ফজলুল বারী:কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারের একটি তেনা প্যাচানো রিপোর্ট নিয়ে দেশের কিছু মিডিয়ায় হায় হায় রিপোর্ট হচ্ছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কলকাতা সফরকে কেন্দ্র করে ভারতীয় তরফের হেলাফেলার অভ্যর্থনা এই রিপোর্টের বিষয়বস্তু। বিএনপিপন্থী একটি টেবলয়েড প্রথম এটি পুনঃমুদ্রণ করে। সাবেক আমলা, কবি ও কলামিস্ট, কুলাউড়া থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মোফাজ্জল করিম এক টেলিভিশনের টকশোতে বলতে চেয়েছেন এতে করে দেশের মানসম্মান আর রইলোনা! এ নিয়ে ভারতীয় তরফের ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়েছে। মোটামুটি বলার ধরনটি এমন, শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন আমেরিকা সফরে যান তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা করেন আর কী! বাংলাদেশের কিছু লোকজনের মনের ভারত রোগটি লুকোনো কঠিন। প্রায় তা প্রকাশ হয়ে যায়। ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড।
আনন্দবাজারের রিপোর্টটিকে তেনা প্যাচানো বলার একটা ব্যাখ্যা আগে দেই। আমাদের মিডিয়া হাউসগুলোর এটি একটি কমন অভ্যাস। রিপোর্টিং মিটিং’এ জানতে চাওয়া হলো ফজলুল বারী, হাতে রিপোর্ট কী আছে? শেখ হাসিনার ইন্ডিয়া ট্যুর নিয়ে কিছু একটা বানাবেন নাকি? আনন্দবাজারের রিপোর্টটিকে এর বেশি কিছু মনে হয়নি। আনন্দবাজারের লোকজন গল্পের মতো করে রিপোর্ট লিখেন। এ নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা হলো, পাঠককে একটা রিপোর্ট পড়াতে হয়। রিপোর্ট লেখাকে তারা বলেন, ‘কপি লেখা’। গল্পের মতো করে তারা সাজান রিপোর্টের গাঁথুনি। পড়তে ভালো লাগে। আনন্দবাজারের এই রিপোর্টটিও এর বাইরের কিছু নয়। অগ্নি রায় প্রশ্ন রেখেছেন বাংলাদেশের সঙ্গে যেখানে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনা নিয়ে এত অবহেলা কেনো? একজন ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্নটি রেখেছেন তার দেশের সরকারের উদ্দেশে। এর আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন রেখে রিপোর্ট করেছে। এ রিপোর্টগুলোর এঙ্গেল একরকম। বাংলাদেশে এগুলোর উল্লেখ হয় অন্যরকম। আপনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে পারেননা, তাঁর সরকারকে দেখতে পারেননা, খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন সেটা এক কথা, কিন্তু এসব নিয়ে যে যখন ট্রল করেন তখন কী দেশের মর্যাদার কথা মাথায় রাখেন?
এখন শেখ হাসিনার কলকাতা ট্যুর নিয়ে যেটি ঘটেছে আমার ধারনাগুলো লিখি। এটি ভারতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক সরকারি সফর ছিলোনা। সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হওয়া, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখতে নানান আয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও আমন্ত্রন জানান সৌরভ গাঙ্গুলি। শেখ হাসিনাও যেহেতু ক্রিকেট অন্তঃপ্রান তাই আমন্ত্রনটি পেয়েই কবুল করে ফেলেন। এরপর হয়তো বাংলাদেশ পক্ষ ভেবেছে নিরাপত্তাসহ নানা কারনে এভাবে প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা। এসব পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাউন্টার পার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারি দাওয়াতটির ব্যবস্থা করে। এরমাধ্যমে পাওয়া যায় নিরাপত্তা সহ নানা প্রটোকল। কিন্তু চেয়েচিন্তে একটি দাওয়াত পাওয়া গেলেও ওই সময়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির কারনে নরেন্দ্র মোদী যেমন খেলা দেখতে আসেননি, বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন, এটিও চূড়ান্ত হয় শেষ মূহুর্তে।
অনেকে বোকার মতো ভেবেছেন ওই সময়ে মমতার সঙ্গে তিস্তার পানি নিয়ে কথা বলবেন শেখ হাসিনা! এইপক্ষ বুদ্ধিমান হলে ভাবতেন তিস্তার পানি সহ দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা কথা বলবে দিল্লীর সঙ্গে। কোন রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নয়। মমতার নামটি তিস্তার পানি প্রাপ্তির প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও কোথায় কোন কথাটি বলতে হয় তা নিশ্চয় শেখ হাসিনাকে শিখিয়ে দিতে হবেনা। সেখানে ‘কলকাতা’ নামের একটি নিউজ চ্যানেল দেখে মজা পাচ্ছিলাম। সেটির স্ক্রলে উল্লেখ করা হচ্ছিল, ‘মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’। এরমানে দাঁড়ায় মমতার সঙ্গে দেখা করতে শেখ হাসিনা তাঁর অফিসে যাবেন! কার্যত মমতা সৌজন্য সাক্ষাতে শেখ হাসিনার হোটেলে যান। এটাই কার্টেসি। এখন একটি রাজ্যের সাংবাদিকের সঙ্গে জাতীয় সাংবাদিকের ফারাক যদি মেধায় ধরা না পড়ে সেতো মুশকিলের কথা।
ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকার কারনে দেশ শাসনে নিজস্ব একটি স্টাইলের পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগেও নিজস্ব একটি স্টাইল গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার। যেভাবেই যেখানে যাননা কেনো দেশের জন্যে কিছু আদায় করেন। এই যেমন কলকাতায় ক্রিকেট সফরেও ক্রীড়া বিশ্বের নজর ছিল তাঁর দিকে। অবাক সৌরভ গাঙ্গুলি বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হোটেলে যেতে চাইছিলেননা। বলছিলেন তিনি মাঠে থেকে খেলা দেখবেন। এমন ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী যে দেশের আছে সে দেশের ক্রিকেট এগোবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু জন্ম শতবার্ষিকীতে কলকাতা কেন্দ্রিক নানাকাজ তিনি এগিয়ে রেখেছেন এই সফরে। কে কীভাবে বিমান বন্দরে রিসিভ করেছে না করেছে অত কিছু ভাবলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরও বন্ধ রাখার কথা বলা যাবে। এতে দেশের কী লাভক্ষতি? দু’শর বেশি দেশ আছে দুনিয়ায়। দেশে বসে একেকজন নিজেকে লারেলাপ্পা নানাকিছু ভাবতে পারেন। বিদেশ গেলে আমরা নিজেদের ওজন করতে শিখি। এরজন্যে আমি চাই বাংলাদেশের লোকজন, বিশেষ করে সাংবাদিকরা যেন মাঝে মাঝে বিদেশ যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা মনে করতে পারেন। একটি বৈশ্বিক এনজিওর দাওয়াতে একটি পদক গ্রহনের জন্যে তিনি সিডনি গিয়েছিলেন। তখনও অস্ট্রেলিয়া সরকারের দাওয়াতের ঘোষনা আসে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ। রোববার ছুটির দিনে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল সিডনির সরকারি বাড়িতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠকও করেন। ছুটির দিন আর সফরটি সরকারি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়েল ফটোগ্রাফারও সে দিন সে বাড়িতে ছিলেননা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তখন দুই প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলা হয়। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? এমন একটির বৈঠকের অর্জন ছিল রোহিঙ্গাদের জন্যে বিপুল ত্রাণসাহায্য আদায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের প্রতিবাদ জানাতে স্থানীয় বিএনপি পুলিশের অনুমতি পেয়েছিল। দেশে বিএনপি যতকথা বলুক অস্ট্রেলিয়াতেও সভা-প্রতিবাদের আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে সিডনি সফর হলেও সঙ্গে সরকারি আমন্ত্রনটি নিয়ে রাখায় বিএনপির প্রতিবাদের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার আয়োজনটি ছিল দেখার মতো।
আমেরিকা-কানাডা-ব্রিটেন-রাশিয়া কোথাও সরকার প্রধানরা বিমান বন্দরে বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা করেননা। কিন্তু বাংলাদেশের দিনে দিনে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব যে বাড়ছে এটাতো কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার অবিশ্বাস্য ঘটনার পর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়াতে বাংলাদেশ এখন এমন সব আন্তর্জাতিক ফোরামে দাওয়াত পাচ্ছে এটা কিন্তু কলকাতা বিমান বন্দরে কে ছিল না ছিল তা নিয়ে মেকি কান্না করেও অনুজ্জ্বল করা যাবেনা। বিদেশের বিপনি বিতান সমূহ কাপড় কিনতে গেলেই মেইড ইন বাংলাদেশ’ দেখে কি অনুভূতি হয়, এটি দেশে বসে কেউ ধারনা করতে পারবেননা। বাংলাদেশের এসব ইতিবাচক নানাদিক মিডিয়ায় কম আসে। বাংলাদেশের রাস্তা বন্ধ করে বিদেশি অতিথিদের বিমান বন্দরে অভ্যর্থনার রেওয়াজ প্রচলিত। এসব পাল্টানো উচিত। কারন এটি ব্যয়বহুল। এতে মানুষের ভোগান্তি হয়। ভারত রোগ যাদের তাদের বলি, ভারত বন্দনার দরকার নেই। প্রতিবাদটাওতো ঠিকমতো করেননা। বায়তুল মোকাররম মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ একবার চিল্লাইয়াওতো একবার বলেননা, ‘আর কুনুদিন ইন্ডিয়ান পিয়াজ খাইতামনায়, পাচটেকা কেজি দিলেওনা।‘ বাংলাদেশ সবকিছুতে স্বনির্ভর হয়ে উঠলে সবাই বাংলাদেশের কাছে আসবে। আনন্দবাজারের সার্টিফিকেটের জন্যে বাংলাদেশিদের হাপ্যিতাস না করলেও চলবে। কারন ভারতীয় মিডিয়া মানে বাইবেল না।