ফজলুল বারী: আমরা যারা বাইরে থাকি, দেহটা বিদেশে থাকলেও মনটা সারাক্ষণ থাকে দেশে। এখন সারাক্ষণ দেশে থাকা যায় দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো অথবা টিভি চ্যানেলগুলোয় চোখ রেখে। সময় টিভি, এটিএন নিউজ, যমুনা টিভির মতো নিউজ চ্যানেলগুলো ইউটিউব চ্যানেলে সর্বক্ষণ দেখা যায়।
একাত্তর টিভি, ডিবিসি’র মতো নিউজ চ্যানেলগুলো অনিয়মিত দেখা যায় ইউটিউব চ্যানেলে। বঙ্গবিডি সহ নানান এ্যাপের মাধ্যমেও দেখা যায় দেশের অনেক চ্যানেল। ইন্টারনেট সস্তা-সহজলভ্য হয়ে যাবার পর এটা সম্ভব হচ্ছে। প্রথম আলো, বিডিনিউজ, আজকের পত্রিকা এসব আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য সংবাদসূত্র।
বিএনপি ঘরানার সংবাদ সবার আগে পেতে আমরা মানবজমিন অনলাইনেও চোখ রাখি। আমরা যখন দেশের সর্বশেষ খবর জানতে অনলাইনে বসি তখন একটার পর একটা নিউজ পোর্টালে চোখ বুলিয়ে যাই। অনেক সময় অনেক নিউজ আসে ইনবক্সে অথবা ফেসবুকের নিউজ ফিডে।
সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতনের খবর মূলত দেশের মূলধারার মিডিয়ায় আসার আগে ফেসবুকেই আসে। অনেকে নিজেদের আড়ালে রাখতে নানান নিউজ লিংক ইনবক্স বা হোয়াটসআপ নাম্বারে চালান করে দেন। এসবের সত্যমিথ্যা যাচাই করতে আমরা বারবার দেশের মূলধারার মিডিয়ার অনলাইন পোর্টালে যাই।
অনেক সময় যাচাই-বাছাইর স্বার্থে অনেকে এসব নিউজ দেরিতে ছাড়েন। সেলফ সেন্সরশীপে অথবা অতি সতর্ক অনেকে এমন অনেক নিউজ ছাড়েনইনা। বিশেষ করে প্রথম আলো যেহেতু নাঙ্গা সরকারি তলোয়ারের নীচে থাকে সর্বক্ষণ, এমন স্পর্শকাতর খবর পোষ্ট করতে তারা সাতবার চিন্তা করে।
কিন্তু নিউজের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রমান হাতে আসার পর প্রথম আলো সাধারনত কোন নিউজ কিল্ড করেনা। এরজন্যে প্রথম আলো এখনও সবার ওপরে। বিদেশে থাকা আমরা যেহেতু দেশের সংবাদ সূত্রগুলোর সঙ্গে এভাবে সর্বক্ষণিক কানেক্টেড, অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবার আগে আমরাই নিউজটির শেয়ার অথবা প্রতিক্রিয়া দেই।
একাধিক কারনে এবারের ঈদ বাংলাদেশের জন্যে অন্য রকম এক ঈদ। রোজার শেষ মূহূর্তে মারা গেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তিত্বের ৮৮’ বছরে মৃত্যু হয়েছে। মন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি থেকে তিনি অনেক আগেই স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন।
যা আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিক করেনইনা। ড ইউনুসের অবসরের বয়স নিয়ে তারা উতলা হয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের কোন অবসরে যাবার নাম নেই! সাজেদা চৌধুরী, রওশন এরশাদ, নায়ক ফারুকদের তালিকায় মুহিত সাহেব নিজের নাম তোলেননি। এই অফিসগুলোর সঙ্গে জনগনের অর্থও জড়িত।
সুবর্না মোস্তফা টিপ কান্ড নিয়ে বক্তব্য রাখার পর অনেকে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, সংসদ সদস্য হিসাবে তিনি কত পান! এদের ভাবখানা এমন ছিলো যেন, সংসদ সদস্য হিসাবে ভাতা শুধু সূবর্না মোস্তফাই পান! অপর ৩৪৯ জন সংসদ সদস্য কিছুই পাননা! বাতাস খেয়ে চলেন!
অবসর নেবার পর আবুল মাল আব্দুল মুহিত শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার সময় ফ্র্যাঞ্চাইজির দল সিলেট সিক্সার্স এর খেলার দেখতে মাঠেও যেতেন। সবকিছু থেকে অবসর নেবার পর তিনি শুধু মৃত্যুর জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। শুধু বারবার জন্মভূমি সিলেটে যেতে চাইতেন।
এমন একটি দীর্ঘ সফল জীবনের মৃত্যু স্বত্ত্বেও তাঁর তিরোধান সবাইকে শোকার্ত করেছে। তিনি ভাষা সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শাহ এস এম কিবরিয়ার পর আওয়ামী লীগের দশ বছর বাজেট দেয়া এই অর্থমন্ত্রীও রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ একজন গবেষক ছিলেন। সংস্কৃতির নানান শাখা নিয়ে তিনি লিখেছেন।
তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে ছুটে গেছেন আরেক স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। কিন্তু আবারও দেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিত্বকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। অথবা বিএনপি করলে এমন মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানানো যায়না।
বিএনপি নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শাহবাগের ঐতিহাসিক গণজাগরনের গণজোয়ারের সময় মেজর (অবঃ) হাফিজ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সেখানে যেতে তাঁর খুব ইচ্ছে করছে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা মনটা খুব আনচান করছে।
কিন্তু তখন হঠাৎ সিঙ্গাপুর চলে যাওয়া খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুরে লাইন নিয়ে এসে যখন শাহবাগের গণজাগরনের মঞ্চকে গাজাখোর নাস্তিকদের আড্ডাখানা বলে কটাক্ষ করলেন, মেজর হাফিজ বা এ দলের আর কোন মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
বিএনপির তরুন যত সমর্থক শাহবাগে গিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের পর সেখান থেকে ফিরে আসেন। এরপর থেকে প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির পরিচয় সংকট আরও সংকটাপন্ন হয়েছে। যা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকলো বীর মুক্তিযোদ্ধা ড আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মৃত্যুর পর।
সংসদ সচিবালয়ও বারো বার বাজেট দেয়া সাবেক এই অর্থমন্ত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মচারীরা ঈদের ছুটিতে থাকায় সংসদ ভবনের দক্ষিন প্লাজায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক অর্থমন্ত্রীর নামাজে জানাজা হয়নি! তাহলে জরুরি দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে এই সংসদ সচিবালয়! সরি।
বাংলাদেশের এই সময় আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মৃত্যুজনিত শোকার্ত হওয়া ছাড়াও দেশের ঈদও এবার অন্য রকম হতে চলেছে। করোনা মহামারীর দু’বছরের জন্যে দেশ নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। করোনা মুক্তির পর ঈদকে কেন্দ্র করে এবার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন প্রাণ চাঞ্চল্যের।
ঈদ শপিং’এ দেশের মানুষজন বিপুলভাবে ফিরেছেন। ব্যবসা-বানিজ্যের সঙ্গে লোকজন এতে ভীষন খুশি। শ্রীলংকা পরিস্থিতি, ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠার সময়ে মানুষের ব্যাপকভাবে ঈদ শপিং’এ ব্যাপক অংশগ্রহন সামর্থ্য দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যের জন্যেও ইতিবাচক।
পর্যটন খাতেরও বিশেষ ঘুরে দাঁড়ানোর এখনই সময়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ঈদে মানুষের স্বচ্ছন্দে বাড়ি যেতে পারার ছবিগুলো বিশেষ স্বস্তির। বাংলাদেশে রোজার ঈদে এক কোটির বেশি মানুষ বাড়ি যান। এই বাড়ি যাবার দূর্গতি প্রতিবছর যেন নিত্য এক নিয়তি। এবারও ভাড়া নৈরাজ্য কম ছিলোনা।
কিন্তু এবার ঈদ কেন্দ্রিক মানুষের চলাচল এখনও অন্য বছরের তুলনায় স্বস্তির। সড়ক যোগাযোগের বিপুল উন্নতি, ফেরী চলাচল মনিটরে সরকারি ব্যবস্থাপনা এবার ভালো ফল দিয়েছে। ছুটি বেশি হওয়ায় অনেকে আগে চলে গেছেন অথবা পরিবার পরিজন আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মোটর সাইকেলে এমন যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কিছু ক্রুটিবিচ্যুতি ছাড়া এখনও সবকিছু চলছে স্বস্তিদায়ক। মোটর সাইকেলের এমন দীর্ঘযাত্রাকে নিরুৎসাহ করা উচিত। ফেরী-লঞ্চ-স্পিডবোট সার্ভিস, কাটা সার্ভিস, কতভাবে সংগ্রামী মানুষ যাতায়াত শিখে ফেলেছে।
অনেক সংগ্রামে টিকেট নিতে হলেও যাত্রীদের মুখে ট্রেনের মোটামুটি সময় ধরে চলার প্রশংসা শুনছিলাম। তবে রেলমন্ত্রীর সেই বক্তব্য কানে বাজে। ‘ডাবল লাইন না হওয়া পর্যন্ত ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের ঝুঁকি থাকবেই।‘ টিকেট পর্ব আগামীতে আরও সহজ করা গেলে রেলওয়েও পাশ মার্ক পাবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুতের মতো মহাসড়ক ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এ লেখা পর্যন্ত টাঙ্গাইলের পথে একদিক বন্ধ রেখে আরেক দিক চালু রাখা কেন্দ্রিক যানজট চালু ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ আরও কিছু সড়কে যানজট অসহনীয় হতে না পারায় বেশিরভাগ গাড়ি একটা ট্রিপ শেষে আবার ট্রিপ নিয়ে যেতে পারছে।
মাওয়াগামী জনস্রোত এপার-ওপার উন্নত সড়ক যোগাযোগের সুযোগে স্বস্তিদায়ক হয়েছে। পদ্মা সেতু, কর্নফুলি টানেল, মেট্রোরেল চালুর পর অবস্থার আরও উন্নতি হবে আশা করা যায়। এখনও তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রার সঙ্গে জড়িতদের কৃতজ্ঞতা। গ্রামে শেঁকড়ের সঙ্গে মানুষের ঈদ আনন্দময় কাটুক।
ফেরার পর্বটাও নিরাপদ হোক। সবাইকে ঈদ মুবারক।