ডাক্তার এড্রিক বেকার আর নেই

ডাক্তার এড্রিক বেকার আর নেই

অনলাইন ডেস্ক: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত টাঙ্গাইলবাসীর প্রিয় মানুষ ডাক্তার এড্রিক বেকার (৭৪) আর নেই। আজ মঙ্গলবার বেলা ২টায় নিজ হাতে গড়া তার প্রাণ প্রিয় কালিয়াকুঁড়ি হাসপাতালেই অসুস্থ্য অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে এলাকাসহ পুরো মধুপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরগড়ে অবস্থিত ব্যতিক্রমী চিকিৎসাকেন্দ্র ‘কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টার’ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী ৭৪ বছর বয়স্ক ডাক্তার এড্রিক গ্রামের সবার কাছেই ডাক্তার ভাই হিসাবে পরিচিত ছিলেন। গত ৩৫ বছর ধরে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত এই ভিনদেশি মানুষটি বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুরগড়ে। ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এড্রিক বেকারের ওপর একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছিল হানিফ সংকেতের বিনোদন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে।

প্রথম আলোতে গত ২৯-০৫-২০১০ , এক লেখা প্রকাশিত হয়:

বাংলাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ভিয়েতনামে একটি চিকিৎসক দলের হয়ে কাজ করছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই—এসব কথা জানতে পারেন। পত্রপত্রিকায় দেখা নির্যাতিত মানুষ ও শরণার্থীদের অসহায় মুখগুলো মনে দাগ কাটে তাঁর। তিনি ঠিক করেন, সময়-সুযোগ হলে বাংলাদেশে ঘুরে আসবেন।
১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। কিছু দিন ঘুরে বেড়ানোর পর তিনি বাঁধা পড়ে যান এ দেশের মাটির টানে। তারপর একে একে কেটে গেল ৩১টি বছর। এর মধ্যে ২৭ বছর ধরে তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে।
এই ভিনদেশি মানুষটির নাম এড্রিক বেকার। মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কাইলাকুড়ি গ্রামে চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে তাঁর। সেখানে প্রতিদিন গড়ে বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছে দেড় শতাধিক রোগী।
মানবসেবাই ব্রত: ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে এড্রিক বেকারের জন্ম। বাবা জন বেকার একজন পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন। মা বেটি বেকার শিক্ষক ছিলেন। এখন নিজ দেশে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বেকার দ্বিতীয়। তাঁর ভাইবোনেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত।
ছোটবেলা থেকেই বেকারের ইচ্ছা, বড় হয়ে মানুষের সেবা করবেন। চিকিৎসক হলে এই সুযোগ বেশি বলে তিনি ঠিক করেন এ পেশায় আসবেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ডুনেডিন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের শল্য চিকিৎসক দলে যোগ দেন। চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। মাঝে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে শিশুস্বাস্থ্যসহ তিনটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। এর মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। সুস্থ হয়ে ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন।
চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশে এসে বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দুই বছর কাজ করেন। পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে আট মাস কাজ করেন। বেকার বলেন, ‘আমার কোনো বড় হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসি মধুপুর গড় এলাকায়। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে টের পেলাম, এখানকার ভাষাটা শিখে নেওয়া দরকার। তাই মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান মিশনে এক বছর থেকে বাংলা শিখে নিলাম। যোগ দিলাম স্থানীয় থানারবাইদ গ্রামে, চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে।’ সেই থেকে পাহাড়ি এলাকায় গরিব ও অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন বেকার।
সেবা কার্যক্রম: ১৯৮৩ সালে ওই ক্লিনিকে দুজন খণ্ডকালীন ও তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়। দিন দিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন থানারবাইদের পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে কাইলাকুড়িতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন তিনি। সেখানেই এখন চলছে তাঁর সেবা কার্যক্রম।
বেকার জানান, তিনি দু-এক বছর পরপর নিজ দেশে গিয়ে স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই চিকিৎসাকেন্দ্র চালানোর টাকা জোগাড় করেন। এখানে তিনিই একমাত্র চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ৮৭ জন তরুণ-তরুণী। সেবা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে নিয়েছেন।
চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক রোগী আসে। সেখানে জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেওয়া হয়। হাত-পা ভাঙাসহ অন্যান্য জটিল রোগীদের জন্য আবাসিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে রোগীর জন্য ১০০ টাকা ও রোগীর সহযোগীর জন্য ২০০ টাকা এককালীন নেওয়া হয়। বাকি সব ব্যয় চিকিৎসাকেন্দ্র বহন করে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক দিন: মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে কাইলাকুড়ি গ্রাম। সেখানে চার একর জায়গার ওপর বেকারের চিকিৎসাকেন্দ্র। ছোট ছোট মাটির ঘরে ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষ্মা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগ রয়েছে। সব বিভাগ মিলিয়ে ৪০ জন রোগীকে ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
গত সোমবার ওই চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বিভাগে ৩১ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। পাশেই বহির্বিভাগে বেকার রোগী দেখছেন।
জামালপুরের শৈলেরকান্দা গ্রাম থেকে এসেছেন দিনমজুর চান মিয়া। দুই মাস আগে তাঁর ছেলে জুয়েল (১০) অগ্নিদগ্ধ হয়। চান মিয়া জানান, টাকার অভাবে তিনি ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। এক আত্মীয়ের কাছে বেকারের এই হাসপাতালের খবর পেয়ে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। দেড় মাস ধরে এখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা চলছে জুয়েলের। এখন সে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে।
মধুপুরের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের যুবক মানিক মিয়া ২৪ মে ভোরে বিষপান করেন। অবস্থা খারাপ হলে স্বজনেরা তাঁকে বেকারের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। মানিকের মা রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের যেকোনো রোগ হলেই এখানে চলে আসি। এই হাসপাতাল না থাকলে আমার ছেলের জীবন বাঁচাতে পারতাম না।’
কামারতাফাল গ্রাম থেকে বৃদ্ধা রহিমা বেগম এসেছেন তাঁর আট বছরের নাতি মুরাদ আলীকে নিয়ে। মুরাদ আলীর হাত ভেঙে গেছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করে তার চিকিৎসা চলছে।
এলাকাবাসী যা বলেন: কাইলাকুড়ি গ্রামের প্রবীণ আদিবাসী নীরেন্দ্র দফো বলেন, প্রত্যন্ত এই এলাকায় রাস্তাঘাট ছিল না। রোগবালাই হলে গ্রাম্য কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো হতো। অনেকের কপালে তা-ও জুটত না। বেকার আসার পর এ এলাকার কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি।
একই গ্রামের আবদুর রাজ্জাক বলেন, অসুস্থ কেউ এই হাসপাতালে এলে বিনা মূল্যে একজন ভালো চিকিৎসকের সেবা পায়।
শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সোহরাব আলী বলেন, ‘ডা. বেকারের মধ্যে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি ছোট একটি মাটির ঘরে থাকেন, মেঝেতে ঘুমান, খাবারদাবার অতি সাধারণ। নিঃস্বার্থভাবে তিনি মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁর কল্যাণেই আমাদের এলাকার মানুষ ঘরের কাছে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে।’
বেকার বলেন, এ দেশের মানুষ খুব ভালো। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষই চিকিৎসাসেবা পায় না। এসব মানুষের সেবা করতেই আমি এ দেশে থেকে যাই। দেশে গেলে মা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কবে আবার তোমার দেশে ফিরে যাচ্ছো?’
বেকার বলেন, ‘প্রতিবছর এ দেশে অনেক ছেলেমেয়ে চিকিৎসক হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ না কেউ একদিন চলে আসবেন আমাদের হাসপাতালে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করবেন। সে রকম একজন মানুষের অপেক্ষায় আছি।’