ফজলুল বারী:বিশেষ ক্ষমতা আইনটি প্রণয়ন করেছিল আওয়ামী লীগ। পরে সেটি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন কালাকানুন হিসাবে পরিচিত নিন্দিত হয়। আইনটি প্রণয়নের সময় আওয়ামী লীগ কালোবাজারী, মজুতদারদের আটকের উদ্দেশের কথা বলেছিল।
কিন্তু দেশ থেকে কালোবাজারি মজুদদারী নির্মূল হয়নি। এখনও তারা সকালসন্ধ্যা সরকারের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর সরকারের তথ্যমন্ত্রী তসবিহ জপছেন তারেক রহমান তারেক রহমান! কিন্তু কোন একজন মজুতদারের গায়ে হাত দেবার কোন দৃষ্টান্ত নেই!
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখতে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনটির সবচেয়ে বেশি অপপ্রয়োগ হয়েছিল। একুশ বছর যে আওয়ামী লীগকে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়েছে, এরজন্যে ব্যবহার করা হয়েছে কালো আইনটি। কারন এতে ওয়ারেন্ট ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করে আটক রাখা যেতো।
বেগম খালেদা জিয়া অপারেশন ক্লিনহার্ট অভিযান চালু, র্যাব গঠন করেন আওয়ামী লীগকে শায়েস্তার উদ্দেশে। তখন আওয়ামী লীগের কত নেতা-কর্মী যে এর নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। লোকজনকে ধরে মেরে ফেলে বলতো হার্ট এটাকে মারা গেছে! আজ র্যাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ বিএনপির।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কত বিরোধিতা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-ওমপিরা এ নিয়ে কত আশ্বাস দিয়েছিলেন! জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও এখন তথ্যমন্ত্রী নেই। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের কালো আইনটির কথা তাঁর আমলনামাতেও লেখা থাকবে।
এই ক’দিন আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এই আইনে সাংবাদিক গ্রেফতারের আগে অনুমতি নিতে হবে। রাঙ্গামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীর গ্রেফতারের আগে কী আইনমন্ত্রীর অনুমতি নেয়া হয়েছে? না আইনমন্ত্রী ফোন করাতে জামিন দিয়েছে?
আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে থাকতে দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের চমৎকার সম্পর্ক ছিল। তোফায়েল আহমদ, মোহাম্মদ নাসিম সহ অনেক নেতার সঙ্গে হৃদ্য সম্পর্ক সাংবাদিকদের। মির্জা আজম, মৃনাল কান্তি দাশ, বাহাউদ্দিন নাছিম সহ অনেকের সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
এখন দলটির সঙ্গে মিডিয়া আর সাংবাদিকদের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক গ্রেফতার থেমে নেই। প্রবীর শিকদারের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে ফরিদপুর নিয়ে যাবার কথা মনে পড়ে?
প্রবীর শিকদারের পা দুটি থাকলে হয়তো ডান্ডাবেড়িও পরানো হতো! ওই অবস্থায় তাঁকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে ফরিদপুর নিয়ে গিয়ে জামিন না দিয়ে রিমান্ডেও নেয়া হয়! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন দিল্লী যাচ্ছিলেন। দিল্লী গিয়ে তিনি যদি এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন, তা ভাবনায় আসে।
এই আশংকায় রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাকে তড়িঘড়ি জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আওয়ামী লীগের যে সব নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন তারা এর ভোগান্তি জানেন। এক সময় তৎকালীন ডিপিএস শাকিল পরে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের আরাফাতের উদ্যোগে তাদের জামিন হয়।
সবাইতো আর ওই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেননা। আমি একটা ছেলেকে চিনি সে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে মায়ের সংসার চালাতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়ায় তার পরিবারটি বিপদে পড়ে যায়। তাঁর জামিন হলেও চাকরি ফেরত পায়নি।
চাকরিওয়ালারা বলেছে আগে মামলা মুক্ত হয়ে আসো, এরপর দেখা যাবে। এই মামলা কি সহজে মুক্ত হবার মামলা? আওয়ামী লীগ যেদিন ক্ষমতায় থাকবেনা তখন এ দলের নেতাকর্মীরা এর খড়গ টের পাবেন। যেমন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন বিশেষ ক্ষমতা আইনের খড়গ।
রাঙ্গামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সেখানকার সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা এমপির মেয়ে। সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবেক হয়ে গেলেও মেয়ের দাপট কমেনি। পার্কের ভিতরে মহিলা এমপির মেয়ে স্থাপনা গড়ে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
এ নিয়ে পার্কের লিজ চুক্তির বরখেলাপ হওয়ায় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সাবেক এমপির মেয়ের সংঘাত তৈরি হয়। সাবেক এমপির মেয়ে জেলা প্রশাসক ও সেই অফিসের লোকজনের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করতে থাকেন। ফজলে এলাহীর কি সাহস এ নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।
এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সাবেক এমপির মেয়ে চট্টগ্রামের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এর ওয়ারেন্ট হাতে পেয়েই পুলিশ কেনো একজন সাংবাদিককে গ্রেফতারে দেরি করলোনা, এ নিয়েও তদন্ত হতে পারে। কারন বদনামটাতো হলো সরকারের।
সাধারনত এমন কত ওয়ারেন্ট এভাবে প্রতিদিন থানায় আসে! ওপরের নির্দেশ অথবা ওহীর অপেক্ষায় কত ওয়ারেন্ট পুলিশ তামিল করেনা! অথবা টাকার জন্যে কত ওয়ারেন্ট নিয়ে ঢিলেমি দেয়! দর কষাকষি চলে। রাঙ্গামাটির প্রভাবশালী সাংবাদিক থেকে টাকা চাওয়া পাওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।
সাবেক এমপির মেয়ে কী এ ব্যাপারে প্রভাব খাটিয়েছেন? যাক এই ঘটনায় একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করায় তাকে জাতীয় পরিচিতি দিয়েছেন সাবেক এমপির মেয়ে। পাহাড়িদের পোষ্টেও আমরা তাঁকে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জেনেছি। এইপক্ষ ধারনা দেন তিনি সেখানে সেনাবাহিনীর হয়ে তাদের বিপক্ষে কাজ করেন।
আমার এক প্রিয় সহকর্মী লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে তিনি সাংবাদিক হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্যে ঢাকায় আসেন। আর ফজলে এলাহী ফিরে যান রাঙ্গামাটিতে। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক এই নেতা একই সঙ্গে অনেকগুলো মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দুটির সম্পাদকও।
আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির মেয়ের মামলার সূত্রে বাংলাদেশের সাংবাদিক নির্যাতনের পরবর্তী আন্তর্জাতিক রিপোর্টগুলোতেও ফজলে এলাহীর নাম থাকবে। কিন্তু তাঁর মামলা মুক্তি হবেনা সহজে। সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপির মেয়েরও আর ওই পার্কের ভিতরে রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা করা লাগবেনা।
আওয়ামী লীগ কী বিশেষ ক্ষমতা আইন নামের কালো আইন, মিডিয়ার স্বাধীনতা বিরোধী গণমাধ্যম আইন ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবহৃত হবে তা নিয়ে আদৌ ভাবছে? ক্ষমতায় থাকার সময় কিন্তু সবকিছু সাদা ফকফকাই মনে হয়। সাংবাদিকদের শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো বন্ধ হোক।