ফজলুল বারী:বিলাতে দুটি বাড়ি কিনতে টাকা পাচারের জন্য ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার স্ত্রী ও দুই মেয়ের বিরুদ্ধে প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা পাচারের মামলা করেছে দুদক। বিষয়টি আমার কাছে স্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য মনে হয়। বাংলাদেশে এমন শত শত নাজমুল হুদা আছেন যারা এভাবে দুর্নীতির টাকা পাচারের মাধ্যমে বিদেশে বাড়ি-সম্পদ কিনেছেন। কিন্তু তাদের কাউকে কখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি। বিদেশে তারেক-কোকোর কত টাকা আছে তাও কেউ জানেনা। দুর্নীতি আড়াল করতে বিএনপি ছেড়েও শেষ রক্ষা হয়নি নাজমুল হুদার। এটিই ইতিবাচক। বিএনপি আমলে নাজমুল হুদার কথাবার্তাগুলো মনে করতে পারেন। তখন তিনি বলতেন জনগন তাদেরকে পাঁচবছরের জন্যে নির্বাচিত করেছে। তাই এই পাঁচ বছর তারা যা খুশি করতে পারেন! সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাকে বলতেন বেহুদা। নির্বাচিত হলেই যে যা খুশি তাই করা যায়না এর জবাব দেবার জন্যে নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে এসব মামলা, তাকে বিচারের আওতায় আনা দরকার ছিল।
২০০৬ সালে আমি বিলাতে যাই। লন্ডনে শাওন-সেনা নামের আমার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু থাকতেন। সেনা’র সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওই এলাকার একটি বাড়ি দেখিয়ে বলা হয় এটি নাজমুল হুদার বাড়ি। বাংলাদেশ থেকে টাকা এনে বাড়িটি নগদ টাকায় কেনা হয়েছে! ইউরোপ-আমেরিকায় যারা থাকেন তারা জানেন নগদ টাকায় বাড়ি কেনার সামর্থ্য খুব বেশি মানুষের নেই। নগদ টাকায় কেউ বাড়ি কিনতে গেলে তার টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এরজন্যে একজন ক্রেতা বাড়ির মূল্যের নির্দিষ্ট পরিমান ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে মর্টগেজ চুক্তি করেন। মর্টগেজের বাকি অর্থ ব্যাংককে শোধ করতে হয় তিরিশ বছরে। আবার এইসব দেশেই বিভিন্ন দেশের নাজমুল হুদাদের দুর্নীতির পাচারকৃত অর্থে বাড়ি কেনার ব্যবস্থা আছে। দুর্নীতি বিরোধী দেশ হিসাবে সিঙ্গাপুরের বিশেষ নামডাক আছে! আবার সিঙ্গাপুরে নেমে পাসপোর্ট ভিসা দেখিয়ে আমি একটি ব্যাংকে একাউন্ট করে যা খুশি টাকা জমা করতে পারবেন! আবার নির্ধারিত ফী দিয়ে সেই টাকা ট্রান্সফার করতে পারবেন যে কোন দেশের ব্যাংকে! বাংলাদেশে কিছু দুর্নীতিবাজের টাকা এভাবেই পাচার হয়ে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেছে!
নাজমুল হুদা বিএনপি আমলে তথ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকতে প্রতিদিন সরকারি বিজ্ঞাপন বিলি বন্টনের দুর্নীতির হাট বসতো ডিএফপিতে। ফকিরাপুল-আরামবাগ এলাকার প্রেসগুলোতে প্রতি রাতে ছাপা হতো বেশকিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা। এগুলো বাজারে পাওয়া যেতোনা। একই কম্পোজড ম্যাটার দিয়ে ছাপা হতো চার-পাঁচটি অথবা এরও বেশি পত্রিকা। অথবা মফঃস্বলের নানা পত্রিকার বিজ্ঞাপনও এখান থেকে বিকিকিনি হতো। এভাবে প্রচারবিহীন পত্রিকাগুলোতে জনগনের টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন বিলিবন্টনের হরিলুটের টাকার প্যাকেট মন্ত্রী থেকে নানান যথাস্থানে চলে যেতো! এ নিয়ে পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুসন্ধান এসবকে তেমন আমল-পাত্তা দেয়া হতোনা। ইনকিলাব-মানবজমিন-দিনকাল এসব ছিল সবচেয়ে বেশি সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া পত্রিকা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যাকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয় নাজমুল হুদা ফর্মূলায় তার কাছেও পৌঁছে যেত বিজ্ঞাপন বিকিকিনির হরিলুটের টাকার ভাগ! সেই সৎ মানুষটি (!) এখন ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে সৎ (!) রাজনীতির মহড়ায় ব্যস্ত!
বিএনপির সর্বশেষ মেয়াদে যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন নাজমুল হুদা। তাদের একটি পারিবারিক মানবাধিকার এনজিও আছে। রেলওয়েও তখন যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের অধীনে ছিল। সচিবালয়-আব্দুল গনি রোডের মাথায় আনন্দবাজার এলাকায় রেলওয়ের একটি বেশ বড়সড় একটি জমি ছিল। সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজমহলের জন্যে তাজমহল বানিয়েছিলেন। আর যোগাযোগ মন্ত্রী নাজমুল হুদা তার স্ত্রী সিগমা হুদাকে রেলওয়ের জমি লিজ দিতে পারবেননা সেটা কি করে হয়! অতএব সেই জমি দেয়া হয় সিগমা হুদার মানবাধিকার এনজিওকে। তবে এই পরিবারটি যে লন্ডনে দুইখানা বাড়ি কিনতে অন্য জায়গায় কষ্ট করতে হয়েছে।
সবাই জানতেন নাজমুল হুদা যোগাযোগ মন্ত্রী থাকলেও এর নানাকিছুর দিকভাল করতেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকো। খালেদা জিয়ার বড়ছেলে তারেক হাওয়া ভবন চালান, বিএনপি চালান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার অনেক বদনাম ছড়ান, কিন্তু কোকোর কোন বদনাম নেই! কোকো নামের যে লঞ্চগুলো হয়েছিল সেগুলোও করেছিলেন তারেক আর তার মামারা। যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে কী করতেন কোকো? কিছুই করতেননা। এখন ঢাকা শহরে সবুজ রঙের সিএনজি নামের গাড়িগুলো যে অহরহ যাত্রীদের জিম্মি করে সেগুলো বিএনপির সেই আমলে আসে। ভারতে তখন এগুলোর দাম ছিল ৫৫ হাজার টাকা, কিন্তু বাংলাদেশে ভারতীয় প্রতিটি সিএনজির জন্যে এক জায়গায় জমা দিতে হতো ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা! ভারত বিরোধী দল বিএনপি তখন বাংলাদেশে ভারতীয় লক্করঝক্কর গাড়ির একচেটিয়া বাজার করে দিতে তখন জাপানী রি-কন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল!
দুষ্ট লোকেরা বলতো এই সিএনজি-ভারতীয় গাড়ি আমদানি সহ যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের ছোটবড় সব ঠিকাদারি-কেনাকাটার নিয়ন্ত্রন ছিল কোকোর হাতে! কোন প্রমান নেই, কিন্তু টাকা যে বেশি ঢালতেই হতো তা ওয়াকিফহালরা জানেন। সেই যে বেশি টাকায় বাধ্যতামূলক সিএনজি আমদানির দায় যাত্রীদের ঘাড়ে দিতে গিয়ে এই যানবাহনটি যাত্রীদের ঘাড় মটকাতে থাকলো সে অভ্যাস তাদের আর যায়নি। যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের নানান বদনাম যেহেতু কোকোর নামে যাচ্ছিল নাজমুল হুদার আয় রোজগার নিয়ে কোন বদনামই হয়নি! বদনাম জানা যাচ্ছিল লন্ডনের বাড়ি কেনাকাটার সময়ে। লন্ডনে গিয়ে দেখি নাজমুল হুদার বাড়ি কেনা আর বিলাতের বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে তার টাকা মেরে দেবার কেচ্ছা-কাহিনী প্রবাসী কমিউনিটির মধ্যে প্রায় ওপেন সিক্রেট! সাংবাদিকরা বললেন বিএনপির অমুক নেতার মাধ্যমে নাজমুল হুদার টাকাকড়ি এসেছিল। সেই টাকাকড়ির একটা অংশ মেরে দিয়েছিলেন বিএনপির ওই নেতা! ব্যারিষ্টার সাহেব এ নিয়ে মনে বড় দূঃখ পেয়েছেন। কিন্তু মুখ খুলে প্রকাশ্যে কাউকে বলতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এ নিয়ে একটা উপমা আছে, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’।
১/১১ আসার পর তারেক-কোকো দু’জনেই গ্রেফতার হন। নাজমুল হুদাকেও গ্রেফতার করা হয় তখন। দাসখত দিয়ে চিকিৎসার জন্যে তখন বিদেশে চলে যান তারেক-কোকো। ওই অবস্থায় বিদেশে মৃত্যু হয় কোকোর। তারেক-কোকোর পরিবার এখন লন্ডনে থাকে। বিদেশে সবাইকে কাজ করে খেতে হয়। কিন্তু এই পরিবারগুলোকে কোনদিন কাজ করতে হয়নি। দুর্নীতির বিচার থেকে বাঁচতে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী নাজমুল হুদা যোগ দেন আওয়ামী শিবিরে। প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ওরফে দরবেশ চাচার সঙ্গে তার চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক। কিন্তু তেলে আর জলে যেমন মিলেনা তেমনি জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী আওয়ামী শিবিরে যে ‘যুইত’ করতে পারেননি তার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযান-মামলা চলমান এর প্রমান। গুড জব শেখ হাসিনা, গুড জব দুদক। অন্তত একটি দৃষ্টান্ত হোক। মিসেস হুদার বোন ও এনজিও ব্যক্তিত্ব খুশি কবীর বিভিন্ন টিভির টকশোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেন। তার ভগ্নি-ভগ্নিপতির দুর্নীতি নিয়ে কোথাও কিছু কোনদিন বলেছেন কী খুশি কবীর?

fazlulbari2014@gmail.com