পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!

পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!

পড়াশোনা শেষ করেই দুম করে বিয়ে করে ফেলেছি, এরপর চাকরী’র পিছনে ছুটতে যেয়ে কিছুদিন। যৌথ পরিবার, তারপর একদিন, চাকরীতে থাকা অবস্থায় মা হওয়া এবং প্রবাস জীবনে চলে যাওয়া। ‘সংসারটা’ ওভাবে করা হয়ে উঠেনি, মানে বলছিলাম যেভাবে অনেকেই করে!!!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রোকেয়া হল জীবনই’ ছিলো আমার সবচেয়ে সুন্দর সংসার জীবন, বলা যেতে পারে । নিয়ম করে রান্না-বান্না, কাপড় কাঁচা, ঘরদোর গুছানো, রুমমেটদের যত্ন নেয়া। এই সব করা সংসার যাকে বলে!!!

তারপর লম্বা একটা সময় ঢাকা চাকরী জীবন, দিন শুরু আর শেষ। রাস্তার জ্যাম এ দিনের প্রায় ২/৪ ঘন্টা। বাসায় ফিরে রান্না, ঘরদোর গুছানোর সময় কোথায়… গতানুগতিক সংসার জীবন ধারা। মুলতঃ চাকরী করি, খাই দাই, ঘুমিয়ে যাই। তবে হ্যাঁ আবার আমার সেইরকম সংসার শুরু দেশের বাইরে এসেই!!!

প্রবাস জীবনের শুরু, একদিন এক বাসায় বেড়াতে গেছি, সে বাসার আপা (তিন সন্তানের জননী) এবং ভাই (উনার হাজবেন্ড) আমাদের সাথে বসে গল্প করছেন। গেছি ডিনার করতে, হঠাতই গল্পের মাঝখানে (ধরুন ভাইয়ের নাম ‘মিঃ কুল’) আপা বলছেন, ‘কুল’ এখনও উঠলেনা, ভাতটা বসাবেনা!!!

ভাই অনেক সুন্দর করে (ধরুন আপার নাম ‘মিজ ফুল’) বলছেন, ‘ফুল’ উঠছি, এক্ষুনি উঠছি। আরো কিছু সময় পর বলছেন, এই কুল তুমি কি বেগুনগুলো ভেজেছ? আরো কিছু সময় পর বলছেন, এই ডিশগুলো নামাওনি এখনও। ‘কুল’ ভাই বারবার বারবারই ‘ফুল আপা’কে অনেক সুন্দর করে বলছেন এই তো করছি ‘ফুল’ । এই করে নিচ্ছি, গল্প করছেন, আর তার মাঝে ডিনার সারভ করছেন কুল ভাই!!!

প্রথম দুই একবার চমকে গেলাম। গেলাম কারণ, সদ্য বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছি তখন। আমার বাংলাদেশ জীবনে নিজের পরিবার বা দূরের দুই একজন পুরুষসঙ্গীকে এমন দেখলেও তা ব্যতিক্রমই মনে হয়েছে!!!

আমি আবেগী মানুষ, গলায় আটকে থাকা আবেগ, একটু ভালো কিছু দেখলেই সেটা চোখ ঠেলে জানান দিয়ে ফেলে। এমন করে তাইলে বলা যায় স্বামীকে (!) গেস্টের সামনেই, ইশ কারো কারো জীবন তাইলে এমন প্রেমময় হয়, কাংখিত হয়! আহা এমন সম্মান করে কথা বলাটাই তাইলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অংশ!!! যাই হোক, এই ঘটনায় কুল ভালো না ফুল, কে বেশী, এই নিয়ে কিছু বলার অভিপ্রায়ে এই লেখা নয়, যেটা বলতে চাই, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আমরা আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলেকে ঘরের কাজে হেল্পফুল পাই হাতে গোনা। ইন-ফ্যাক্ট বেশীর ভাগ মেয়েও সেটা আশাই করেনা!!!

তবে এটা যে কত বড় ‘অভিশাপ’ ব্যক্তি মানুষ এবং সংসারের জন্যে এটা বোধ হয় জীবদ্দশায় বেশীর ভাগ মানুষ টেরই পায়না বাংলাদেশে!!! সংসারের সবাইকে যদি এই বোধটুকু দেয়া যেত, ‘নিজের জীবন চলানোর মতোন কাজ সবার জানা উচিত, করা উচিত, নারী পুরুষ নির্বিশেষে, পরিবারের প্রতিটা সদস্যের… আহা কত যে গোপন অভিমান আর দীর্ঘশ্বাস আর কাজ করতে করতে ভিতর থেকে হতাশ হয়ে যাওয়া ‘নারী জনম’ এর গল্পই সৃষ্টি হতোনা!!!

এই লেখাটা পড়তে গিয়ে যদি কারো অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে, তাঁকে বলছি হায় কোথায় পাবে তাঁরে!!!

এক জীবনে হয়নাকো পাওয়া সব চাওয়া… মেটেনা সব আশা!!!

তারপরও ছোট্ট পরিসরে বলতে চাইছি যা, আরো একটু পরিষ্কার করেই বলার চেষ্টা করি তা। বিশেষতঃ আমাদের সংসার জীবন চলছে অনেক দীর্ঘ সময়ের ধ্যান ধারণা চেতনা লালন পালন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠী পুরুষ বান্ধবদের ঘরের কোন কাজে সাহায্য এখনও ব্যতিক্রম ধরা হয়। অল্প বিস্তর পরিবর্তন এলেও তা খুব বেশী ইতিবাচক প্রভাব আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থায় এখনও ফেলতে পারছেনা!!! প্রবাস জীবনে এলে আমাদের পুরুষসঙ্গীদের এমন কিছু গুনের দেখা মিলছে। আমাদের লাইফ স্টাইলই হয়তো আমাদেরকে ভীষণভাবে অনুপ্রানিত করছে এমন করে ভাবতে এবং সংসার জীবনে তা প্রয়োগ করতে। খুব ভালো লাগা নিয়ে মুগ্ধতা নিয়েই দেখি আমাদের ভাই বেরাদর বন্ধু বর চাইলেই কি ভীষণ সহযোগী হয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার হাত এই জগত সংসারকে সামনে পরম মমতা নিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়ার!!!

নাদেরা সুলতানা নদী মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া