ফজলুল বারী:খালেদা জিয়ার মৃদু হার্ট এটাক হয়েছে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করতে গিয়ে ৭৬ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হৃদযন্ত্রের মূল ধমনীতে বড়সড় ব্লক পেয়ে চিকিৎসকরা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেলুনিং এর মাধ্যমে সেটি অপসারন করে স্ট্যান্ড লাগিয়ে দিয়েছেন।
দেশের চিকিৎসকদের ওপর বিএনপির আস্থা নেই। আমাদের টাকাওয়ালা বড়লোক কারোরই দেশের চিকিৎসায় আস্থা নেই। গরিব মানুষের দেশে চিকিৎসা না করে উপায় কী! প্রভাবশালীরা দেশে চিকিৎসা করালেও নানা কারনে যে মনোযোগ পান, গরিব মানুষের পক্ষে সে মনোযোগ দেবারও লোকের বড় অভাব।
দেশের চিকিৎসকরাই খালেদা জিয়ার একের পর এক ভালো চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনা, লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা তাঁর দেশেই হয়েছে। এভারকেয়ার হাসপাতাল এখন দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাসপাতাল। ভারত-সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের চাইতে এখানকার ব্যয় বেশি।
খালেদা জিয়ার অনেক টাকা অথবা তাঁর চিকিৎসার খরচ দেবার অনেক লোকজন আছেন বলে এভারকেয়ারের বিল পরিশোধে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। কিন্তু এরপরও বিএনপি ও খালেদা জিয়ার শুভানুধ্যায়ীরা এতে সুখি নন। তারা খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে যেতে চান।
এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীও বিদেশে চিকিৎসা করান। ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। এর পাল্টা সরকারদলীয়দের যুক্তি হলো খালেদা জিয়া দন্ডিত আসামী। বিএনপি এরপর হাজী সেলিমের উদাহরন টেনে এনেছে। যিনি সর্বশেষ বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন।
বিদেশে চিকিৎসার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন দেশের চিকিৎসকরা তাঁর চোখে হাত দিতে ভয় পান। এরজন্যে তাঁকে বাধ্য হয়ে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আবার ফলোআপ ডাক্তার দেখানোর কাজ যে প্রধানমন্ত্রী দেশে চক্ষু হাসপাতালে সেরেছেন, সে খবরও তখন বেরিয়েছে।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেশের ডাক্তাররা করতে চাননা, এটা কখনও শোনা যায়নি। বরং বিএনপি সব সময় বলেছে মেডিক্যাল বোর্ড তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে বলেছে। বিদেশে চিকিৎসার জন্যে মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ লাগে। আজকাল ফোনে, অনলাইনে ভার্চুয়ালি বিদেশের চিকিৎসা পরামর্শ দেশে বসে নেয়া যায়।
করোনার সময়ে চিকিৎসার ভার্চুয়াল শাখাটি অনেক ডেভলপ করেছে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বেশিরভাগ ভাগ ব্রিফিং করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি চিকিৎসক নন। তাঁর আর দশটা রাজনৈতিক ব্রিফিঙের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলায় খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠেনি।
আমি সিডনিতে যখন একজন আর্থাইটিজের চিকিৎসকের কাছে যাই তখন খালেদা জিয়ার সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করি। তিনি প্রথম থেকে বলছিলেন অমুক ডাক্তার দেখাবোনা, অমুক না, এটা করতে গিয়ে খালেদা জিয়া চিকিৎসায় দেরি করে ফেলেছেন। এরজন্যে তাঁর হাত বেঁকে গেছে।
খালেদা জিয়ার আর্থাইটিজের সমস্যাটি অস্ট্রেলিয়ায় সাড়ে ১১ হাজার ডলারের প্যাকেজে চিকিৎসা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের চিকিৎসার পুরো ব্যয় এখানে সরকার দেয়। খালেদা জিয়া অবশ্য সৌদ আরব ও লন্ডনে আর্থাইটিজের চিকিৎসা-অস্ত্রোপচার করিয়েছেন।
আমার দুই চোখে গ্লুকোমার সমস্যা আছে। এরজন্যে প্রতিদিন সকালে বিকালে দু’বার চোখে ড্রপ দিতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি গ্লুকোমার ডাক্তার দেখাতে সিঙ্গাপুর, লন্ডন বা জার্মানিতে যান বললে আমার নিয়মিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হেসে বলেন, তোমাদের দেশের অনেক টাকা।
রাষ্ট্রপতির বিদেশ ভ্রমনের সময়ও রাষ্ট্রীয় খরচে বিশাল একটি দল তাঁর সঙ্গে যায় বিদেশে। প্রভাবশালীরা দেশের চিকিৎসা নিয়ে বক্তৃতা দিতে ভালোবাসেন। নিজেরা চিকিৎসা নেন বিদেশে। করোনা কালে দেশের অনেক প্রভাবশালী বিদেশ যেতে না পেরে মারা গেছেন।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত বন্ধ থাকায় তারা বিদেশে যেতে পারেননি। দেশের হাসপাতালে না পারতে দেরিতে গেছেন। করোনা ততক্ষনে ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে তাদের প্রান সংহার করেছে। দেশের যানজটের কারনেও অনেকের এখন ফার্মের মুরগির মত প্রায় গৃহবন্দী জীবন। করোনা তাদের কাবু করেছে সহজে।
সর্বশেষ একাত্তর টিভির রিপোর্টে মনে হলো বেগম জিয়ার অবস্থা ভালো নয় অথবা তাঁর উন্নতি হচ্ছে ধীরে। এই বয়সী রোগীদের উন্নতি দ্রুত হয়না। তাছাড়া খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিকস, কিডনি-লিভারের সমস্যাও আছে। আর্থাইটিজের যে সব ওষুধ তিনি খান তাতে তাঁর কিডনিতে সমস্যা করতে পারে।
খালেদা জিয়ার হৃদপিন্ডে আরও ব্লক আছে এটা প্রথম থেকে বলা হচ্ছে। এরজন্যে বলা হয়েছিল বাহাত্তর ঘন্টা তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হবে। মঙ্গলবার এই বাহাত্তর ঘন্টা শেষ হবার পর আরও পর্যবেক্ষনের কথা বলা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দিতে বাধা সরকারি দলের মনের অবিশ্বাস।
সরকারি দলের কেউ কেউ মনে করেন খালেদা জিয়া বিদেশ গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আলুপোড়া দেবেন! খালেদা জিয়ার কী সেই শারীরিক অবস্থা আর আছে? ক্ষমতায় থাকতে মুক্ত সুস্থ থাকতে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে-শেখ হাসিনাকে এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, এখন এর প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন!
আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার বিদেশ যেতে যে সব আইনগত বাধার কথা বলে এগুলো খোঁড়া যুক্তি। জেলখানায় যে গৃহকর্মী ফাতেমাকে দেয়া হয়েছিল, এটা কোন আইনে ছিল? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাসায় থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নেবার ব্যবস্থা করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন।
আমি এর আগে লিখেছি বিদেশ গেলে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেলে খালেদা জিয়া যে মানসিক প্রশান্তি পাবেন এটা হবে তাঁর আসল চিকিৎসা। বিএনপিকে এটি কৌশলগত আচরন দিয়ে আদায় করতে হবে। প্রেসক্লাবের সামনের কয়েক হাজার লোকের সামনে ধমকাধামকি করে হবেনা।
ওই কয়েক হাজার লোকই বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের মানুষ এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। খালেদা জিয়ার দেশে না বিদেশে চিকিৎসা হবে, এসব তাদের স্পর্শ করেনা। হৃদরোগের সমস্যা হলে খালেদা জিয়ার এখন লম্বা বিমান ভ্রমনের শারীরিক অবস্থা কী আছে?
এয়ার এম্বুলেন্সে করে তাঁকে কী বড়জোর সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক নেয়া সম্ভব? এরজন্যে কী হঠাৎ করে বিএনপি বলা শুরু করেছে খালেদা জিয়ার বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে! এটা যদি হয় সেটাও আলোচনার মাধ্যমে আদায় করতে হবে। সরকারকে হুমকি দিয়ে নয়।
শেখ হাসিনা যদি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, সেটা হবে আরেক দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত পদ্মা সেতুর চেয়ে কম বড় হবেনা। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেতাদের আলোচনার জন্যে গণভবনে ডেকে কথা বলতে পারেন।