ফজলুল বারী:ছবির নাম ছুটির ঘন্টা। ঈদের ছুটি উপলক্ষে সেই স্কুলেও ১১ দিনের লম্বা ছুটি হয়েছিল। স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী সবাই স্কুলের সবকিছু তালা মেরে বাড়ি চলে যান। কিন্তু তাদেরই এক ছাত্র যে তখনও টয়লেটে ছিল তা কেউ খেয়াল করেনি।
ওই অবস্থায় টয়লেটে আটকা থাকতে থাকতে ভয়, ক্ষুধা, তৃষ্ণায় শিশু ছেলেটির করুন মৃত্যু হয়। এমন একটি সত্যি ঘটনা নিয়ে ছবিটি বানানো হয়। ছবিটির নাম ‘ছুটির ঘন্টা’। পরিচালক আজিজুর রহমান। আশির দশকে নির্মিত অন্যতম ব্যবসা সফল ছবিটি তখন দেশের মানুষের মনে দাগ কেটেছিল।
ছবিটি দেখেননি বা দেখে কাঁদেননি এমন দর্শক বিরল ছিলেন সেই আমলে। সত্য সাহা’র সুরে ছবির দুটি গান তখন ভীষন জনপ্রিয় হয়। ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো, নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো’ গানটি গাইতে গাইতে তখন অনেকে কেঁদেছেন।
ছবিতে গানটি ব্যবহার করা হয় একাধিকবার । যে ছেলেটি স্কুলের টয়লেটে আটকা পড়েছিল, ছবিতে তার নাম ছিল খোকা। মাষ্টার সুমন খোকা চরিত্রে মর্মস্পর্শী অভিনয় করেন। ছবিতে তার করুন মৃত্যু চিহ্নিত হবার পর করুন সুরে যখন ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো’ গানটি বাজানো হয়, তখন কোন পাষানের চোখও শুকনো থাকতে পারেনি।
ছবিটি বানানোর গল্পটাও দারুন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ফতেহাবাদ গ্রামে ইউনিট নিয়ে ‘অশিক্ষিত’ ছবির শ্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন পরিচালক আজিজুর রহমান। ওই সময় ঢাকায় জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে আনে সে দেশের উগ্রবাদী সংগঠন রেড আর্মির একটি দল।
জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায়। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন জিয়াউর রহমান যুগে দেশে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হচ্ছিল। জাপানি বিমান ছিনতাই সেই ঘটনার সূত্র ধরেও দেশে তখন একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে।
আজকের মতো মোবাইল ফোন ইন্টারনেট তখন ছিলোনা। সহজলভ্য ছিলোনা টেলিফোনও। কারও বাড়িতে একটি ল্যান্ডলাইন ফোন থাকা মানে তারা প্রভাবশালী অথবা বনেদী পরিবার। এমন এক সময়ে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মাঝে দেশের সেই পরিস্থিতিও ছিল গুজবে ভারাক্রান্ত।
প্রোডাকশন ম্যানেজারকে দিয়ে ঢাকার বেশ কিছু পত্রিকা আনান আজিজুর রহমান। বাংলার বানী পত্রিকায় ‘একটি মর্মান্তিক দূর্ঘটনা’ শিরোনামের খবরে তাঁর চোখ আটকায়। নারায়নগঞ্জের একটি স্কুলের ছূটির সময় একটি ছেলে টয়লেটে আটকা পড়ে প্রান হারিয়েছে।
সঙ্গে থাকা স্কুলের টিফিন আর টয়লেটের পানি খেয়ে শেষ কয়েকদিন কিভাবে ছেলেটি বেঁচেছিল তা দেয়ালে লিখে রেখে যায়। আজিজুর রহমান ঘটনা নিয়ে একটি ছবি বানাতে চান। কিন্তু কোন প্রযোজককে রাজি করাতে পারেননা। কারন তখনও নায়ক-নায়িকা কেন্দ্রিক ছবির যুগ।
নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক গল্পবিহীন এমন একটি ছবিতে লগ্নি করতে রাজি হননা কেউ। সত্য সাহা’র ‘অশিক্ষিত’ ছবিটি তখন তিন-চার কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। আজিজুর রহমান সত্য সাহাকে তাঁর পরিকল্পনার ‘ছুটির ঘন্টা’ ছবিটিতে লগ্নি করতে রাজি করান।
ছবির ছুটির ঘন্টা বাদক হিসাবে নায়করাজ রাজ্জাককে নির্বাচন করা হয়। ‘অশিক্ষিত’ ছবির প্রায় একই রকম চরিত্রেও রাজ্জাক তখন সুপার ডুপার হিট। মূল শিশু চরিত্রে মাষ্টার সুমন। ছবির প্রযোজক এবং সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার বড় ছেলে সুমন সাহা।
একদিন আজিজুর রহমান তাঁর কাকরাইলের অফিসে দেখেন ধাঙ্গড় পরিবারের এক মেয়ে অফিসেরই একটি টেবিলে বসে বিড়ি ফুঁকছে। স্বামীর জ্বর থাকায় সে স্বামীর বদলে অফিস ঝাড়ু দিতে ক্লিন করতে এসেছে। তখন বিশেষ ধাঙ্গড় পাড়ার পুরুষ-মহিলারাই শুধু ক্লিনিং জব করতেন।
তখন তাঁর মাথায় আসে ছুটির ঘন্টা বাদক তথা স্কুলের দপ্তরি রাজ্জাকের বিপরীতের চরিত্রটি হবে ঝাড়ুধারনীর। আজিজুর রহমানের বেশিরভাগ সফল ছবির নায়িকা ছিলেন শাবানা। ঝাড়ুধারনীর চরিত্রেও শাবানাকে নির্বাচন করা হয়। চরিত্রটি বুঝতে শাবানাকে ধাঙ্গড়পাড়ায়ও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কিন্তু স্বল্প বাজেটের ছবিটি তখন আটকে দেয় সেন্সরবোর্ড। তারা যুক্তি দেখিয়ে বলেন এ ছবি দেখে বাচ্চাদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আজিজুর রহমান তখন একদল অভিভাবক ও তাদের বাচ্চাদের ছবিটি দেখার ব্যবস্থা করেন।
তারা চোখ মুছতে মুছতে ছবি দেখেছেন, কিন্তু কোন বাচ্চা বলেনি যে ছবিটি দেখে তারা ভয় পেয়েছে। এরপর সেন্সরবোর্ড ছবিটি ছেড়ে দিলেও এর মুক্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সিনেমা হলের মালিকরা নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক আবেদনবিহীন ছবিটি দেখাতে রাজি হচ্ছিলোনা।
তখন সিনেমা শিল্পই দেশের মূল বিনোদন মাধ্যম। নতুন একটি ছবি একযোগে শতাধিক সিনেমা হলে মুক্তি পেতো। কিন্তু ছুটির ঘন্টা ছবিটি তখন এক রকম হল মালিকদের হাতে পায়ে ধরে মাত্র কুড়িটি সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া গিয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাবার পর বদলে যায় দৃশ্যপট।
দর্শকদের ঢল নামলে যে সব সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছিল সেগুলোয়তো চলছিল, অনেক সিনেমা হলে মাসের পর মাস ধরেও চলেছে ব্যবসা সফল অন্যতম সেই ছবি। আজিজুর রহমান অনেক ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ‘ছুটির ঘন্টা’ ছবিটির জন্যে যুগ যুগ ধরে মানুষ তাকে মনে রেখেছে।
বিদেশ বিভূঁইয়ে কানাডার হাসপাতাল থেকে তাঁর যখন মৃত্যু সংবাদ এলো, তখনও ছুটির ঘন্টা’র ছবির কথা এসেছে প্রায় সব মিডিয়ার শিরোনামে। কানাডায় ছেলেমেয়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন আজিজুর রহমান। অনেক বছর ধরে সেখানেই তিনি থাকতেন।
বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায় ভুগছিলেন ৮২ বছর বয়সী এই কিংবদন্তীর চলচ্চিত্র নির্মাতা। অতঃপর সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে ছুটির ঘন্টা বাজলো তাঁর। মেয়ে বিন্দি রহমান বলেছেন, কিছুদিন ধরে দেশে যাবার জন্যে তাঁর বাবা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তারা তাকে আটকে রেখেছিলেন।
তাঁকে আর আটকে রাখা গেলোনা। অতঃপর দেশেই ফিরে আসছেন আজিজুর রহমান। তবে লাশ হয়ে। সান্তাহারের পারিবারিক কবরস্তানে তাঁর শেষশয্যা হবে। ভাল থাকবেন আজিজুর রহমান। আপনাদের কারনে তখন বাংলাদেশের সিনেমার জগতটা অনেক ভালো ছিল।
নিজের ছুটি হবার পর, আপনিতো চলে গেছেন ‘অনেক দূরের নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারিয়ে।’