ফজলুল বারী: চিকিৎসা গ্রাউন্ডে খালেদা জিয়ার জামিন নেয়া যেতো সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের কাছ থেকেই। এমন একটি আভাস আপিল বিভাগের আদেশের মধ্যেই আছে। কিন্তু বিএনপির আইনজীবীদের অতি চাতুর্যে এটা হয়নি। এই অতি চাতুর্য প্রথমে ছিল খালেদা জিয়ার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। ডাক্তারের কাজ করতে দেয়া উচিত ডাক্তারদের। ডাক্তারদের ওপর আইনজীবীগিরি চলেনা। যেমন আইনজীবীদের কাজ ডাক্তার বা অন্য কেউ করতে পারবেননা। আর আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আদায় করতে হয় আদালতকে সমীহ করে। সম্মান দেখিয়ে। যুক্তি দিয়ে। আদালতকে আদালত দেখিয়ে আদালত থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়না। চাপ দিয়ে নিজেদের পক্ষে নেয়া যায়না আদালতের সিদ্ধান্ত। তাও আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে। এ লেখায় এ বিষয়গুলোই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের চেষ্টা করবো।
প্রথম কথা হলো দল হিসাবে বিএনপি এবং এর আইনজীবীরা সব সময় যে সত্যটা এড়িয়ে চলেন তাহলো খালেদা জিয়া যে একজন দন্ডিত অপরাধী হিসাবে সাজা খাটছেন। তাঁর সাজার বিষয়টি চূড়ান্ত আপিল আদালত পর্যন্ত এখনও চূড়ান্ত না হলেও তাঁর সাজার বিষয়টি কোথাও স্থগিত হয়নি। রাজনীতির মাঠে বিএনপি সব সময় বলে বেড়ায় তিনি মিথ্যা মামলায় সাজানো রায়ে বন্দী। কিন্তু আদালতে গিয়ে আইনজীবীরা চান চিকিৎসা গ্রাউন্ডে ‘মানবিক বিবেচনায়’ জামিন। আপিল বিভাগ এরজন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং চিকিৎসার বিষয়ে রিপোর্ট চেয়েছিল। ৬ ডিসেম্বর রিপোর্টটি আসেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিপোর্ট চূড়ান্ত করতে সময় চেয়েছিল। আদালতের কাছে যে কোন কর্তৃপক্ষের সময় চাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। শুনানির প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীরাও সময় চান। কিন্তু এই সময় চাওয়া আর সময় দেয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপির আইনজীবীরা আপিল বিভাগের আদালত কক্ষের ভিতরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন যে তাদেরকে কোর্ট চালাতেই দিলেননা! এটা কী বিমান ছিনতাইর প্লট নাকি! যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের জিম্মি করে তারা সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে নেবেন?
দেশের রাজনীতিবিদ যারা নিজের চিকিৎসা নিয়মিত বিদেশে করেন তাদের একজন হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। দেশের সবচেয়ে সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই হাসপাতালে আছেন এবং তাদের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। দন্ডিত আসামী হলেও দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় বিএনপির চেয়ারপার্সনের চিকিৎসা চলছে তিনকক্ষের এক কেবিন স্যুটে। কিন্তু মির্জা ফখরুল সহ বিএনপির নেতারা শুরু থেকেই এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন! আবার তাঁকে হাসপাতাল থেকে জেলখানায় নেবার কথা উঠলে এরাই আবার ধেই ধেই করে ওঠেন!
এবার এই মির্জা ফখরুলগং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের একবার বলছিলেন তাদের ঘাড়ে মাথা কয়টা! আবার বলছিলেন, সরকারের চাপে চিকিৎসকরা তাদের রিপোর্ট পাল্টাচ্ছেন! মির্জা ফখরুল এক সময় শিক্ষকতা করতেন। মানুষকে সম্মান দেয়া শেখান শিক্ষকরা। মির্জা ফখরুল কী এই শিক্ষা তাঁর ছাত্রদের কখনও দিয়েছেন? যে কোন প্রকৃত চিকিৎসকের প্রথম ভালোবাসা রোগীর স্বার্থ। আর খালেদার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতরা সবাই সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অধ্যাপক। খালেদা জিয়া এখন দন্ডিত অপরাধী হতে পারেন। কিন্তু এখনও দেশের মানুষের কাছে মোটা দাগে তিনি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির প্রধান। এমন একজন রোগিনীর সঙ্গে চিকিৎসকরা হেলাফেলা করবেন, এটা মির্জা ফখরুলের মাপের নেতা ভাবলেন কী করে?
৬ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ যখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রিপোর্টের অপেক্ষায় জামিনের আবেদনের শুনানির নতুন তারিখ ১২ ডিসেম্বর করলেন তখন খালেদার আইনজীবীরা হায় হায় করে বলে ওঠে বলতে থাকেন, এই সাতদিনে যদি তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়! এই সাতদিন যদি তিনি না বাঁচেন! এরপর নজিরবিহীন কায়দায় বিমান ছিনতাইকারীদের মতো জিম্মি করতে চাইলেন তারা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগকে! কোর্টের কাজই তারা সেদিন আর চালাতে দিলেননা! প্রধান বিচারপতিকে বলতে হলো, ‘বাড়াবাড়ির একটি সীমারেখা থাকা উচিত’।
কিন্তু এরপরও বিএনপির সিনিয়র আইনজীবীরা তাদের জুনিয়রদের নিরস্ত করার কোন চেষ্টাই করলেননা! উল্টো তাদের নেতা ‘মাহবুব উদ্দিন খোকন নজিরবিহীন ঘটনার সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন তাদের আইনজীবীরা খারাপ কিছু করেনি। সমস্বরে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, উই ওয়ান্ট জাস্টিস।‘ এটা কি আদালতে আইনজীবীর আচরন? সাধারন কোন আম জনতা যদি এমন দেখে উৎসাহিত করে আদালতে গিয়ে এমন আচরন করে তাহলে কোর্ট অফিসার হিসাবে(আইনজীবীদের আদালতের নিরাপত্তা-মর্যাদা রক্ষার পাহারাদার কোর্ট অফিসার বলা হয়) এই মাহবুব উদ্দিন খোকনের ভূমিকা কী হতো? এভাবে কী কোন আদালতের সহানুভূতি পাওয়া যায়? এরপর আপিল বিভাগে সিসিটিভির ক্যামেরা লাগিয়ে বিএনপি নেত্রীর জামিনের আবেদনের শুনানি করতে হয়েছে।
খালেদা জিয়ার মূল সমস্যা আর্থাইটিজ তথা গেঁটেবাতের সমস্যা। অস্ট্রেলিয়ায় এমন একজন রোগিনীর কেয়ারার হিসাবে আমি এ চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত। এ রোগে ডাক্তাররা প্রথম পেইন কিলার দিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করেন। সেটায় নিরাময় না হলে দেন ইনজেকশন এবং ফিজিওথেরাপি। এর চূড়ান্ত চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। খালেদা জিয়ার এই চিকিৎসা তথা অস্ত্রোপচারও দু’দফায় হয়ে গেছে। এখন ফিজিও থেরাপি, ইনজেকশন ছাড়া তাঁর জন্যে বিকল্প কোন চিকিৎসা নেই। তাঁর চিকিৎসকরা এখন কিছু ইনজেকশন দিতে চান। এই ইনজেকশন দিতে একজন রোগীকে এমআরআই স্ক্যানিং মেশিনে শুইয়ে স্ক্যানিং এর মাধ্যমে ব্যথার জায়গাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সেখানেই ইনজেকশন দিতে হয়। হাড়ের ওপর এই ইনজেকশন দেবার সময় ব্যথা করে খুব।
খালেদা জিয়ার নিশ্চয় সে অভিজ্ঞতা আছে। সে কারনে ইনজেকশনের কথা শুনে তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা দেয়া-সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে তাঁর ক্ষতি হচ্ছে। তাঁর আত্মীয়স্বজন যারা দেখা করতে যান তাদের উচিত তাঁকে বোঝানো। কারন কোন অবস্থাতে ডাক্তারদের সঙ্গে ডাক্তারি চলেনা। যার যে কাজ তা তাকে করতে দেয়া উচিত। তা করতে না দেয়া মানে নিজের ক্ষতি। মুক্ত খালেদা এসব নিজে অন্যদের বুঝিয়েছেন। এখন নিজে নিজের প্রয়োজন বুঝছেননা।
শুরুতে একটা কথা লিখেছি তাহলো চিকিৎসা গ্রাউন্ডেই আদালতকে কনভিন্স করে খালেদার জামিন নেয়া যেতো। এ ব্যাপারে দেশেবিদেশে নানান আদালতের সাবমিশন দেখে আমার ধারনা বলছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবার প্রশংসা করে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যদি আদালতকে বোঝাতেন যে খালেদা জিয়া এখন জামিনে মুক্তি পেলে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর শারীরিক অবস্থার নাটকীয় উন্নতি হবে। কারন ব্যথা-বেদনার রোগের সঙ্গে মানসিক অবস্থার সম্পর্ক জড়িত। হাসপাতালে যত ভালো থাকুন না কেনো বন্দিনী হিসাবে খালেদার মন ভালো নেই। জামিন পেলে মুক্ত পরিবেশ পেলে তাঁর অবস্থার অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত। বিচারপতিদেরওতো এমন একজন বয়স্ক রোগিনীর চিকিৎসা নিয়ে সহানুভূতি আছে। কিন্তু তা না করে সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে জবরদস্তি করতে গিয়ে ভুলপথে সে সুযোগ হারিয়েছেন বিএনপির আইনজীবীরা। তাদের মনে রাখা উচিত ছিল সব জায়গায় জোর করে সবকিছু পাওয়া যায়না। বুদ্ধিতে যুক্তিতে ভালোবাসায় অনেক কিছুই জয় করা যায়। খালেদার পরিবারের উচিত দ্রুত তাঁর প্যারোলে মুক্তির উদ্যোগ নেয়া। তাঁর বয়সী একজন মানুষের সুস্থ বাকি জীবনের জন্যে এখন প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্তের কোন বিকল্প নেই।