মমিন্না

মমিন্না

মমিন চাচার বাসায় পড়তে এসে একরকম চাকর বনে গেল। মমিন থেকে মমিন্না ডাক শুনতে লাগল। চাচা বলতে বাবার চাচাতো ভাইয়ের সমন্ধি আর কি। বাজার করা, ওদের ছোট ছেলেটাকে স্কুল থেকে আনা নেয়া এইসব তো করতেই হয়। সবচাইতে ভয়াবহ ব্যাপার হয় চাচী যেদিন ছাদ ঝাড়ু দিতে বলেন। এলাকার সবাই জানে ও চাচার বাড়ি থাকে। কোন ভাতিজা চাচার বাড়ির ছাদ ঝাড়ু দেয়?

প্রথম মাসেই মমিন দেখে ফেলল ঠিক পাশের বাড়ির ছাদে সুন্দরমত একটা মেয়ে কাপড় শুকাতে আসে, এই মেয়েকে কোন বাড়ির কাজের মেয়ে মনেই হয়না। তবে সে কাজের মেয়েই। খোঁজ খবর নেয়া হয়ে গেছে, তবুও মন মানে না। এই শেফালী মমিনকে ছাদ ঝাড়ু দিতে দেখলে কাজের ছেলে ভাববেনা? অথচ সে এর থেকে উঁচু পোস্টে আছে, বলতে গেলে সে কেয়ারটেকার।

যদিও চাচার বড় ছেলে মনা ভাই আমেরিকা থেকে এসে সেবার বলেছিল, মমিনরে কাজের ছেলে মেয়ে বলে হেলা ফেলা করি যাদের তারাই অমূল্য রতন আমাদের কাছে। কথাটার মর্ম ঠিক বোঝেনি মমিন, কিন্তু মাতালের সাথে প্রশ্ন উত্তর পর্ব তার ঠিক পছন্দ না। সকালে একবার জিজ্ঞেস করবে ভেবে ভাবল, এখন যদি বলে অমূল্য রতন না, খামোখা মনটা খারাপ হবে। তার চেয়ে যেটুকু দরকার সেটুকু শুনেছে এটাই বড় কথা!

বাড়ির দক্ষিণ পাশে অন্য একটা বাড়ির ছাদে এক আপু উঠে। এ আপু বাড়ির মালিকের মেয়ে। নাম সাগরিকা। এতো সুন্দর আপু অথচ এতো রাগ কেন মনের ভিতর বোঝা মুশকিল। মানুষকে এতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কি আছে, মমিনের একটা মোবাইল ফোন আছে, মমিন মাস গেলে বেতন পায়। আপুর প্রেমিক বেকার ছেলে সে মমিন ঠিকই জেনেছে।

সে মাসেই প্রথম বেতন পেয়ে সাগরিকা আপুকে ছাদে হাত দেখিয়ে ইশারা করেছিল। হাই দেখানোর মত আঙ্গুল নেড়ে মুঠ বন্ধ করে কানে দিয়ে আরেক হাতে নাচের মুদ্রার মত যে কসরত দেখিয়েছিলো তাতে ছোট বাচ্চাও বুঝবে ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করছে। সাগরিকা আপুও বুঝল তবে পায়ের স্যান্ডেল খুলে কযেকবার সামনে পিছনে স্যান্ডেল নাড়িয়ে মুখ খিচড়ে কি কি বললো তা শোনা গেলনা। কেউ দেখেনি মমিন ছাড়া সে এক রক্ষা।

এরপর সাগরিকা আপুকে দেখলে সে ছাদের অন্য প্রান্তে এসে পড়ে। যে মেয়ে এরকম জুতা স্যান্ডেল দেখায় তার সাথে ভালবাসার চেষ্টা করেও লাভ হবেনা, ভাব ভালবাসা যদি হয়েও যায় এরপর সাগরিকার রাগ উঠলে স্যান্ডেলের বাড়ি দিতে পারে। দূরে সরে যাওয়াই ভাল। আবার মমিন নিজের অজান্তে হাত পা নাড়লে কি বুঝতে কি বুঝবে শেষে চাচা চাচীকে নালিশ দিবে।মমিন টাকা পয়সার সমঝদার বটে তবে মার্ খেয়ে বড়লোকের মেয়ে সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হবেনা। এর চাইতে ঐ শেফালী অনেক ভালো। হাসি মুখে তাকায়। শেফালী কর্মজীবী মেয়ে হয়েও সাগরিকার মত এতো অহংকার নেই।

দুমাস পর শেফালী দারোয়ানের মাধ্যমে ওর ফোন নম্বর পাঠিয়েছে। মমিন আর শেফালির রোজই কথা হচ্ছে ফোনে এরপর থেকে। তবে ওরা কেউ কাউকে বাইরে দেখা করতে বলেনা। দুজনেই স্বল্প আয়ের লোক, বাইরে ঘুরতে যে টাকা লাগবে তা আগে জমাতে হবে।ওদের চাওয়া পাওয়া হিসাবের ভিতরেই রাখতে হয়। ফোনেই বরং ভালো, কে কখন ভাত খেয়েছে এটাও জেনে ফেলা যায়।

শেফালী বলেছে বাড়ি গেলে ওর বিয়ের কথা হবে, মমিন যেন প্রস্তাব পাঠায়। মমিন কিছু বলেনি, বিয়ে করতে মমিনই চায়, তবে বিয়ে করে এই মেয়েটাকে এখনকার চাইতে আরো অসহায় অবস্থায় ফেলতে ওর ইচ্ছা করেনা। সে শুধু বলেছে একটু ধৈর্য ধরো।

মনা ভাই উদার মানুষ, যাবার আগে এক হাজার টাকা বখশিশ দিয়ে গেছেন। মমিন বলে রেখেছে সে বিদেশ যেতে চায়। মনা ভাই ভালো মন্দ কিছু বলেনি।
না করে দেয়নি যেহেতু মমিন ভাবছে একটা চিঠি লিখে মনে করিয়ে দিবে নাকি, নাকি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! চাচী জানলে শেষে না চাকরিটাই হারায়!
এক পা আগালে দশ পা পিছাতে হয় জীবনে।

তবু মন্দের ভালো এই বখশিশের টাকায় শেফালিকে একটা শাড়ি দারোয়ানের মাধ্যমে পাঠানো গেছে। মেয়েটাকে কোনদিন কিছু দেয়া হয়নি।
শাড়ি পেয়ে শেফালী বলেছে এই শাড়ি সে তুলে রাখবে, বিয়ের পরে পরবে।শুনতে এতো ভাল লেগেছে, কিন্তু মনটা বেশিক্ষন ভাল রাখা যায়নি।
মায়ের ডাক্তার দেখানো দরকার বোন ফোনে বলেছে। একটা দিন আগে জানলে এই টাকাটা পাঠিয়ে দেয়া যেত, এখন বেতনের অপেক্ষা করতে হবে।
চাচী বলে দিয়েছেন অ্যাডভান্স চাইলে উনার হিসাবে গন্ডগোল হয় তাই ভুলেও যেন বিরক্ত না করে এই ব্যাপারে।

মমিনের আগেও নিশ্চয়ই অনেকে এইসব কথা শুনেছে নইলে চাওয়ার আগেই না করে দেয়ার কথা চাচী এতো জোর দিয়ে বলে রাখলেন কেন! চাচী আচমকা একদিন ডেকে বললেন, শোন মমিন্না টাকা পয়সার লোভ করবিনা। লোভী মানুষ আমি পছন্দ করিনা। এডভান্সের কথা তুলবিনা, আমার হিসাবে গন্ডগোল বাধে। আমাকে হিসাব করে চলতে হয়।চাচা চাচির যেমন সুবিধা অসুবিধা আছে, মমিনের কি নেই! আশ্চর্য লাগে যে এতো বড়লোকদের এতো ছোট খাটো হিসাব চিন্তিত করে তুলে।

মনের দুঃখ মনে চেপে মমিন চেষ্টা করে ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নিতে।শেফালির উপর এমন মায়া পড়েছে যে মনে হয় প্রতিদিন কথা না বললে দম আটকে যাবে।মমিন আর শেফালির মোবাইলে কথা বলার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই কিন্তু রাতের ভাত খাবার আগের সময়টাতে বেশিরভাগ দিন কথা হয়।
এর পিছনে একটা কারন আছে। বিকালের নাস্তা কপালে জুটবে এমন কোন কথা নেই, চা পাওয়া যায়। আবার শেফালীদের বাড়ি কাজের লোকের চা খাওয়া বারন।
সবার রাতের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ওদের খাবার পালা। সেই রাতের খাবারের আশায় শরীরে আর শান্তি লাগেনা। খিদায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখার উপক্রম হয়।
বাড়ির সকলে বিকালের চা নাস্তার পর এতো ক্ষুধার্থ থাকেনা, বেশ রাত করেই খাবার খেতে বসে। মাঝে মাঝে চাচা অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেন, কোন কোনদিন ভাগ্য ভালো থাকলে আগে খেয়ে ফেলার অনুমুতি পাওয়া যায়, আবার কোনদিন চাচী ভুলে যান।

ক্ষুধা ভুলে থাকতে প্রেমের কোন তুলনাই নেই।ওরা অনর্থক কত কথা যে বলে। এর মধ্যে কিছুটা সময় পার হয়ে যায়, আর কিছুটা খাবার খাওয়ার সময় এগিয়ে আসে। মন ফুরফুরা থাকে, কি কাচানো তরকারি ভাগ্যে জুটছে খেয়াল না করে খাওয়াটা কেমন আনন্দময় মনে হয়।বাড়িতে মেহমান আসলে ওদের কথা বলা হয় না। কখনও শেফালীকে নিয়ে ওদের বাড়ির আপু কোচিং ক্লাসে গেলে ওই সময়ে কথা হয়না।

তখন পুরানো দিনের স্মৃতি মনে পরে যায়। এই কয়টা বিষয় নিয়েই জীবন কিনা। শেফালী, কাজ, পরিবার, স্মৃতি আর কিছু স্বপ্ন।বাড়িতে মমিন বড় ছেলে, ওর বাবা আর ও আগে খেতে বসত। তরকারির ভাল অংশগুলো ওরাই খেতে পেত। কয়জন মানুষের কি পরিমান তরকারি লাগে, কতটুকু খেলে আরেকজনের জন্যও হয়ে যাবে এসব কোনদিন ভাবনায় আসত না।নিজের পেট পুরে খেয়ে নিত। একটু কম খেলে ওর মা বোনদের ভাগে একটু বেশি থেকে যেতো এই কথা এখন মনে হয়।
সবার দিকেই নজর রাখা উচিত। নিজের পেট আর নিজেকে নিয়ে ভাবলে দুনিয়াটা নিজের জন্যও একটা সময় কঠিন হয়ে যায়।

আজকাল মমিন অনেক কিছু ভাবে, ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভার হয়ে যাবে নাকি চাচার ফ্যাক্টরিতে যোগ দিবে? চাচা ফ্যাক্টরিতে নিতে চান না, এরকম বিশ্বস্ত লোক বাড়িতেই রেখে দিতে চান।মমিনের প্রায়ই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে ওর কি উন্নতি করার অধিকার নেই! বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে নিজের জন্য খুব বেশি কিছু থাকেনা, এদিকে শেফালীকে বিয়ে করলে সে বিয়ের পর অন্যের বাসায় থাকবে কিভাবে? টাকা ওয়ালা মানুষের জীবনের সব কিছুর সমাধান কত দ্রুত হয়!

এই যে পড়াশোনা করতে এসেছিলো মমিন, পড়তে পারলেওবা কি হতে পারত? এখনো পড়াশোনা করতে থাকত, বাড়িতে একটা টাকাও পাঠাতে পারত না।
এরমধ্যে হুট্ করেই বাবা মারা গেছেন এখন বোনের বিয়ে তাকেই দিতে হবে। সেই টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবে কে জানে।মমিন ঠিকই জানে, বিদেশে যেতে পারলে যেকোনো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মনা ভাই যদি তাকে আমেরিকা নিতে পারত। একটু একটু করে টাকা শোধ করে দিত, আবার কিছুদিন পর শেফালীকেও নিয়ে যেতো। কত জায়গায় ঘুরে বেড়াত। মনা ভাই কত ছবি দেখিয়েছে, বরফের মধ্যেও তিনি নেমেছেন আবার মরুভূমিতেও।
আশ্চর্য দেশ!

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে মমিন। সেই কোন ফজর ওয়াক্তে উঠে সে ঘুমের আর দোষ কি, ঘুমতো আসবেই।
মাঝে মাঝে শেফালির সাথে স্বপ্নে ঘর সংসারও করে মমিন।

শারমিন সারা