ফজলুল বারী: উপমাটি পুরনো। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমন শুরুর পর উপমাটি আরও প্রাসঙ্গিক। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করেছে। কাজটা খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু এখনতো সেটি শুধু ইউক্রেন আক্রমনে সীমিত-সীমাবদ্ধ নয়। যুদ্ধ চলছে সর্বাত্মক। সামরিকের পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধও।
যুদ্ধটা এখন আর শুধু রাশিয়া-ইউক্রনের মধ্যে সীমিত-সীমাবদ্ধ নয়। দুনিয়াতে এমন যুদ্ধ পরিস্থিতি থামাতে জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভারসাম্যের কথা বলে শুরু থেকে এটি হয়ে গেলো আমেরিকার বশংবদ সংস্থা! বলা হয় আমেরিকা জাতিসংঘকে চাঁদা দেয় সবচেয়ে বেশি।
চাঁদা মানে টাকা। টাকা দেখলে হাঙ্গরের মুখও নাকি হা হয়! আর এটাতো জাতিসংঘ। এবার দেখা গেলো শুধু জাতিসংঘ না, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর মতো ঋন-ব্যবসার সংস্থাও আমেরিকার হয়ে রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে!
জাতিসংঘের আরেক কথিত ভারসাম্যের নীতি ভেটো পাওয়ার। এটার জন্যেও এই সংস্থাটির বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে দাঁত নেই চোখ নেই! করে শুধু ফোঁসফাঁস। এসবের বাইরে এই সংস্থা আমেরিকা যা বলবে সেটা বাস্তবায়নের কাজ করে। আগে রাখঢাক রেখে কাজ করতো। এখন রাখঢাকও বাদ!
রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর এই আক্রমন থামাতে জাতিসংঘের মতো একটা মুরব্বি প্রতিষ্ঠান দরকার ছিল। সেটা পাওয়া যায়নি। উল্টো এটিকে দিয়ে আমেরিকার পছন্দমতো প্রস্তাব পাশ করিয়ে রাশিয়াকে আরও উস্কানো হয়েছে। আমেরিকার এই উস্কানির প্রথম কাজ হলো তাকে একঘরে করে দাও!
বাংলাদেশের ফতোয়াবাজরা এক সময় গ্রামে অপছন্দের মানুষকে একঘরে করতো। আমেরিকা এবার রাশিয়াকে সফলভাবে একঘরে করেছে। ১৪১ টি দেশ মিলিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে। আমেরিকা এখন এই ১৪১টি কুমিরছানা দেখিয়ে সবাইকে বলছে এরা সবাই আমার!
আর এই কুমিরছানারা কোরাস গেয়ে বলছে ইয়াংকি স্যার, আপনি যা বলেছেন সব ঠিক আছে। এখন গোনা হচ্ছে আমেরিকার পক্ষে কারা নেই তাদের মাথা গোনার! বাংলাদেশের জন্মবিরোধী দেশ আমেরিকা র্যাব ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একদফা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে হয়তো আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল-ব্যক্তি-মিডিয়াও চায় আমেরিকা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক। এদেস্র কাছে দেশের চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আক্রোশটা বড়।
আমেরিকা এরমাঝে এটা সেটা বলে একে একে দুনিয়ার সবকিছুতে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি ভিসা-মাস্টার কার্ড ব্যবহারেও। ম্যাকডোনাল্ড-কোকাকোলা-পেপসি সবাই ব্যবসা বন্ধ করেছে রাশিয়ায়! মার্কিন এসব প্রতিষ্ঠান অবশ্য ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে পটু!
এখন রাশিয়ায় এসবের ব্যবসার টাকাতো আমেরিকায় আনা যাবেনা। এই সুযোগে এসব পন্যের রাশিয়ান বিকল্পের প্রসার ঘটবে। ভারতেও এক সময় কোকাকোলা-পেপসি এসব ছিলোনা। ইউক্রেন হামলা করলে এসব নিষেধাজ্ঞার চাপ আসবে তা নিশ্চয় ভ্লাদিমির পুতিন জানতেন।
কিন্তু এতোটা হবে তা নিশ্চয় জানতেননা। সব মিলিয়ে এই আক্রমন-যুদ্ধ আমেরিকা-রাশিয়া কারোরই কোন পূর্ব ধারনামতো হয়নি। তিন-চারদিনের মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের সবকিছু দখল করে নেবে এমন ধারনা থেকে আমেরিকা নানান পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল।
এই চিন্তা-পরিকল্পনা থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভেলোরেমির জেলেনস্কিকে সরিয়ে নিয়ে প্রবাসী সরকার করতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু জেলেনস্কি যে এভাবে একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন তা রাশিয়া-আমেরিকা এটা কেউ শুরুতে ভাবতে পারেনি।
এমন একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ যেখানে ইউক্রেনের নারী-শিশু শরণার্থী হলেও সমর্থবান পুরুষরা যুদ্ধ করতে দেশে রয়েই গেছে। আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো দেশের বেসামরিক লোকজনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেছে ইউক্রেনে! এরজন্যে এই যুদ্ধ এখন আর শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নয়।
এই যুদ্ধ এখন আর শুধু আমেরিকার রাশিয়াকে সাইজ করার যুদ্ধ নয়। আমেরিকা-ন্যাটো এরা শুধু এখন অফিসিয়েল যুদ্ধে নেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু ইউক্রেনকে অর্থ-অস্ত্র-বেসামরিক যোদ্ধা সব দিচ্ছে। পশ্চিমা মিডিয়ার এক তরফা প্রচারের দাপটে যুদ্ধের সঠিক তথ্য নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন আছে।
এর সবকিছু মিলিয়ে রাশিয়াকে যে বেপরোয়া করেছে তা সাম্প্রতিক নানাকিছুকে স্পষ্ট। কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমা মিডিয়ার নিউজ দেখে দেখে অভ্যস্ত তারা আহ উফ করে বলি রাশিয়া কেনো শুধু দেখে দেখে গোলাপ ফুলের বাগান দেখে দেখে বোমা ফেলেনা কেনো।
নগরে আগুন লাগলে যে দেবালয়ও রক্ষা পায়না। ইরাকের সব ভবনের মাথায় সাদ্দাম হোসেনের বড় একটি ছবি অথবা ভাস্কর্য ছিল। সে সব ছবি-ভাস্কর্য টার্গেট করতে যে কত ভবন তখন ধংস হয়েছে। ইরাকের ঘটনা যেহেতু পশ্চিমা মিডিয়ার চোখে বিপ্লব ছিল তখন এ নিয়ে আহ-উফ লেখা হয়নি।
আল জাজিরা টিভিতে দেখানো হচ্ছিল ইউক্রেনের মারিওপোল শহরের শিশু হাসপাতালে বোমা ফেলার পর উদ্ধার কর্মীরা নিহতদের লাশ গর্তে ফেলে দিচ্ছে। ইউক্রেনের দাবি মতো এরমাঝে রাশিয়ার কয়েক হাজার সৈন্য মারা গেছেন।
সেই লাশগুলো কোথায় ফেলে দেয়া হলো বা কবর দেয়া হলো সে ছবি কেউ একবারও দেখালোনা! ইউক্রেন আক্রমনের শুরুতে অনেকে মনে করেছিল ইউক্রেনের রুশভাষীরা রাশিয়ার পক্ষ নেবে। কিন্তু সেটা হয়নি। মানুষ সব সময় বিজয়ীর পক্ষে থাকে।
সে কারনে বাংলাদেশেও অনেক মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিল তারা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখে। কে জিতবে তা নিশ্চিত হতে পেরে সেই মিছিলে যোগ দেয়না। ইউক্রেন যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে তা এখনও কেউ জানেনা।
সেই জনপদের শীতকাতর আবহাওয়া রাশিয়ার অনুকূলে। এরজন্যে আমেরিকা থেকে যারা যুদ্ধে এসেছেন তারা কোথায় যুদ্ধ করছেন সে ছবি এখন পর্যন্ত কোন পশ্চিমা মিডিয়া দেখাতেও পারেনি। আবার রুশভাষী ইউক্রেনীয়রা কেউ রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে এমন প্রমানও নেই।
এসব নানান হতাশা রাশিয়ার বেপরোয়া ভাব বাড়িয়ে তুলতে পারে। যুদ্ধের ধংসযজ্ঞের পশ্চিমা মিডিয়ার যত ছবি আমরা দেখছি তা দেখে মনে হবে ইউক্রেনে পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে রাশিয়া। একের পর এক শহর ধংসের সঙ্গে বিমান বন্দর-বিদ্যুৎ-টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধংস করে দিচ্ছে।
যেটা ইরাকে করেছিল আমেরিকা। হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইসরাইল লেবাননের বৈরুত বিমান বন্দর ধংস করে দেয়। আমাদের তখন সিরিয়ার দামাস্কাস থেকে সড়কপথে বৈরুত যেতে হয়েছে। যুদ্ধের কৌশলগত অংশ হিসাবে ইউক্রেনের পারমানবিক কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রন নিচ্ছে রাশিয়া।
পশ্চিমা মিডিয়ার রিপোর্টে এ নিয়ে বিস্তর আহ-উফ হচ্ছে! যেনো০ রাশিয়া দেখে দেখে শুধু গোলাপ ফুলের বাগান দেখে বোমা ফেলছেনা কেনো। রাশিয়াকেও দ্রুত থামাতে হবে। এই যুদ্ধ ইউক্রেনের মতো একটি শস্য ভান্ডার দেশকে শেষ করে দিচ্ছে।