ফজলুল বারী:আওয়ামী লীগের বৈঠকে যেভাবে সামাজিক শিষ্ঠাচারপূর্ন কাশির নমুনা প্রদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন তা দেখেই মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি একটি মডেল ছবি-বক্তব্য হবে। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তা প্রচার শুরু করে। বাংলাদেশের করোনা যুদ্ধ নিয়ে অনেকের অভিযোগের অন্ত নেই। কেনো সরকার আরও আগে মাঠে নামলোনা, কেনো প্রবাসীদের আটকালোনা, শেষ নেই এমন অভিযোগের।
যেখানে এই যুদ্ধে আমেরিকা-ব্রিটেন থেকে শুরু করে দুনিয়ার রাঘল-বোয়ালদের কাহিল অবস্থা সেখানে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় বাংলাদেশ যুদ্ধে যে ভালো সামাল দিচ্ছে তা রোগটির এখনও নিয়ন্ত্রিত অবস্থা তা জানান দেয়। অনেকের অভিযোগ যেখানে পর্যাপ্ত টেস্টই হচ্ছেনা সেখানে প্রকৃত রোগী সংখ্যা কিভাবে জানা সম্ভব। রোগটা যদি বাংলাদেশে মহামারী আকার নিতো তাহলে অভিযোগকারীরাই কি সুস্থ থাকতেন? শেখ হাসিনা এরমাঝে একটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন তাহলো দুঃস্থ লোকজনের ঘরে খাবার চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী-সিভিল প্রশাসনের নেতৃত্বে এটি চলছে বলে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে দুর্নীতির কোন অভিযোগ উঠেনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর নেতৃত্ব দিচ্ছে পুরো করোনা যুদ্ধে।
এখন পর্যন্ত একটা মোটা দাগের ব্যর্থতা লোকজন অনেক ক্ষেত্রে সাধারন সর্দি জ্বরেও চিকিৎসা পাচ্ছেনা। কিডনি রোগী, শ্বাস কষ্টের রোগীরা কষ্টে আছেন। চিকিৎসক সংগঠনগুলো সরকারের কব্জায় থাকলেও সরকার এখানে জিম্মি। এমনকি শেখ হাসিনাও! করোনা যুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরাই নায়কের ভূমিকায়। তারা যুদ্ধে আছেন। মারা যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের এই গোষ্ঠী শুরু থেকেই এই নেই সেই অভিযোগ নিয়ে আছে। অনেকে ছুটিতে চলে গেছেন। বাংলাদেশে করোনা ব্যাপক ছড়ালে এই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী অনেকের পালিয়ে বেড়ানো নিয়ে বড় সংবাদ সৃষ্টি করতে পারে। সোমবার জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে এ বিষয়টি কেউ তোলেননি!
জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও সম্মেলন শুনছিলাম গাড়ি চালাতে চালাতে। দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনার নিজস্ব স্টাইলের বিশেষত্বটি হচ্ছে নানান তথ্য তাঁর নখদর্পনে থাকে। এরজন্যে তিনি নানান আলোচনায় প্রানবন্ত অংশগ্রহন করতে পারেন। তিনি যে আত্মবিশ্বাসী এটা প্রমান করে তাঁর বডিল্যাঙ্গুয়েজ। প্রধানমন্ত্রীকে কোথায় তেল মারা হচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারেন বলে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের থামান। এরজন্যে ভিডিও কনফারেন্সগুলো উপভোগ্যও হয়।
ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা আইইডিসিআর’এর পরিচালক। দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করতে করতে এখন খুব পরিচিত একটি মুখ। চমৎকার ব্রিফিং করেন। এরজন্যে সরকার বিরোধীরা তাঁকে ভীষন অপছন্দ করা শুরু করেছেন। এক পত্রিকায়তো তাঁকে নিয়ে রিপোর্টও করা হয়েছে। ফ্লোরার ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠায় আইইডিসিআর’এর ভিতরেও তাঁর বিরোধীরা সক্রিয়। সে জন্যে তাঁর শাড়ির ছবিও সেখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া হয়েছে। এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা ভাইরাল করেছেন তারা তাঁর পারিবারিক পরিচয়ও জানেননা। কিন্তু ফ্লোরা সেখানে টিকে থাকার কারন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন। কারন প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ব্রিফিং পছন্দ করেন।
সোমবারের ভিডিও কনফারেন্সে ডাঃ ফ্লোরাও ছিলেন। বক্তব্য শুরুর আগে একফাঁকে তিনি তাঁকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান। ডাঃ ফ্লোরার বক্তব্য পিক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দেন। এতে করে সোমবার অনেকে একটি বার্তাও পেয়েছেন। ডাঃ ফ্লোরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন পিপিইর অপব্যবহার হচ্ছে। যারা করোনা রোগীর চিকিৎসা করবেন তাদের সংস্পর্শে যাবেন তাদেরই শুধু পিপিই দরকার। কিন্তু এখন যাকে তাকে পিপিই দেয়া হচ্ছে বা তারাও চাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা চান ডাঃ ফ্লোরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন তাঁর বক্তব্য পিক করে এ ব্যাপারে আইইডিসিআর একটি নির্দেশনামূলক পোস্টার ছাপতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন যাদের পিপিই দরকার তারা পিপিই পাচ্ছেনা। অন্যরা পিপিই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এমনও হয়ে গেছে অনেকের রান্নাঘরেও পিপিই ঢুকে গেছে।
এক সিভিল সার্জন বলেন অনেক সাংবাদিকও টেলিভিশনের লাইভে যাবার জন্যেও তার কাছে পিপিই চান। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন সাংবাদিকদের এমন পিপিই দরকার হলে তারা তা বানিয়ে নিতে পারেন। ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তায় যোগ দেন সরকার প্রধান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সহ অন্যরা ‘সব আছে’র কথা বলছিলেন। কিন্তু এই ‘সব আছে’র তথ্যতো শেখ হাসিনার জানা আছে। এর কারনে প্রধানমন্ত্রী নিজের থেকে জানতে চাইছিলেন কী নেই সেটা বলতে। বিভিন্ন এলাকায় যে লোকজন সাধারন সর্দি জ্বর নিয়েও হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেননা, এটি একজনও সেখানে বলেননি।
বাংলাদেশে তালিকাভূক্তদের মধ্যে দশ টাকা কেজিতে চাল, ভিজিএফ তালিকাভূক্তদের মধ্যে মাসিক তিরিশ কেজি করে বিনামূল্যে চাল বিলির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রিকশা-ভ্যান চালক, ছোট চা-দোকানির মতো লোকজনকে তালিকাভূক্ত করতে তাদেরকে চাল-ডাল-লবন-তেল, হাত ধোয়ার সাবান পৌঁছে দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন কোথাও যাতে কেউ খাবার বা কোন কারনে সমস্যায় না পড়েন। চা বাগানের শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যাবার, জনসমাবেশের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন না করার সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রী মূলত এই ভিডিও কনফারেন্স চলাকালীনই দিয়ে দেন। জেলা প্রশাসকদের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের কোথায় রোগী আছে কোথায় নেই এটা মোটামুটি জানা গেলেও প্রধানমন্ত্রী অনুসন্ধিৎসু হয়ে আরও খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করছিলেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নিয়ে তাঁর উদ্বেগ লুকোছাপা রাখেননি তিনি। নানাকিছুতে বাংলাদেশের সামর্থ্য কম, কিন্তু শেখ হাসিনার সক্রিয় নেতৃত্ব এই যুদ্ধেও দেশের বড় সামর্থ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন প্রয়োজনে অন্য দেশকেও সহযোগিতা দেয়া হবে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্য বাংলাদেশের সামর্থ্যেরও জানান দেয়।