ফজলুল বারী: রাজনৈতিক লেখায় আমি বারবার একটি কথা লিখি, তাহলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোন রাজনৈতিক দলই রামকৃষ্ণ মিশন বা কোন সেবা প্রতিষ্ঠান নয়। আওয়ামী লীগ যেমন ক্ষমতায় থাকতে চায়, আগামীতেও ক্ষমতায় যেতে চায়, বিএনপিও যে কোন মূল্যে চায় ক্ষমতায় ফিরতে। এখানে সবাই যার যার কৌশলের খেলায় বাজিমাত করতে চায়। যার কৌশল পরাজিত হয়, পরাজিত হয় সে পক্ষ। এখানে পরাজিত পক্ষের নাম খালেদা জিয়া।
দূর্নীতির মামলায় আরেকটি কঠিন সত্য আছে। তাহলো ২-৩ কোটি টাকা দূর্নীতির অভিযোগ প্রমান করা যতোটা সহজ ২-৩ হাজার কোটি দূর্নীতি প্রমান ততোটা কঠিন। এটা এরশাদের জনতা টাওয়ার দূর্নীতির মামলার বিচারেও এটা প্রমান হয়েছে। স্ত্রী রওশন এরশাদকে রওশন আরা বেগম নাম দেখিয়ে কারোয়ানবাজারের জনতা টাওয়ারের জায়গাটি বরাদ্দ দিতে গিয়ে এরশাদ রাষ্ট্রের চার কোটির কম টাকার ক্ষতি করেন। নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে এরশাদের ওই দূর্নীতি প্রমানের পর সাবেক সেনা প্রধান-রাষ্ট্রপতির জেল-জরিমানা হয়। দূর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি দন্ডের কারনে এরশাদ পরবর্তি পাঁচবছর কোন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এখন একই ফাঁড়ায় পড়েছেন খালেদা জিয়া। সর্বেশেষ বুধবার সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্টের আদেশ বহালের পর নিশ্চিত হয়ে গেছে খালেদা জিয়া এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেননা।
খালেদা জিয়ার এতিমখানা দূর্নীতি মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দূর্নীতি মামলা দুটি দায়েরের পর থেকে জানি এই দুটি মামলাকেই ভয় পান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। কারন মামলা দুটির দালিলিক প্রমানাদি শক্ত। টাকা জমা হয়েছে ব্যাংকে। এক একাউন্ট থেকে আরেক একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার হয়েছে। এর সবকিছুর দালিলিক প্রমান হাতে নিয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অপরাধ হচ্ছে এমন কোন এতিমখানার হদিস না থাকলেও এর ঠিকানা হিসাবে খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের তৎকালীন বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলেছে সেখানে জিয়ার দুই এতিম ছেলে থাকতেন শুধু। কোন এতিমখানা ছিলোনা।
এতিমখানার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে টাকা এসেছিল বিদেশ থেকে। সে টাকা পৃথক একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছে। হদিসবিহীন এতিমখানার প্রশ্নে আদালতের কাছে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। জবাব জানা থাকলেতো দেবেন। সবচেয়ে উল্লেখ করার বিষয় হলো খালেদা জিয়ার এসব মামলার হাল-হকিকত বোঝার চেষ্টা করলে দেখবেন আমাদের এসব দল একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে কোনদিন যে ক্ষমতায় নাও থাকতে পারেন সে হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। মামলার ঘটনাটি খালেদা জিয়ার ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এতিমখানাটি অস্তিত্বহীন এবং টাকাগুলো ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা থাকায় তখন আওয়ামী লীগ সরকারও এর হদিস পায়নি! না বিএনপির নেত্রীর অসম্মান করতে চায়নি! এই মামলাটি হয় ১/১১’এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ মামলার নথি সরবরাহ করেন সামরিক গোয়েন্দারা। এরজন্যে আমি বরাবর ক্ষমতাসীনদের সতর্ক করে বলি যে সব সামরিক গোয়েন্দারা সর্বক্ষন তাদের সঙ্গে চলেন থাকেন, দলের নেতাকর্মীদের চাইতে বড় দলবাজের ভূমিকা দেখান, ক্ষমতা চলে গেলে এরাই তাদের বিরুদ্ধে মামলার উৎস হতে পারেন। এরশাদ-খালেদার পরিনতি দেখেও যদি অন্যরা শেখেন।
একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন বিএনপি-জাতীয় পার্টিতে জাদরেল আইনজীবী-সাবেক সেনা কর্মকর্তা বেশি। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাও বেশি বিএনপিতে। এরা ভালোবেসে বিএনপিতে যাননি। জিয়া-এরশাদ যখন সামরিক শাসনের মোড়ক থেকে রাজনৈতিক দল করেন তখন ক্ষমতার মোহে এরা জিয়া বা এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের এত নেতাকর্মীতে সয়লাব ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। ওখানে গিয়ে দাঁড়াবারও জায়গা নেই। তাই শর্টকাট ক্ষমতা মানে ছিল জিয়া-এরশাদ। ওখানে গিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বৃহত্তর ঐক্যের রাজনীতি এমন নানা গালভরা বুলি আওড়েছেন। জিয়া-এরশাদের দল যেহেতু এক জায়গা তথা সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেয়া বলে এগুলোর একটি শক্তিশালী থাকলে আরেকটি দূর্বল হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকতে ব্যারিষ্টার মওদুদ সহ অনেক নেতা জাতীয় পার্টিতে চলে যান। আবার জাতীয় পার্টি দূর্বল হয়ে গেলে মওদুদ, খন্দকার মাহবুব হোসেনরা চলে আসেন বিএনপিতে। এরাই মূলত খালেদা জিয়ার প্রধান আইনজীবী।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এতিমখানা ও জিয়া চ্যারিটেবল দূর্নীতি মামলা চালু হলে তাঁর আইনজীবীরা কৌশলে শুধু দেরিই করিয়েছেন। নানা উছিলায় মামলা বিলম্বিত করা হয়েছে। এমনকি মামলার তারিখ দেখে হরতালও দেয়া হয়। আম জনতা তখন ভেবেছে সরকারি আইনজীবীরা করছেটা কী। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দেরি করছে সরকারি আইনজীবীরা করেটা কী! কিন্তু বিষয়টি যে সরকাপক্ষেরও কৌশল তা পরবর্তিতে স্পষ্ট হয়েছে। খালেদা জিয়ার সাজার রায় এমন সময়ে এলো তা আপীলে আসতে আসতে সময় শেষ। এতিমখানা মামলার আপিলে গিয়ে হাইকোর্টে হেরে গেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। উল্টো নিম্ন আদালতের পাঁচবছরের সাজা বেড়ে সাত বছর হয়েছে। এখন বাকি ছিল সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু আমান উল্লাহ আমানদের মামলাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে দূর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা হলে তেমন কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেননা। এটি তাদের বর্তমান মুরব্বি ড কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়া সংবিধানের বিধান। বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত বিধানটি এখনো বহাল। যার সর্বশেষ বড় শিকারটির নাম খালেদা জিয়া। এখানে আমান উল্লাহ আমানদের উচ্চ আদালতের না’ বলা থেকে বলা হয়ে গেছে খালেদা জিয়াও এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেননা। কৌশলের খেলায় এখানেও হেরে গেলেন খালেদা জিয়া। বাঘা সব আইনজীবী পক্ষে থাকা স্বত্ত্বেও তাঁর স্বাদ না মিটিলো আশা না পুরিলো।