অমি রহমান পিয়ালঃ ( facebook থেকে নেওয়া)
রাইফেলের ঠান্ডা নলটা মেজর অশোক তারার বুক ছুঁলো।ট্রিগারে রাখা হাতটা কাঁপছে।পাকিস্তানী সেনাসদস্যটি নিতান্তই অল্পবয়সী, গোফ ওঠা তরুণ, প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে বারবার ঠোট চাটছিলো সে। একটু ওল্টাপাল্টা হলেই তারা জানেন ছেলেটি ট্রিগারে চাপ দেবে। মুহূর্তেই রাইফেলের গুলি তার বুক ভেদ করে বেরিয়ে যাবে।দু’দুটো যুদ্ধে ঋদ্ধ সে বুক।মনের আয়নায় ভেসে উঠলো নয়াদিল্লিতে অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী আর চার মাস বয়সী শিশুর মুখ। নো ফলস ম্যুভ। নিরস্ত্র তারার এসব ভাবার সময় নেই আর। ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের এই বাড়িতেই বন্দী হয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল এবং শেখ হাসিনার দুই ছেলেমেয়ে পুতুল ও জয়। শেখ কামাল এবং শেখ জামাল যুদ্ধে গেছেন এখান থেকেই পালিয়ে। আর বঙ্গবন্ধু তখনও বন্দী পাকিস্তানের লারকানা কারাগারে।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। সকাল বেলা। আগের রাতে এখানে গুলি চালিয়েছে পাকিস্তানিরা। তাতে একজন মহিলাসহ পাঁচজন মারা গেছেন।গেটের একটু দূরে এক অর্ধদ্গ্ধ গাড়িতে মেশিনগানের গুলিতে ছিন্ন বুক নিয়ে পড়ে আছেন একজন সাংবাদিক। তারার ডিউটি এখানে নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফর্টিন গার্ডের ইউনিট নিয়ে তারা আগরতলা থেকে ম্যুভ করেছেন। তার কাজ ছিলো ঢাকাগামী রাস্তাঘাট পলায়নপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য বিকল করে দেওয়া। দুই সপ্তাহ আগে গঙ্গাসাগর যুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীরচক্র খেতাব পেয়েছেন আলফা কোম্পানির কমান্ডার তারা। এখন নিরস্ত্র অবস্থায় শীতের সকালে দাড়িয়ে আছেন ধানমন্ডির এই বাড়ির গেটে মৃত্যুর মুখোমুখি।
আগের দিন ঢাকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল গনজালেস তারার ইউনিটকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিমানবন্দরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে।মেইন টার্মিনালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারা এমন সময় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা তার ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার কর্নেল বিজয় কুমার চানানার সঙ্গে দেখা করে জানায় পাকিস্তানী সেনারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছে। চানানার নির্দেশে তারা তিনজন সৈনিকসহ ধানমন্ডি রওনা হন।
ধানমন্ডির বাড়িটা দেখিয়েই ভয়ে পালিয়ে যায় সেই নেতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা এমন সময় এগিয়ে আসেন তারার গাড়ির দিকে। জানান বাড়ির প্রহরায় থাকা পাকিস্তানীর একটু পরপর হুমকি দিচ্ছে সবাইকে মেরে ফেলার। বাড়ির ছাদে একটা বাংকার, সেখানে লাইট মেশিনগান বসানো। টেরেসে আরেকটা। গেটের দুই পাশে দুইটা। এদের সঙ্গে তিনজন সৈন্য নিয়ে লড়ার কোনো সুযোগ নেই, জেসিওকে ডেকে হাতের স্টেনগানটা ধরিয়ে দিলেন তারা। বললেন তাকে কাভার দিয়ে ওয়াল ঘেষে দাঁড়াতে।
একটু এগোতেই ছাদের উপর থেকে চেচিয়ে বলা হলো আর এক পা এগুলেই গুলি করা হবে। তারা পাল্টা জবাব দিলেন যে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার এবং নিরস্ত্র। কথা বলতে চান। এরপর বললেন, ‘আমি আপনার সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় পৌছেছি মানেই আপনাদের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। বিশ্বাস না হলে আপনার অফিসারকে জিজ্ঞাস করে দেখতে পারেন।’
সেন্ট্রি তাকে হল্ট বলে অপেক্ষা করতে বললো। একটু পর জানালো, আমি তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। তারা পরে জেনেছেন ক্যাপ্টেন পদবীর ওই অফিসার আগেই পালিয়ে যান এবং আত্মসমর্পনের খবর তার অধস্তনরা পায়নি যোগাযোগহীনতার কারণেই।
এসময় মাথার উপর ভারতীয় কিছু হেলিকপ্টার উড়ছিলো। তারা বললেন, দেখো ওপরে আমাদের হেলিকপ্টার, পেছনে দেখো আমার সৈন্যরা দাড়িয়ে। আমার মতো তোমাদেরও নিশ্চয়ই পরিবার ছেলেমেয়ে আছে। তোমরা আত্মসমর্পন করো, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি তোমরা নিরাপদে তোমাদের ক্যাম্পে বা যেখানে যেতে চাও সেখানে যেতে পারবে। কথাগুলো বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন তারা। এমন সময় গেটের ফাক দিয়ে ওই রাইফেলের নলটা তার বুক স্পর্শ করলো।
ওই কাপতে থাকা তরুণের চোখে চোখ রেখে ছাদের উপর থাকা হাবিলদারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তারা। এমন সময় ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো “If you do not save us, they will kill all of us, we know,” যদি আমাদের না বাচান তাহলে এরা আমাদের মেরে ফেলবে। কথা বলতে বলতে তারা বুকের ওপর চেপে বসা নলটা সরিয়ে দিলেন তারা। তার বুকে কোনো ভয় নেই। ফিরে এসেছে দুই সপ্তাহ আগের গঙ্গা সাগর যুদ্ধের বীরত্ব।
ভারতীয় বার্তা সংস্থা ইউএনআইর পরিবেশিত খবর লেখা হয়: “A major who led the (Indian) detachment ordered the guards to surrender. They (the Pakistani soldiers), however, refused to move out of the bunker unless ordered by their own officers. The major explained that the Pakistani troops had already surrendered and that they should do the same instead of provoking the troops to eject them. After much argument, they agreed to come out. They were given civilian clothes to wear lest they be shot on the road by vengeful youths.”
তারা পাকিস্তানীদের অবশেষে বোঝাতে সক্ষম হন। তাদের বেসামরিক পোষাক পড়তে দেওয়া হয় নইলে রাজপথে বাঙালী তরুণদের গুলির মুখে অক্কা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বাড়িতে ঢোকার পর বেগম মুজিব তারাকে জড়িয়ে ধরেন, এবং বলেন, ‘তুমি আমার ছেলে যাকে খোদা নিজে পাঠিয়েছেন।‘’ বাড়ির ভেতরকার দূরাবস্থা জানিয়েছেন তারা। তিনি দেখলেন ঘরে কোনো আসবাব নেই। মুজিব পরিবারের সদস্যরা মাটিতে শুতেন। আর তাদের খাবার দাবার বলতে কিছু বিস্কুট।
এরপর তারার ইউনিট মিজো হিলে পাঠানো হলেও মুজিব পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে তারা ঢাকায় থেকে যান। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তাকে পরিবারের একজন সদস্যদের মতোই দেখা হয়। দেশে ফেরার পর শেখ রেহানা তাকে প্রায়ই চিঠি লিখতেন ভাইয়া সম্বোধন করে এবং ভাবি এবং বেবির খবর নিতেন।
২০০৯ সালে ৭০ বছর বয়সী তারা আবার ঢাকায় পা রাখেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানান তার যুদ্ধকালীন সৌহার্দ্য এবং বীরত্বের কৃতজ্ঞতায়।