভিজ্ঞতা। আমি দর্শক সারির অনেক পেছন থেকে তাকিয়ে আছি, সুরের যাদুতে বুঁদ হতে হতে ভাবছি, এ কী পার্থিব কোন রাত না কী স্বপ্নে দেখা ঘোর লাগা কোন ক্ষণে আছি! মাথায় ঢুঁকে আছে সেই রাতটা। আজ অনেক বছর পর মিস করছিলাম প্রিয় বন্ধুর মুখগুলো যারা সেদিন পাশে ছিল!
কুমার বিশ্বজিৎ কথা বলেন গুছিয়ে। তাঁর কথা আমরা টেলিভিশনে বিচারক হয়ে আসার পর শুনেছি। পছন্দ করেন টুকিটাকি হাস্যরসাত্মক একটা আবহ রাখতে। আজও তেমন পাই আমরা তাঁকে। দর্শকদের কুশলাদি জানতে চান, কারা এসেছেন বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে, স্বাভাবিক ভাবেই চিটাগংয়ের দর্শকদের গলা একটু বেশী শুনা যায়। আওয়াজ দিতে চান আগে ভাগেই।
উনি আবার রসিকতায় বলে উঠেন, কিছুটা আঞ্চলিকতায়, চিটাগংয়ের মানুষ তো এমন অস্থির না… সিলেটের মানুষদের সাথেও হয় যোগসুত্র। হয় ব্রাসেলস না মানে ইয়ে, আমারও জানা ছিলোনা, বাংলার ভেনিস বরিশাল নিয়ে এমন মজাটা। কুমার বিশ্বজিৎ এর কাছেই শুনলাম এবং মজা পেলাম।
গানে ফিরে যান, আবার আসেন এমন টুকিটাকি আলাপে… সিলেট, নোয়াখালির ভাষা উনার ভালো লাগে এমনও জানালেন। গেয়েছেন সিলেটের একটা গান।
আঞ্চলিকতা নিয়ে এমন সব খোঁজ খবর নেয়ার আগে অবশ্য তিনি বলে নেন, আসেন একটু আত্মীয়তা করি। তবে স্বাভাবিকভাবেই চিটাগংয়ের দর্শকদের ছিল, পোয়া বারো। একজনকে ডেকে নিলেন মঞ্চে, কথা বলার জন্যে… তাঁদের সেই ভাষায়। না দর্শক হিসেবে প্রিয় শিল্পীর গানের ফাঁকে এই আলাপচারিতা আমার খারাপ লাগার কোন কারণই নেই। তবে একটু দ্বিধা নিয়েই বলি (অনেক প্রিয় মানুষের বাস ওই শহরে কিনা) চিটাগংয়ের ভাষাটা আমার ভালো লাগেনা, হয়তো কিছুই বুঝিনা বলেই।
কিছু গান পরিবেশন শেষ হতেই বলেন কোন অনুরোধ থাকলে জানাতে, রাখার চেষ্টা করবেন। এবার শেষদিকে টিকেট করেছি বসেছি প্রায় সবার পিছনে। সিদ্ধান্ত নিলাম চিরকুট পাঠাবো। সব সময় যে ব্যাগ নিয়ে চলি সেখানে রাখা আছে কাগজ কলম নোট বুক। হায় ব্যাগ বদলে নিয়ে গেছি, সেটাও আজ মিসিং। এবার নিজের উপর একটু বিরক্ত লাগলোই। আয়োজকদের একজন ছোট ভাইসম সজীব আসেপাশেই কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করছে দেখছিলাম। তার কাছে চাইলাম এক টুকরো কাগজ কলম এবং মিলেও গেলো।
কুমার বিশ্বজিৎ এর অন্তত অর্ধশত গান আমার অসম্ভব প্রিয়। সেখান থেকে ঐ মুহূর্তে কেন যেন এই কনসার্টে যাওয়ার দুই দিন আগে থেকেই অনেকের একটু কম শোনা একটা গান, ‘’দুস্যু যেমন মুখোশ পরে’’ এতো বেশী মনে পড়ছিল আমার। এই গান আমার কেন এত প্রিয় জানিনা, তবে চান্স পেলেই গুনগুণ করি। চারটা গানের প্রথম কলি লিখলাম, এই গানের সাথে। ‘আমি তোরই সাথে বাঁধতে পারি’’ ‘’যে শিকারী চোখে দেখেনা’’ এবং ‘’ছোট ছোট গল্প’’। লিখলাম যেকোন একটা গান করলে খুব খুশী হবো, থ্যাংকস!
সজীবের হাতে চিরকুট দিয়ে অপেক্ষার পালা। উনি গাইছেন… তাঁর গানের তিন যুগেরও বেশী সময় পেরিয়েছে… এই সময়ে এসেও গলায় যে তারুণ্য এবং তাঁর মঞ্চ উপস্থিতি আমি আমার মুগ্ধতা আরো একবার যেন নূতন করে রাখলাম।
সজীব আমার চিরকুট পৌঁছে দিয়েছে কিনা তখনও জানিনা, এর মাঝেই মঞ্চে উঠে আসেন উপস্থাপিকা। স্থানীয় এমপি উপস্থিত আছেন, তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে কিছু সময়ের জন্যে মঞ্চে ডেকে আনছেন…
এমন কিছু হলেই দর্শকদের মাঝে একটা চাপা অসন্তোষ চলে আসে অজান্তেই। বাংলাদেশের দর্শকদের জানা আছে এমন কেউ মঞ্চে এলে কিছু না কিছু বলবেনই। আমিও তেমনটি অনুমান করেই মনে হল, দুই মিনিটের জন্যে টয়লেট হয়ে আসি।
হায়, সেই শুরুতে বাসায় ঘুরে মোবাইল আনতে যাওয়ার পরই মন যে কু ডাক দিয়েছিল। তাই বুঝি ষোল কলা পূর্ণ হল আজ। টয়লেটে পরিচিত এক রেডিও কলিগ, আমাদের পত্রিকা প্রশান্তিকারও কলিগ বলা যায়, মিম আপার সাথে দেখা। দুজনই দুজনকে হঠাৎ আবিষ্কার করে বেসামাল। ফলাফল, দুই মিনিটের জায়গায় ৪ মিনিট।
হাহাঃহিহিঃ সেরে অডিটরিয়ামে ঢুঁকেই শুনি শিল্পী গাইছেন, ‘’ছোট ছোট গল্প’’। আমার সিটে আসার আগেই সজীব এবং অন্য বেশ কজন আমাকে ধরলেন, আরে আপনি কই গেলেন… দাদা আপনাকে খুঁজছেন। আমি ঠিক শুনছি কিনা ভাবতেই ভাবতেই আগাই। সিটে এসে বসার আগেই দেখি আমার সঙ্গী কলিগ আপাও মহা বিরক্ত আমার উপর ‘’উফ এটা একটা কান্ড হলো’’!
ও তাহলে কাহিনী এই যে, শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ আমার চিরকুটটি পড়েছেন এবং নীচে ছোট করে আমার লেখা নাম দেখেই উনি এই গানটি গাওয়ার আগে আমাকে খুঁজেছেন আর সেই সময়ই আমি নেই… কেন কেন কেন!!! আমাকে ঘিরেই আজ কেন এমন হল। হায় আমি কী দোষ করলাম, স্থানীয় এমপিকে অসম্মান এই তার শাস্তি। ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু বুঝতে পারছি একটা ‘’’মোমেন্ট’’ মিস হয়ে গেছে জীবন থেকেই!
আমিও নিজের সবটুকু সপ্রতিভতা দিয়েও মন খারাপটা আর চাপাই দিতে পারছিনা। গান শেষ হলে যে উঠে দাঁড়িয়ে একটা থ্যাংকস বলবো সেই বোধও হারিয়ে ফেলি…
আমার চিরকুট দিয়ে কিনা বুঝতে পারছিনা দর্শকেরা মহা উৎসাহে একের পর এক অনুরোধের কাগজ পাঠাতে থাকেন। অনেকেই তাঁদের বাচ্চাদের পাঠান। এক বাচ্চার চিরকুট পেয়ে উনি আবার বলে উঠেন, এ নিশ্চয়ই তোমার অনুরোধ না, মা না বাবা… বাচ্চাটির উত্তর শুনে উনি যখন শুরু করেন, ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে’’ তখনই আমরা বুঝতে পারি তাঁর কথার মাজেজা।
কুমার বিশ্বজিৎ, অস্ট্রেলিয়াতে নেমেই সিডনী হয়ে এখানে আসেন। টানা প্রোগ্রাম, জেট লগ বলছিলেন একটু ঘুমের সমস্যার কথা তারপরও ক্লান্তিহীন গেয়ে যান একের পর এক গান এবং সাথে রাখেন প্রায় সবার অনুরোধ।
চতুর্দোলা, ও ডাক্তার… তুমি যদি বল, চন্দনা গো, একের পর এক সবার প্রিয় গান গাইতে থাকেন এবং করেন কিছু মজার গল্প, যার কিছু জীবন থেকেই নেয়া।
দর্শকদের অনুরোধ চিরকুট পেয়ে এক পর্যায়ে উনি বেশ আবেগআপ্লুত হয়ে বলেন, বিশেষ করে এখানকার দর্শকেরা যেসব গান শুনতে চাইছেন আমি অবাক হয়ে দেখছি আপনারা কী ভীষণ ভালো কথা এবং সুরের গানগুলো শুনতে চাইছেন।
গানের এই সুর কথা প্রসঙ্গেই বলে উঠেন, আসলে তো এই সময়ে অনেক রকম গান হচ্ছে, গানের মানুষ না তারাও গাইছে। গান আমরা শুধু শুনছিনা, দেখছিও, কিছু গান আমাদের কাছে আজ তাই দেহ সর্বস্ব। একটা ক্ষোভ হয়তো তাঁর মাঝে আছে, কিন্তু বলবার ভঙ্গী স্বাভাবিকই রাখেন তিনি, হয়তো সচেতনভাবেই। এটাও বলেন, ‘’আমি চাই, আমার গান শুনে বাড়ি ফিরে যেয়ে কিছু সময়ের জন্যে হলেও যেন গানের রেশটুকু মনে করতে পারেন আপনারা, মুছে না যায়’’!
একজন কুমার বিশ্বজিৎ তাঁর বিশেষত্ব উনি যখন গান করেন, সাথে থাকা যন্ত্রশিল্পীদের সাথে থাকে দুর্দান্ত বুঝাপড়া, এই মঞ্চেও তা দর্শক হিসেবে আমাদের চোখ এড়ায়নি। আলাদা করে মিঠুন কিছু সময় তাঁর অভিনব ঝংকারেও মাতিয়ে দিয়ে যান মেলবোর্ন দর্শকদের।
রাত বাড়ে, দর্শকদের অনুরোধ যেন আজ থামবার নয়। উনি এক পর্যায়ে বলে উঠেন, আচ্ছা এই সব গান আমিই গেয়েছি? কিন্তু অনুরোধ কারোটাই ফেলেননা। তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয় গান ‘’’মা’’ গেয়ে উঠবার আগে বলে নেন, আমি সকল শ্রেণীর দর্শকের জন্যেই গাইছি আজ, তারপরও যায়া বয়োজ্যৈষ্ঠ আছেন তাঁদেরকে এবং যাঁদের মা আছে বা নেই সবার জন্যেই এই গান।
প্রায় আড়াই ঘন্টা গেয়ে যান তিনি, কোন বিরতি ছাড়াই। ‘’তোমরা একতারা বাজাইয়োনার’’ মত কিছু গানের তালে কিছু দর্শক কয়েক দফা নেচেও নেন মন খুলে, দিল খুলে।
একদম শেষদিকে এসে সবচেয়ে বেশী আসা অনুরোধের দুই গান, ‘তুমি রোজ বিকেলে’ এবং ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’ যখন গেয়ে উঠেন আমি রীতিমত বিস্মিত হই কারণ এই গান যেন সেই দুই যুগ আগে শোনা অবিকল কুমার বিশ্বজিৎকেই আমরা আরো একবার এতো কাছ থেকে শুনছি।
প্রথম দিকের দুই একটা গানে আমার মনে হয়েছে উনার কিছু জায়গা হয়তো কষ্ট হচ্ছে বা অডিওতে আমরা তাঁরই যে ভার্শনটা শুনি সেটা ছাপাতে পারছেননা। কিন্তু এই পুতুলের মত করে সাজিয়ে যেন আসলেই শেষ ওভারে ছয় মেরে দেয়ার মতন করেই গেয়ে উঠেন।
এবার শেষ করতেই হয়… চির তরুণ এই গায়ককে আবার শীঘ্রই দেখা বা এভাবে শোনার সৌভাগ্য হবে কিনা কে জানে, আমার এবার কেন যেন খুব ইমোশনাল লাগে। এমনিতেই প্রিয় গায়ক, কিন্তু এই অল্প সময়ে আরো যেন কাছের এক মানুষ, এক টুকরো বাংলাদেশ।
আহা আজই আমাকে মঞ্চে খুঁজলেন, আর সেই সময়টাতেই ছিলামনা এই শোক ঠেলে উঠে আসতে থাকে আবারও। আচ্ছা কি বলতেন উনি, আমি দাঁড়ালে তখন? হয়তো, জেলা কোথায় উঠে আসতো কি… ময়মনসিংহ শুনে বলতেন হয়তো ‘’ভালা আছুইন”… এমন কিছু। কী আশ্চর্য, ময়মনসিংহ থেকে উঠে এসেছেন এমন একজন শিল্পীর নামও আমার মনে পড়ছেনা কেন, কল্পিত এই কথামালায়ও! ক্রিকেটার ‘মোসাদ্দেক’’ ছাড়া কারো নামই মনে নেই, কী কান্ড… বুঝতে পারছি, অনেকদিন পর আমি আসলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের উত্তেজনায় ফিরে গেছি। প্রিয় শিল্পীকে সামনে দেখে তাই হারালো, হারালো, মন হারালো।
দর্শকদের কাউকে উনি নিরাশ করেননি, অনুরোধ কিছুতেই শেষ হচ্ছিলোনা, শেষে উনি বললেন যার যত গান আছে, এক লাইন হলেও গাইবেন এবং তাই করলেন। বিদায় নিলেন, তাঁর সেই সিগনেচার সং যা একটু আগেই বললাম!
না শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ, উপস্থাপিকা যখন জানালেন দাদা মঞ্চে আবার আসবেন আপনারা সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়ে তুলে নিতে পারেন একটি করে ছবি। এখানেও দেখা গেল, চিটাগং এর দর্শক সবার পুরো দন্ত বিকশিত এবং তাঁরাই এগিয়ে… খুব এলোমেলো না হলেও কেউ কেউ এই সুযোগে ছবি উঠিয়েই যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। আমার পরিচিত এক বড় ভাই রসিকতা করে বলে উঠেন, আপা আপনার কাছে পিন টিন কিছু আছেনি… কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারিনা… বুঝতে পেরে তুমুল হাসি!
আমি এবার নিজেকে ঝাঁকি দিয়ে বলি, না নদী ‘সংকোচের বিহ্বলে হইয়োনা ম্রিয়মাণ’। যাও ভীড় দেখে হতাশ না হয়ে এগিয়ে, আড়ালে তোমার প্রিয় শিল্পী হাসে! আমার সঙ্গী আপা বলেন যান, আমি উঠিয়ে দেব ছবি…
কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্বেও আসলে উনাকে আলাদা করে এক মিনিট পাওয়া আজ দুষ্কর, অগত্যা… কোনভাবে কাছে যেয়ে বলি,
আমি নদী। আপনি আমার অনুরোধের গান দিয়েই শুরু করেছেন, কী সৌভাগ্য আমার, কিন্তু আমি তখন বাইরে ছিলাম দাদা… সরি। আপনি ভালো থাকবেন। উনিও সেলফি পোজ দিতে দিতে বলেন হুম আপনিও ভালো থাকবেন…
উনার মুখে আপনি ডাক শুনে মনে হল… আমার আম্মারও খুব প্রিয় গায়ক উনি এমনকি আমার প্রয়াত নানু একদিন ক্যাসেট প্লেয়ারে ‘’সুখ ছাড়া দুঃখ, দুঃখ ছাড়া সুখ’’ শুনে বলেছিলেন, এ ছেড়ি এই গানটা আরেকবার বাজাতো!
চলে আসতে থাকি, কলিগ আপা আর আমি সবার ভালোলাগা অনুভূতিগুলো নিয়েই ভালোচনা করতে করতেই। উনি এখনও শারীরিক ফিটনেস ধরে রেখেছেন, এটা দুইজনেই খুব এপ্রিসিয়েট করি, শুভকামনা এমন সুস্থ থাকুন উনি।
একটু ক্লান্ত সেইটা আমার চোখ এড়ায়না তবে একজন শিল্পী মানেই ইতিবাচক মানসিকতা এবং সবার সাথে একজন বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে যে মেলবন্ধনটুকু করে দিলেন তা নিয়ে আরো একবার মনে মনে বলি উঠি… ‘’যুগ যুগ জিও প্রিয় কুমার বিশ্বজিৎ’’!!!
পুনশ্চঃ মঞ্চে উনি আমার নাম বলে ডেকেছেন, কিন্তু আমি শুনিনি, এই ঘটনা অনুষ্ঠানের একদিন পর এমনভাবে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। আয়োজক সজীবকে জানিয়ে রেখেছিলাম সম্ভব হলে ফোনে দুই মিনিট কথা বলবো। সবমিলে সময় মেলানো সম্ভব হয়নি। মেলবোর্ন ছাড়ার আগের দিন একটু নাকি অসুস্থও বোধ করছিলেন। তবে কথা হলে খুব ইচ্ছে ছিল, ছোট ৩টা প্রশ্ন করার, ১। গান নিয়ে আর কতদূর যাওয়ার ইচ্ছে তাঁর, পেরেছেন কী নিজের মত জায়গাটায় পৌঁছাতে? ২ তাঁর গানগুলো কোন একটা আর্কাইভে রাখার ব্যবস্থা কি নিজ উদ্যোগে বা অন্য কোন উদ্যোগে করা হয়েছে? ৩। এই সময়ের বাংলাদেশ, একজন শিল্পী হিসেবে কী বলার আছে তাঁর? আমাদের অনেকের মত হতাশ নাকি আশাবাদী… মেলবোর্নের দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা উনি আমাদের সামনে দাঁড়িয়েই করে গেছেন এবং বলেছেন এটা বলার জন্যেই বলা না, উনার মনে হয়েছে খুব ভালো গান শুনেন এবং বুঝেন এমন কিছু দর্শককে উনি আজ পেয়েছেন।
যাই হোক না বলা কথাগুলো রাখি তুলে, ভরে রাখি শুধুই প্রিয় অনুভব, মনেরই রাগ অনুরাগ ভুলে… ওরে মনপাখি, পরাণে রাখি বেন্ধে, এক পশলা বৃষ্টির সুখে’’ নাইবা হলাম আজ ‘’মেঘলা মেয়ে’’ নদীর শূন্যতা যাই ভুলে!