ফজলুল বারী:আবুধাবী বা দুবাই বা শারজাহ যেখানেই যাওয়া হোকনা কেনো বাংলাদেশের আমজনতার কাছে তা দুবাই যাওয়া। দুবাই মানে বাংলাদেশের আমজনতার প্রথম বিদেশ যাওয়া। সিলেট অঞ্চলে যেমন প্রথম বিদেশ যাওয়া ছিল লন্ডন, ব্রিটেনের যেখানেই যাওয়া হোক না কেনো বলা হতো ‘লন্ডন যাইয়ার’, গ্রাম জাগানো চরিত্র ছিল ‘লন্ডনি’, তেমনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্রাম জাগানো চরিত্রটির নাম ছিল ‘দুবাইওয়ালা’। এ নিয়ে ‘দুবাইওয়ালা’ নামের ছবিও হয়েছে। শেফালী ঘোষের একটা গানও আছে এ নিয়ে। আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত ঈদের নাটকের এক পর্বের জনপ্রিয় সংলাপ ছিল, ‘টেকা দ্যান দুবাই যামু’। ফকির আলমগীরের একটি গানের প্রথম কলি, ‘চল সখিনা দুবাই যাবো দেশে বড় দূখরে’। কিন্তু যে যাই বলুক, বাংলাদেশকে দুবাইর পথ দেখিয়েছে দেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজন। সিলেট লন্ডন ফ্লাইট যেমন আছে তেমনি ফ্লাইট আছে চট্টগ্রাম-দুবাই!
মজার ব্যাপার দুবাই গিয়েও আপনি সেখানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজনের দাপট দেখবেন। দুবাই বা আরব আমিরাতের নানান এলাকা যেন একেকটি ছোট ছোট চট্টগ্রাম। সেখানকার আগরের ব্যবসার নিয়ন্ত্রন যেমন বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, দক্ষিনভাগ এলাকার লোকজনের হাতে, তেমন প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী-শ্রমিকদের সিংহভাগ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের। কর্নফুলির মতো সাম্পানও আছে দুবাইতে। পার দুবাই, বার দুবাই অথবা দিয়ারা দুবাই নামের দুটি এলাকার পারাপার হয় সাম্পানে। সেই সাম্পানগুলো যারা চালান বা যারা সাম্পানের মাঝি, দেশেও তাদের একই পেশা ছিল।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের যাত্রী-অতিথি হিসাবে বারবার যেতে যেতে শহরগুলো বড় আপনার হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শহরগুলোতে যে কতবার গেছেন এর হিসাবতো মনে করা কঠিন। আরব আমিরাতের সুলতানের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সখ্য দীর্ঘদিনের। শেখ হাসিনাকে এই পরিবারটি বিশেষ মর্যাদা দেয়। এর ধারাবাহিকতায় খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তৃতীয়বার সেখানে গেলেন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। মর্যাদার দাওয়াতটা যে সেখান থেকে আসে বারবার। এবং সব দাওয়াত কবুল করেন কেনো তিনি তাও জানি। আরব আমিরাতের কাছ থেকে বাংলাদেশের আদায় করার অনেক কিছু আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টার্গেটও আমি জানি। মরুর দেশ থেকে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসতে চান প্রধানমন্ত্রী।
আবুধাবী সাসটেইনেবল উইক, জায়েদ সাসটেইনেবল অ্যাওয়ার্ড সিরিমনি উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দাওয়াত করে নেয়া হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়াটাই আপনার কাছে চাই প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার গত সাত বছর ধরে বন্ধ। অথচ সৌদি আরবের পর আরব আমিরাত-মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারই ছিলো মূল। সৌদি শ্রমবাজার নিয়েও টালমাটাল অবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরে আরব আমিরাতের বন্ধ শ্রমবাজার আবার খুলে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু শ্রমবাজার খোলে নাই। এর ফলোআপ চাই প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আবুধাবী, আরব আমিরাতের সাসটেইনেবেলিটি নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। আরব সাগরের জেলে জীবন তাদের পাল্টে গেছে তেল প্রাপ্তির পর। আর আমাদের এখনও লোকজনকে ঠিকমতো বিভিন্ন দেশে পাঠাতে না পারলে আমাদের চলেইনা।
আর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ মানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো টাকা। ইউরোপ-আমেরিকায় যারা যায় থাকে তারা এক পর্যায়ে নাগরিকত্বও পায়। এদের অনেকে সে সব দেশে বাড়িঘর কিনতে পারলে দেশ থেকে বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের টাকার প্রায় পুরোটা দেশে আসে। কিন্তু দিনে দিনে প্রধান শ্রমবাজার সমূহ থেকে শুধু নেতিবাচক খবর আসছে। এ নিয়ে দেশের মিডিয়ায় যে সব খবর আসে এর বেশিরভাগ প্রকৃত তথ্যভিত্তিক নয়। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার যে শুধুই সংকুচিত হচ্ছে এর মূল সমস্যা সমূহ বাংলাদেশে। কারন বাংলাদেশের জনশক্তি পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি দুর্নীতিগ্রস্ত। জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও যে একটি শিল্প, এ বিষয়টিও যে বিদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, এ বিষয়ের ডিগ্রীধারী অথবা প্রশিক্ষনপ্রাপ্তরা যে এর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে সেটি এখনও বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষের ধারনা নেই।
বাংলাদেশের আমজনতা জানে অমুক অমুক দেশের ভিসা দেয় অমুক দালাল বা এজেন্সি! ভিসা দেবার মালিক যে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস, অন্য কেউ নয় সেটা মানুষকে জানাতে-জানতে হবে আগে। বিদেশের কোথাও এখন আর অদক্ষ জনশক্তির কাজ পাবার কোন সুযোগ নেই, যে দেশে যাবেন সে দেশের ভাষা অন্তত অনর্গল বলতে-বুঝতে পারতে হবে। ভ্রমনের ভিজিট ভিসাকে বেশিরভাগ সরল মানুষ জানেন ফ্রি ভিসা! এটি দিয়ে নাকি যে কোন দেশে গিয়ে যে কোন কাজ করা যায়! অথচ ভ্রমন ভিসায় গিয়ে যে ভারতে গিয়েও কাজ করা যায় না বা ভারত থেকে কেউ ভ্রমন ভিসায় কেউ বাংলাদেশে এলেও তাকেও কাজ করতে দেয়া হবেনা, এটা যদি কেউ জানেন তারা কিভাবে ভাবেন ভ্রমন ভিসায় গিয়ে অচেনা, ভিন ভাষার দেশে গিয়ে কাজ করে ফেলবেন! বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত শ্রমবাজারের এসব ভুলগুলো আগে না ভাঙ্গালে শ্রমবাজারের গতি ফিরবেনা।
সাত বছর ধরে আরব আমিরাতের শ্রমবাজার বন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশিদের যাওয়া বন্ধ নেই। দালালরা টুরিস্ট ভিসায় লোকজন নিয়ে যাচ্ছে। এরপর পাসপোর্ট আটকে রেখে আরও টাকা আদায় করে তাদের পাসপোর্টে লাগাচ্ছে ইনভেস্টর ভিসা! এটি বিনিয়োগকারীদের ভিসা। এই ভিসাওয়ালারা সেখানে কাজ করে লুকিয়ে। বাংলাদেশি অনেকে এদের দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা না দিয়ে ঠকায়। যে কোন দেশের ভাষা সম্পর্কে ভালো দক্ষতা থাকলে তার কাজের অভাব হয়না। বাংলাদেশের লোকজনের এই ভাষা দক্ষতার সমস্যা পয়লা নাম্বার সমস্যা। ভুল ভিসা, ভাষা সমস্যা এসবের কারনে যাদের প্রথম ইমপ্রেশনটাই খারাপ হয় তাদের সেখান থেকে ফিরতে লাগে অনেক সময়।
আমি এখানে যে সমস্যাগুলো লিখলাম তা খুব ভালো করেই জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় এ তথ্যগুলো উঠে আসে। আরব আমিরাতের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে এবারের সফরকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে। বর্তমান জনশক্তি মন্ত্রী ইমরান আহমদকে অনেক বেশি আন্তরিক মনে হয়। আরব আমিরাতের বন্ধ বাজার খুলে গেলে সেটি সরকারের জন্যে শেখ হাসিনার জন্যে আরও সাসটেইনেবল হবে। লেটস স্টার্ট প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। কিছুদিন আগের ভাষনে বলেছিলেননা, আপনার ওপর ভরসা রাখতে। ভরসা রাখলাম।