ফজলুল বারী: এক সময় বাংলাদেশে যখন যা বানানো হতো নাম দেয়া হতো এশিয়ার বৃহত্তম! কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এশিয়ার বৃহত্তম! বসুন্ধরা শপিং মল, এশিয়ার বৃহত্তম! এরপর দেশের মানুষজন যখন বিভিন্ন দেশে যেতে শুরু করলো তখন এসবের সারবত্তা বুঝতে পারলো। এখন শুরু হয়েছে সবকিছুতে শতভাগ!
শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই কিছুদিন আগের উচ্ছ্বাসটি এখন কোথায় বাস করে? শতভাগ বিদ্যুতায়িত না নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ, কোনটা দরকার দেশের? দেশের চা শ্রমিক পল্লীগুলো আমলারা কখনও দেখতে যাননি। বাতির নীচের অন্ধকার তারা দেখেননি। চা বাগানের বাংলোর মেহমানদারীর সুখ নিয়ে ফিরেছেন।
বাংলাদেশের দূর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের সব আদিবাসী পাড়া কি বিদ্যুতায়িত? আমলাদের তৈরি এসব শ্লোগানের পরিণতি কী? দেশের অনেক কাজ হচ্ছে উন্নয়ন হচ্ছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো কথাবার্তায় এসব কাজকর্ম যেন কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
উন্নয়ন হোক টেকসই। চলমান। এখন সারাদেশে ভূমিহীন–ঘরহীন মানুষজনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘর দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ মাগুরা ও পঞ্চগড় জেলার সব উপজেলা সহ ৫২টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষনা করা হয়েছে! এরমানে এসব এলাকার সব মানুষের জমি আছে? বাড়ি আছে?
ভাড়া বাসায় যারা থাকেন সেগুলোও তাদের? সরকারের সিরিয়াস একটি কর্ম পরিকল্পনাকে হালকা করে দেবার এই সংজ্ঞাগুলো কারা তৈরি করেন? না এভাবে শতভাগ না বললে কী সরকারের ভালো কাজটিকে মানুষ ভালো বলবেনা? পৃথিবীর কোন দেশে ভূমিহীন ঘরহীন মানুষ নেই?
আমার নিজের কথা বলি, বাংলাদেশ বা বিদেশের কোথাও আমার নিজস্ব কোন জমি বা বাড়ি নেই। দেশে থাকতে ভাড়া বাসায় থাকতাম, বিদেশেও আছি ভাড়া বাসায়। আমাকে কি ভূমিহীন–ঘরহীন বলা যাবেনা? আমার মতো দেশে–বিদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন যারা ভাড়া বাসায় থাকেন।
নিজের এক টুকরো জমি, নিজের একটি বাড়ির জন্যে কত হাহাকার লক্ষ কোটি নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্তের! তারা মুখ খুলে চাইতে পারেননা। আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পেলে তারা এখানে থাকবেওনা। এটাই মধ্যবিত্তের সংকট। এদের নিয়ে কোন দিন কোন সরকার ভাবেনি। এই সরকারও নয়।
বাংলাদেশে এমন ঘরহীন মানুষগুলোকে ঘর দেবার কার্যক্রম নতুন নয়। এখন দেয়া হচ্ছে পাকা ঘর। আগের প্রকল্পগুলোর কী অবস্থা? সেগুলো কী পরিত্যক্ত? এর তথ্য কোথায়। এখনকার ঘর বানানোর সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা বাস্তব অবস্থা বলতে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
তার বক্তব্য, উপজেলার মডেল মসজিদের গেইট বানানোর বাজেটের চাইতে এসব একেকটি ঘর নির্মানের বাজেট বরাদ্দ কম। এই টাকায় একটি মানসম্মত বাড়ি বানানো সম্ভব নয়। গরিবের বাড়ি বানানো সম্ভব। অসহায় মানুষগুলোকে ভালোবাসা দেবার চাইতে দয়া দেখানো হচ্ছে। এসব বাড়িঘরে যাবার পাকা পথ, ময়লা ফেলাসহ জরুরি নানার ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
আমাদের কাছে সারাবছর অনেক অসহায় মানুষের ঘর বানানোর আবেদন আসে। তখন জিজ্ঞেস করি এদের কী প্রধানমন্ত্রীর ঘর দেয়া সম্ভব না? উত্তর আসে এদের টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই! তখন মনে হয় এসব ঘর প্রকল্পের পিছনে অন্ধকারও আছে। বাংলাদেশের সব মানুষ হঠাৎ ফেরেশ্তা হয়ে যায় নাই।
আমরাতো কাউকে বলতে পারিনা ভাই টাকা আমরা দেবো, তাও ঘরটা অমুককে দিন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা টাকায় ঘরের তালিকা করেন, এটা শতভাগ বিশ্বাস করার মতো নয়। কিন্তু তালিকা যাদের সহায়তা নিয়ে করা হয় তাদের ব্যাপারে আরও সাবধান হবার দরকার আছে।
অভাবী মানুষজনের ঘর বানাতে গিয়ে মনে হয়েছে অনেক মানুষ তার বাড়িতেই থাকতে চান। কিন্তু নিজস্ব ভাঙ্গা ঘরটি মেরামত করার বা সেটি নতুন করে বানানোর তাদের সামর্থ্য নেই। গ্রাম ঘুরে ঘুরে এমন অভাবী মানুষজনের ঘর বানানোতেও সরকারি বাড়ি প্রকল্পকে যেন নিয়ে যাওয়া হয়।
অনেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা–জেলা প্রশাসক বলেছেন, এই কাজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাটা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। তাতো অবশ্যই। একটি রাজনৈতিক সরকারের স্থানীয় নেতৃত্বের এমন কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির ভয়ে সরকার সে পথে যায়নি। এরপরও শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত করা যায়নি এই প্রকল্প।
নদী ভাঙ্গন প্রবন দেশে প্রতিবছর নতুন হাজার হাজার পরিবার ভূমিহীন–গৃহহীন হয়। তাদের অনেকে রাস্তার পাশে ঘর তুলে আশ্রয় নেন। তাই এমন প্রকল্পের নির্মান চলমান রাখতে হবে সারাবছর। প্রয়োজনে এমন শতশত বাড়ি তৈরি করে রাখতে হবে যাতে সদ্য নদীভাঙ্গা সর্বস্ব হারানো পরিবারগুলোকে অতিদ্রুত মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দেয়া যায়।