ফজলুল বারী:যে কোন মানুষের কৈশোর-যৌবন তার ভবিষ্যত গড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। বাংলাদেশের এই বয়সের মানুষেরাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। এরপর মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় আসে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। ওই সময়টা আমার জীবনেরও শ্রেষ্ঠ সময়।
ওই সময়টায় পায়ে হেঁটে আমার জন্মভূমি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ঘুরতে গিয়ে আমি আমার অপূর্ব সুন্দর বাংলাদেশ এবং অনেক সোনার মানুষ দেখেছি। ওই সময় সাংবাদিকতায় আসায় অনেক খাঁটি মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার তাদের কাছে শেখার সুযোগ হয়েছিল। তাদের একজন ছিলেন সাংবাদিক নির্মল সেন।
অকৃতদার এই বামপন্থী নেতা-সাংবাদিক আড্ডাচ্ছলে এমন সব কথা আমাকে বলতেন, তা আজও আমার কানে বাজে। একদিন নির্মল দা আমাকে বলেন, ফজলুল বারী, আমরা যতই নিজেদের অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল ভাবিনা কেনো আমাদের মাঝে একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ বাস করে।
যেমন আমি নির্মল সেনকে জবাই করলে ভিতরে একজন হিন্দু লোক পাওয়া যাবে! তেমনি তুমি ফজলুল বারীকে জবাই করলে ভিতরে পাওয়া যাবে একজন মুসলমান মানুষ। আমরা খুব কম মানুষ ধর্মীয় এই সত্যকে অতিক্রম-অস্বীকার করতে পারি। আসলে পরিবার থেকেই এই বোধের সৃষ্টি হয়।
মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়া শিশু বড় হয় মুসলমান হিসাবে। হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া শিশু বড় হয় হিন্দু পরিচয়-মননে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের নামগুলো খুব সুন্দর। কারন তাদের সমাজে নাম রাখেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। বিদেশী ধর্ম প্রচারকদের নামে নাম রাখা হয় বাঙালি খ্রিস্টান শিশুর।
আরব দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম এই অঞ্চলে এসেছে। আমাদের মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়া বড় হওয়া শিশুর নাম রাখা হয় আরবিতে। অথচ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলায় নাম রাখলে ধর্ম ধংস হয়ে যাবে এটা ধর্মগ্রন্থের কোথাও বলা হয়নি। বাংলায় ধর্ম চর্চার অভাবে ধর্ম আমাদের মনের প্রভাব ফেলেনা।
কারন আমাদের যে সব মুখস্ত শেখানো হয়েছে এর বাংলা অর্থ আমরা জানিনা। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক ঘটনায় এদেশের ইসলামী ধর্মগুরুদের অবদান নেই। বরং বিরোধিতা আছে। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তারা বিপদে পড়ে যান।
তাদের অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান। অনেকে গ্রেফতার হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তারা আবার আবির্ভূত হন স্বরূপে। রেডিও-টেলিভিশন সহ রাজনীতিতে এমন ধারা-ধারনার প্রচার হয় যেনো, আওয়ামী লীগের হাতে ইসলাম ধংস হতে বসেছিল!
শুধু এক ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয়, আওয়ামী লীগ যে ইসলাম বিরোধী দল নয়, এ কথা বোঝাতে অনেকদিন লেগেছে। এখনও যে লোকজন এসব বোঝে, তাও নয়। ভারতে বিজেপির মতো একটি হিন্দু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদী উত্থানের উর্বর সময় সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকে বলার চেষ্টা করেন ভারতে যাই ঘটুক বাংলাদেশে তা কেনো আসবে। এটা এরা সঠিক বলেননা। শুধু ভারত নয়, ধর্মীয় বাতাস সব দেশ থেকেই আসে। যেমন আরব দেশ থেকে এসেছে হিজাব, জাজাকাল্লাহ সহ নানাকিছু। এখন ঘর বন্ধ করে বসে থাকার সময়ও নয়।
এমন সময়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মতো দলও আমূল বদলে গেছে। বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের কথা বললেও চেহারায় পোশাকে চিন্তায় এ দলের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের ধারেকাছেই নেই। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের ট্রেইলার দেখেই একদলতো ভীষন গোস্বা করে বসেন!
বায়োপিক যে একটা সিনেমা মাত্র, আসল বঙ্গবন্ধু নয়, এটাই এদের মাথায় নেই! ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ হলে যা হয় আর কি! অথচ মুজিব বায়োপিকের পুরো চিত্রনাট্য দেখে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিল্পী নির্বাচন থেকে সবকিছুর সঙ্গে শেখ হাসিনা জড়িত।
বায়োপিকে তাঁর পিতা মুজিবের ব্যত্যয় ঘটলে তাঁর সবচেয়ে ক্ষুদ্ধ হবার কথা। কিন্তু ক্ষেপলেন ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপরা! না, এরা তাদের মতো ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িওয়ালা একজন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চেয়েছিল! এমন নানান অসামঞ্জস্য এখন সবকিছুতে! বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এটা নয়।
এই আওয়ামী লীগ মুসলমান আওয়ামী লীগ সাজার চেষ্টা করছে। সারাদেশে মডেল মসজিদ বানানোর পর এখন নতুন প্রকারের মাদ্রাসা বানানোর কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। যদিও এই নেতৃত্ব জানে, বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আজও জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়না। নতুন মাদ্রাসাতেও জাতীয় সংগীত গাওয়া হবেনা।
বাংলাদেশের আওয়ামী মৌলভীদের কাছেও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন হিন্দু। বলা হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে বড় ও মানবিক করে। আমাদের অভিজ্ঞতা, তা সংকীর্ণ করে। আসলে আমাদের ধর্মীয় নেতারা যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতেন তাহলে বিষয়গুলো অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত হতো। কারোরই ভালো পড়াশুনা নেই।
নির্মল সেনের হিন্দু মানুষ মুসলমান মানুষ গল্প দিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। ধর্মীয় সংকীর্ণতা বাংলাদেশ সব ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে। এরজন্যে এখানে একজন লোককে মসজিদে যেতে দেখলে তাকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখা হয়। মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় যেতে দেখলে সেভাবে দেখা হয়না। মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় গেলেই একজন লোক সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে সংখ্যালঘুদের মাঝে সন্দেহ-নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। এরজন্যে আপনার প্রতিবেশী অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু সংখ্যালঘু হলে তাকে আপনি যত ভালোবাসুননা কেনো তার মাঝে প্রশ্ন জাগে, এ আমাকে ভালোবাসছে কেনো। এটাই মাইনোরিটি সাইকোলজি।
ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে থেকে আপনি যদি সংখ্যালঘুকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, সেটাই অসাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িক হতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া লাগেনা। সংখ্যালঘুও সাম্প্রদায়িক হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী হওয়াতে এটা প্রকাশ পেয়ে যায় সহজে।
ওই যে নির্মল সেনের সেই অমর বানী, সবার ভিতর বাস করেন একজন ধর্মীয় মানুষ। এরজন্যে আমি আমার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে ধর্মীয় বিতর্কে না জড়াতে বলি। কারন আমাদের এসব নিয়ে পড়াশুনা কম। যার ধর্ম তার কাছে। অস্ট্রেলিয়ায় এ বিষয়টি কড়াকড়িভাবে মানা হয়।
এখানে কর্মক্ষেত্রে ধর্ম চর্চা নিষিদ্ধ। আপনি বাড়িতে বা মসজিদে গিয়ে যত বেশি নামাজ পড়ুননা কেনো, কেউ আপনাকে মানা করবেনা। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নয়। আপনি মসজিদের ভিতরে সাউন্ড সিস্টেমে আজান দেন, বয়ান করেন, কেউ আপনাকে নিষেধ করবেনা। কিন্তু এসবের শব্দ যাতে বাইরে না আসে।
কারন বাইরের সব মানুষ ধর্মকর্ম করেনা বা আপনার ধর্মের অনুসারী নয়। মন্দির-গির্জা সহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই আইন। কোন শব্দ বাইরে আসা যাবেনা। বাংলাদেশের লোকজন বিদেশে এসে এসব আইন মেনে চলেন, দেশে গিয়ে ভিন্ন আচরন শুরু করে দেন!
ভারতের বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মা হযরত মোহাম্মদকে(দঃ) নিয়ে কটুক্তি করেছেন, এমন নিউজ দেখে কী কটুক্তি করেছেন এটা জানতে গুগলে সার্চ দিয়ে কিছু পাচ্ছিলামনা। গুগল সহ সব মাধ্যম সম্ভবত কন্টেন্টটি সরিয়ে নিয়েছে। পরে একজনের পোষ্টে এর ভিডিও লিঙ্ক থেকে তা শুনেছি।
এটাও অস্ট্রেলিয়ায় সম্ভব নয়। একজনের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষ করা এদেশে গুরুতর অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার এ নিয়ে কেনো বক্তব্য দিলোনা, এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিএনপি কী এ নিয়ে কোন বক্তব্য দিয়েছে? কোন মিছিল করেছে? এসব অপ্রয়োজনীয়। আমরা নবীকে(দঃ) সম্মান করি।
আমরা সম্মান করলেই হলো। কোন একজন নুপুর শর্মার বক্তব্যে নবী করিম(দঃ) এর সম্মান ধংস হয়ে যাবেনা। চৌদ্দশত বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বিশ্বের দেশে দেশে সম্মানের সঙ্গেই আছেন। আরব বিশ্বে সাধারনত এ রকম প্রতিবাদ হয়না। আরব বিশ্বের প্রতিবাদের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রতিবাদের মৌলিক পার্থক্য আছে।
তাহলো, আরব বিশ্বের প্রতিবাদ কখনো সহিংস হবেনা। সহিংস হলে আইনত কি সমস্যা হতে পারে তা তারা জানেন। তাই সেখানে যা কিছু হয় তা আইনের মধ্যেই হয়। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নেবার ঝুঁকি নেননা। বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতার বিচার হয়না। এটিই বিপদ।
এবার নুপুর শর্মা ইস্যুতে ভারত সরকার যে বিপদে পড়েছে এর দরকার ছিল। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি-ক্ষমতায় যাওয়া-থাকা থেকেই এ ধরনের নুপুর শর্মার জন্ম হয়। ধর্মীয় ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে সতর্ক না হলে বিদেশেও যে বিপদ হতে পারে, এ ঘটনা থেকে ভারতের বিজেপি দলটি শিখুক।
এই ঘটনার বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি ভারতকে অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে। জগতের সব সম্পর্কই অর্থনৈতিক। পেট্রো মুদ্রার দেশের অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে ভারত দ্রুত নুপুর শর্মাদের রাজনৈতিক জবাই করেছে। বলার চেষ্টা করেনি এটা নুপুর শর্মার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আরেকজনকে আঘাত করা অরাজকতা।