নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগের কবর খুঁড়ছে আওয়ামী লীগ

নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগের কবর খুঁড়ছে আওয়ামী লীগ

ফজলুল বারী: নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, আইভী রহমানের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। এটা তাদের পূর্ব পুরুষের দ্বন্দ্ব থেকে এখনও চলমান। ওসমান পরিবার আর আলী আহমদ চুনকা পরিবারের দ্বন্দ্ব পুরনো। আলী আহমদ চুনকার মেয়ে আইভী। চুনকাও নারায়নগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।

কিন্তু ওই সময় আওয়ামী লীগ চুনকাকেও প্রার্থী করেনি। চুনকা তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় বোমা হামলা শুরু হয়। নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় আওয়ামী লীগ অফিস বোমায় লন্ডভন্ড হলে তাতে  বিপুল হতাহতের ঘটনা ঘটে।

আমাদের সঙ্গে শামীম ওসমানের সম্পর্ক তখন থেকে। বোমার ঘটনার পর সিএমএইচে অনেকদিন ছিলেন শামীম ওসমান। কিন্তু তখন তিনি বোমায় আহত ছিলেননা। সেখান থেকে তিনি প্রায় ফোনে কথা বলতেন। এরও অনেক আগে এরশাদ আমলে শামীম ওসমানদের ফুফু’র সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা।

তাকে আমরা নীলা ভাবী ডাকতাম। ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলামের স্ত্রী ও ব্যারিষ্টার তানিয়া আমিরের  মা, আমাদের নীলা ভাবী শামীম ওসমানদের আপন ফুফু। এরশাদ আমলের শামীম ওসমানদের বড় ভাই নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলে ক্ষুদ্ধ হন নীলা ভাবী।

আমাদের তখন তিনি বলেছিলেন, তাকে তিনি তার বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে শামীম ওসমান কানাডায় চলে যান। নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ তখন অভিভাবকহীন, বিধবস্ত ছারখার  অবস্থায়। নেতাকর্মীদের কেউ বাড়িতে থাকতে পারছিলেননা।

দলের এমন এক অবস্থায় পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে আলী আহমদ চুনকার মেয়ে ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীকে নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে এনে তাকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনের নিউজ কভার করতে নারায়নগঞ্জ যাতায়াতের সময় আইভীকে আমরা প্রথম কাছে থেকে দেখি।

উদ্দিপ্ত আইভী নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১/১১ এর পর নির্বাচন উপলক্ষে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে শামীম ওসমান-জয়নাল হাজারী এদেরকে প্রার্থী করেনি।

আবার নারায়নগঞ্জকে সিটি কর্পোরেশন করলে এর প্রথম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে শামীম ওসমানকে। আইভী সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। কিন্তু দল তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রিপোর্ট দেয় আইভী জিতবেন ভোটে।

ওই সময় কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পার্থের নারী মেয়র দেখা করতে গেলে শেখ হাসিনা তাকে বলেন আমরাও খুব শীঘ্রই একজন নারী মেয়র পেতে যাচ্ছি। খবরটি পেয়ে বাংলাদেশে রিপোর্টটি পাঠালেও তা ছাপা হয়নি।

আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া হয়তো মনে করেছিল নির্বাচনের আগ মূহুর্তে রিপোর্টটি ছাপা হলে তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান ভোটে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন! ভোটের দিন দুপুরবেলা র‍্যাবের লোকজন শামীম ওসমানকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে দেয় তিনি যাতে আর না বেরোন!

তাকে বলা হয় ঢাকা থেকে তারা এই নির্দেশ পেয়েছেন। বিপুল ভোটে শামীম ওসমানকে হারিয়ে জয়ী হন আইভী। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী মেয়র। এরপর আওয়ামী লীগ তাকেই নারায়নগঞ্জ সিটি নির্বাচনে প্রার্থী করছে। প্রতি নির্বাচনের সময়ই সামনে চলে আসে শামীম ওসমান-আইভী দ্বন্দ্ব।

নির্বাচনী আইন অনুসারে একজন এমপি হিসাবে শামীম ওসমান প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারেননা। কিন্তু শামীম ওসমান ও তার ভাই জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান যে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারানোর কাজ করছেন এমন গোয়েন্দা রিপোর্ট এখন সরকারের হাতে।

এরজন্যে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর কবির নানক সহ আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার নাম উল্লেখ না করে শামীম ওসমানকে সতর্ক করেও কোন ফল পাচ্ছেনা। ‘বেঁচে থাকতে আর কোনদিন নৌকা পাবেনা’ এমন হুমকিও দেয়া হয়েছে। ফলাফল শূন্য।

এরপর সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যানরা প্রতিপক্ষের প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে গেলে বিস্ফোরিত হন সেলিনা হায়াত আইভী। তিনি বলেন, তৈমুর আলম খন্দকার গডফাদার শামীম ওসমানের প্রার্থী। তিনি বিএনপি বা জনগনের প্রার্থী নন।

নারায়নগঞ্জের এই শামীম ওসমান-আইভীর দ্বন্দ্বে ফেসবুকের ব্যক্তি-গ্রুপগুলোও বিশেষ সক্রিয়। এরা সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। আইভীকে শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিলেও তাদের বেশিরভাগ শামীম ওসমানের সমর্থক। শামীম ওসমানের মতো এরাও চান আইভী হারুক।

কিন্তু শেখ হাসিনা যে এই নির্বাচনে হারতে চাননা এর প্রমান নানাভাবে দিয়েছেন। ফোন করে দিয়েছেন তাঁর আইভীর কী খবর। জাহাঙ্গীর কবির নানক ‘জীবন থাকতে আর নৌকা পেতে দেবোনা’ হুমকিতে শামীম ওসমানরা কিছু বলেননি। মনে কষ্ট পাননি। অথবা পাত্তা দেননি।

কিন্তু আইভী যখন বলেছেন, গড ফাদার শামীম ওসমান তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন! শামীম ওসমানও আজকের পত্রিকা পত্রিকাকে বলেছেন তাকে গডফাদার বলে শেখ হাসিনাকে অপমান করেছেন। এভাবে শামীম ওসমান, তার মুরিদান সবাই যার যার মতো করে শেখ হাসিনার অপমান নিয়ে চিন্তিত!

কিন্তু আইভী হেরে গেলে তাতে কি শেখ হাসিনার অপমান হবেনা? ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমনিতে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগারদের লন্ডভন্ড অবস্থা। নারায়নগঞ্জে-ফেসবুকে আওয়ামী লীগাররা দেশের মানুষকে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে হয়!

দূঃখিনী এক নেত্রীর নাম শেখ হাসিনা। যিনি দিনেরাতে পরিশ্রম করে একক উদ্যোগে এই দলটিকে ক্ষমতায় এনেছেন, ক্ষমতায় ধরে রেখেছেন। আর ক্ষমতার কারনে পেটমোটারা শেখ হাসিনার কথা একবারও ভাবলোনা। নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেদের কবর খুঁড়ছে।