সিডনির বেলমোরের পিলপার্কে নব নির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে এর ব্যাখ্যা দিতে আয়োজক কমিটি গত ৬ মার্চ বিকেলে এক চা-চক্রের আয়োজন করেন। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে চা চক্রের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় । একে একে কমিউনিটির কয়েকজন ব্যক্তি নবনির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। উপস্থিত অনেকেই তাঁদের মনে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিতে থাকেন আয়োজক কমিটিতে যারা কাজ করেছিলেন তাদেরকে ।
লিঙ্কন শফিউল্লাহ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করতে গিয়ে জোর দিয়েই বলেন “এই স্মৃতিস্তম্ভটি সিডনির বাঙালিদের, আর আমরা কয়েকজন কার্যকরী কমিটির সদস্য এইটা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি করে থাকি, প্লিজ আসুন আলোচনা করে এর সমাধান করি। কোন রকম কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে আমরা আমাদেরই ক্ষতি করছি । আমাদের ভুল হতেই পারে, কারন আমরা মানুষ। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না এই দেশে আমরা সংখ্যালঘু এবং অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ভাবেই এগিয়ে যেতে হবে ।”
কমিউনিটির ব্যক্তিদের বক্তব্য একটু লম্বা ছিলো। যা অনেকের কিছুটা বিরক্তি উৎপাদন করেছে। চা বিরতি দিয়ে প্রশ্নপর্ব শুরুর আগে এই নতুন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্তম্ভ নিয়ে কাউন্সিলর হুদা সংক্ষেপে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ” প্রথমেই পরিষ্কার করা উচিত এটি একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার নয়। প্রথম থেকেই সেটা বলা হয়েছে এবং কাউন্সিলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে আবেদন জমা দেয়া হয়েছিলো। ২০১৮ সালে ক্যানটাবুরি ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের মিটিংয়ে তাঁদের এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে আবেদনটি পাশ করেন। সেই সময় লিবারেল পার্টি থেকে শাহে জামান টিটুও একজন কাউন্সিলর ছিলেন। এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরীর জন্য মোট খরচ হয় ৪৫০০০ ডলার যার মধ্যে কমিউনিটি ফান্ড রাইসিং ডিনার থেকে আসে ৩৬০০০ ডলার এবং বাকী ৯০০০ ডলার আসে কাউন্সিলের তহবিল ‘রোসল্যান্ড ওয়ার্ড ফান্ড ‘ থেকে । সমস্ত টাকা একটি একাউন্ট এ জমা পরে যার হিসাব বিবরণ হলো CBC Mother LMC, BSB :06211, Account : 11246361. এই হিসাবের যাবতীয় তথ্য কাউন্সিলে রক্ষিত আছে এবং যে কেউ সেটা জানতে চাইলে জানতে পারবেন ।”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভ কেনো বাংলাদেশের প্রচলিত শহীদ মিনারের আদলে করা হলো না?
এই প্রশ্নের জবাবে, মুনির বিশ্বাস বলেন, “অস্ট্রেলিয়া সরকার পৃথিবীর অন্য কোথাও তৈরী করা কোন নকশা অবলম্বনে কোন স্থাপনা হুবহু তৈরীর বিপক্ষে। কারণ এটা করতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব কপিরাইট আইন ভঙ্গ হয়। তাই সেই বিষয়ে খুবই সতর্কতা মেনে ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও প্রথমেই বাংলাদেশের শহীদ মিনারের আদলে নকশা করা বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিস্তম্ভটির সম্পূর্ণ নতুন একটি নকশা করা হয়। আর প্রাথমিক নকশাটি করেন পার্থ প্রতিম বালা।”
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবরে করা ফান্ড তোলার জন্য সবার কাছে ‘পার্থ প্রতিম বালার’ একটি নকশা দেখানো হলেও বাস্তবে যে স্মৃতিস্তম্ভটি হয়েছে সেটার কোন মিল নেই কেনো?
এই প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর হুদা বলেন, “পার্থ প্রতিম বালার তৈরী নকশা বাস্তবায়ন করতে ১০০০০০ ডলারের বেশী খরচ হবে দেখে, কাউন্সিল সীমিত বাজেটের মধ্যে পরিবর্তন করে নকশা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ হাই কমিশনেই সাহায্য প্রার্থনা করেন। সিডনির কনসাল জেনারেলের সাহায্য নিয়ে, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ সহায়তায় নতুন নকশা তৈরী করে সেটা বাস্তবায়ন করে যেখানে সবার উপরে বাংলাদেশের পতাকা, একজন মা ও দুইটি শিশু দৃশ্যমান এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের আঁকা ছবির মতো দুই গুচ্ছে ১০ টি করে মোট ২০টি ফুলের ছবি আছে। আর বিপরীত অংশে আমাদের কাউন্সিলের সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত প্রথম ৫ টি ভাষায় লেখা দৃশ্যমান রয়েছে।”
কেনো এই নকশার পরিবর্তন নিয়ে সিডনির বাংলাদেশী কমিউনিটিকে জানানো হলো না?
এই প্রশ্নের জবাবে হুদা বলেন, “কোভিড ১৯ এর নিষেধাজ্ঞার কারণে কাউন্সিলের ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য প্লানিং সংক্রান্ত ব্যক্তিরা জুম মিটিং করে শুধু কাজটির দিকেই মন দিয়েছেন এবং আমিও একই কারণে অনেক সময় আপডেট নিতে পারিনি । তাছাড়া আমাদের ডেটলাইন ছিলো ২১ ফেব্রুয়ারীর। তার কয়েক সপ্তাহ আগেও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার কারণে এই বিষয়ে কমিউনিটির লোকজনের সাথে খোলা আলোচনা করে অবহিত করা যায়নি । অবশ্যই কমিউনিটিকে অবহিত করতে পারলে এই ভুল বুঝাবুঝির অবসান হতো । ”
উদ্বোধন খুবই সীমিত করার পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য ছিলো?
এর উত্তরে হুদা বলেন, “প্রশ্নই উঠে না। কোভিড ১৯ নিষেধাজ্ঞা থাকার কারনে সরকারি সমস্ত নিয়মের মধ্যে থেকে খুবই সীমিত পরিসরে উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত কাউন্সিল নেয় । নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা আছে।”
কমিউনিটির মধ্যে এক ধরনের দাবি উঠেছে যে , এই নকশা বিকৃত এবং বাংলাদেশকে অপমান করা হয়েছে?
এই প্রসঙ্গে নোমান শামীম বলেন, “অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি নাগরিকের বাকস্বাধীনতা আছে এবং কারো স্বাধীনতায় কেও হস্তক্ষেপ কেও করে না। সবাই তাদের ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারে। ”
সবশেষে কাউন্সিলর হুদা বলেন, ” আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হলে, কমিউনিটি এক হয়ে কাজ করতে হবে । আমরা বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ানরা অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার অনুপাতিক হারের কাছে খুবই অল্প। যদি নিজেদের মধ্যে বিভক্ত থাকি, তাহলে সামনের দিনগুলোতে কাউন্সিল, রাজ্য সরকার এবং ফেডারেল সরকারকে আমাদের ইতিবাচক পদক্ষেপ গুলো তুলে ধরতে খুবই কস্টকর হয়ে যাবে। তাই আসুন আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য হাতে হাত মিলিয়ে সামনের দিনগুলো কমিউনিটির পাশে দাড়াই। আগামীতে নতুন নতুন নেতৃত্ব আসছে, আসবে। তারা যেনো কমিউনিটিকে নতুন কিছু দেবার বিষয় আমাদের কাছে শিখতে পারে।”