ফজলুল বারী: ঈদে মানুষজনের বাড়ি যাবার ভোগান্তি বন্ধ করা দরকার। প্রতি বছর প্রতি ঈদে উৎসবে এটিই যেন আমাদের দেশের মানুষের নিয়তি। একটা টিকেট পেতে মানুষের যে সময় লাগছে আজকের যুগে সেই সময়ে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার দূরবর্তী গন্তব্যেও চলে যাওয়া যায়। এমন টিকেটও তাদের শান্তি দেবেনা।
যাত্রার দিন দেখবে ঘাড়ের ওপর মানুষ। ট্রেন ভর্তি গাদাগাদি শুধু মানুষ আর মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের নাড়ির টান আর সামাজিক বন্ধনের কারনে ঈদে পুজায় উৎসবে সবাই যার যার বাড়ি যেতে চায়। এই নাড়ির টান আর সামাজিক বন্ধনের কারনেই বাংলাদেশ সরকারের রেমিটেন্স আয়টি এতই বিশাল।
উন্নত বিশ্বের মানুষ উৎসবের বা লম্বা ছুটি কাটানোকে বলে হলিডে। তারা আমাদের মতো বাড়িতে টাকা পাঠায়না। হলিডে কাটাতে তারা দেশেবিদেশের বিভিন্ন ট্যুরিজম স্পটে, ক্রুজে অথবা অভিযানে যায়। জীবনটাকে তারা উপভোগ করে। আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কোনভাবে পার করা জীবন।
ভ্রমন মানে তাদের কাছে বড়জোর কক্সবাজার, বান্দরবান, সুন্দরবন, জাফলং, মাধবকুন্ড, রাতারকুল দেখা। সামর্থ্যে কুলালে অনেকে যান নানান রিসোর্টে। অনেকে ঈদে বাড়ি গেলে যান কাছাকাছি কোন ট্যুরিজম স্পটে। বেশিরভাগের ঈদে বাড়ি যাওয়া চাইই চাই।
উৎসবটা তারা প্রিয়জনের সঙ্গে শেয়ার করতে চান। ঈদের দিন সকালে মা-বাবা সহ মুরব্বিদের সালাম করে ঈদের নামাজে যাওয়াই সামাজিক রীতি। বাড়িতে তারা জাকাত-ফিতরা-কুরবানি দেন। তার-তাদের সব অর্জন-প্রাচুর্য তারা দেখাতে চান গ্রামের মানুষকে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন আর পরিবহন বিশৃংখলায় যানবাহনের চাপে ঢাকা সহ প্রধান শহরগুলোর জীবন দিনদিন স্থবির হয়ে পড়ছে। যানজটে ধংস হচ্ছে মূল্যবান সব কর্মঘন্টা। কিন্তু উৎস্যবের সময় দেখা যায় দেশের কাছে পর্যাপ্ত যানবাহন নেই। ভাড়া কখনও কখনও সব ধারনাকেও অতিক্রম করে।
এত উন্নয়ন, কিন্তু মানুষের ভোগান্তির শেষ আর হয়না। দেশের সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার চেয়ে এসব এখনও অপ্রতুল। এবার ঈদে অনলাইনে ট্রেনের টিকেটের চেষ্টা করতে গিয়ে পুরো ব্যবস্থাপনাই ভেঙ্গে পড়েছে।
এরমানে দেশের প্রয়োজনের তুলনায় ইন্টারনেট সামর্থ্য এখনও পর্যাপ্ত নয়। যানবাহনের অভাবে ঈদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন-বাস-লঞ্চের ছাদে, ট্রাকে করে যান। এতে করে প্রতিবছর ঈদ যাত্রাকে কেন্দ্র করে বহু মানুষ হতাহত হন।
যে বছর মানুষ কম মারা যান, সে বছর সরকারের পক্ষে দাবি করা হয় আমাদের ব্যবস্থাপনার কারনে এবারে মৃত্যু কম হয়েছে! আসল ঘটনা ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে! অনলাইনের গল্পবলার সময় এবার একটা টিকেটের আশায় কমলাপুর রেলস্টেশনে মানুষজনকে তিরিশ ঘন্টারও বেশি সময় অবস্থান করতে হয়েছে!
আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার দূরতম গন্তব্যেওতো এরচেয়ে আগে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। স্টেশনে অপেক্ষমান মানুষের বিশেষ করে মহিলাদের টয়লেটের ব্যবস্থা নেই! স্টেশনের লোকজন টয়লেট তালাবদ্ধ করে যায়! মোটকথা প্রতিবার ঈদ যাত্রা নিয়ে কি নৈরাজ্য! নীতি নির্ধারকদের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
কারন তাদের রাজকপালের জন্যে ক্ষমতার সময় এসব ভোগান্তি পোহাতে হয়না। টিকেট হেঁটে তাদের বাড়িতে চলে যায়। অথবা যার যার সরকারি গাড়ি, সর্বক্ষনিক ফাই-ফরমাশ খাটার লোকজনতো আছেই। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ঈদ শুভেচ্ছায় ছবি তুলতে অনেকে ঈদে বাড়িও যাননা।
এবার ঈদযাত্রার অভ্যন্তরীন ফ্লাইটগুলোর টিকেটও আগেভাগে ফুরিয়েছে অথবা কব্জা করা হয়েছে। এসব অব্যবস্থাপনার প্রতিকার হওয়া দরকার। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। সরকার কোনভাবেই দেশের মানুষজনের ঈদ ভোগান্তি লাঘব করতে পারছেনা।
তবে ভোগান্তি লাঘবে সরকারের চিন্তা-চেষ্টা আছে। দরকার নতুন চিন্তা। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিমদের দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। সে দেশের মানুষজনও ঈদে বাড়ি যান। এরজন্যে সরকারিভাবে ঈদ উপলক্ষে ফ্রি যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়।
বলা হতে পারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অত যানবাহন নেই। আগে ইচ্ছাটা ঠিক করুন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিন। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রথমে এক্ষেত্রে সরকারি পরিবহনপুলের গাড়িগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। ঈদের ছুটিতে যেগুলো অলস পড়ে থাকে। এসব চালকদের মানব সেবায় উৎসায়ী করুন।
ঈদ যাত্রায় তাদের বেশি পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। হজের সময় বাংলাদেশ উড়োজাহাজ ভাড়া করে। ঈদ উপলক্ষে সারাদেশের মানুষজনের ব্যক্তিগত গাড়ি রিক্রুট-ভাড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভারত-নেপালের সঙ্গে আলোচনা করেও ভাড়া করা যেতে পারে বাস-ট্রেন-উড়োজাহাজ।
বানিজ্যিকভাবে তারাও এই সময়ে বাংলাদেশে তাদের সার্ভিস পরিচালনা করতে পারে। অথবা তাদের পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন সেক্টরে আরও অধিক সংখ্যক বাস ক্রয়ের বিষয়ে উৎসাহ-প্রনোদনা-ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এসব বাসে করে তারা ব্যবস্থা করতে পারে ঈদ উৎসবের সময় তাদের শ্রমিকদের গ্রামের বাড়ি যাতায়াতের। মোটকথা মানুষকে সহায়তার নীতি নিতে হবে। ঈদের গৃহহীনদের বাড়ি উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালজয়ী একটি কাজ করেছেন। উৎসবে মানুষের ফ্রি যাতায়াতের ব্যবস্থাও হবে কালজয়ী আরেক পদক্ষেপ।
একটা গাড়ি কেনা বাংলাদেশে এখনও সামাজিক স্ট্যাটাস। ব্যক্তিগত গাড়ি অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন গাড়ি চালানোর জায়গা কমছে। এসব গাড়িতে যানজটের ভিতর বসে থেকে থেকে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস এসব রোগ বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা নিরুৎসাহ করা দরকার।
এখন সবার জন্যে বাস-পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট কেনার বিষয়টি সামাজিক আন্দোলনের মতো নিতে হবে। বড়লোকরা যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে চেক দেন তাদের সেভাবে বেশি বেশি বাস কিনে এর চাবি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে উৎসাহিত করতে হবে।
ঈদ-উৎসবের সময় এসব বাস কাজে লাগানো হবে মানুষের নাড়ির গ্রামে ফ্রি যাতায়াতের। বছরে বাকি সময় সে সব বাস নগর পরিবহন বা ট্যুর অপারেটরের কাছে ভাড়া দেয়া যেতে পারে। সরকার চাইলে এসব নিয়ে আয়োজন করা যেতে পারে আলোচনা-ওয়ার্কশপের।
সেখানে পরিবহন-যানবাহন বিশেষজ্ঞরা কী-নোট পেপার পড়বেন। সবাই যার যার অভিজ্ঞতা-প্রস্তাবনা শেয়ার করবেন। মোটকথা মানুষের উৎসবকে আনন্দমুখর করতে গড়ে তুলতে হবে নতুন নতুন ব্যবস্থাপনা। মানুষের উৎসবে যাতায়াতে সহায়তার সুযোগ বাড়াতে হবে।
মানুষকে দিতে হবে ঈশ্বরের সম্মান। শুরুতে প্রতিটি জেলা-উপজেলা থেকে সরকারি উদ্যোগে ফ্রি পরিবহনের পাঁচ-দশটি করে বাসের বহর চালু করা হোক। ক্রমশ এর সংখ্যা বাড়বে। এটি হতে পারে সরকারের আরেকটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। মানুষকে সহায়তা দিলে মানুষ এর প্রতিদান দেবে।