পাঁচ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে আসছে সংগ্রাম!

পাঁচ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে আসছে সংগ্রাম!

ফজলুল বারী: যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে মৃতুবরনকারী কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদেরকে শহীদ’ উল্লেখ করায় মোটেই অনুতপ্ত নয় যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম। বরঞ্চ পত্রিকাটির শনিবারের সংখ্যায় লেখা হয়েছে গত পাঁচ বছর ধরেই তারা কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করেনি। শনিবারের সংখ্যায় রাজাকারদের পত্রিকা সংগ্রাম লিখেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে তাদের অফিসে হামলা চালিয়েছে। উল্লেখ্য এই সংগ্রাম পত্রিকাটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী লিখতো। এখন অবশ্য নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদকারীদের দুষ্কৃতিকারী লেখার সাহস করেনি। গত ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে রিপোর্ট ছেপে পত্রিকাটি মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল হবার কারনেই প্রতিবাদের মুখে পড়ে।

তবে সংগ্রামের উস্কানিমূলক ঘৃন্য ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ বা দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রথাগত প্রধান সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আসেনি। গণজাগরন মঞ্চ নামের যে সংগঠনটির কারনে কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত হয়েছিল, সে সংগঠনকেও অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে। দৈনিক সংগ্রামের ঘৃণ্য তৎপরতা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের একটি সংগঠন এর প্রতিবাদে সংগ্রাম অফিস ঘেরাও করে। সংগঠনটির বিক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা এক পর্যায়ে পত্রিকার অফিসের ভিতর ঢুকে ভাংচুর চালায়। পত্রিকা সম্পাদক আবুল আসাদকে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে মাফ চাওয়ায় এবং পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

মাফ চাওয়ার কথা অবশ্য শরমে লিখেনি সংগ্রাম। লিখেছে তাদের সম্পাদককে জোর করে নানা কথা বলতে বাধ্য করা হয়েছে। কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে যুদ্ধাপরাধীদের পত্রিকাটির এমন বিপদে পড়ার খবর প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোও এড়িয়ে গেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবও শরমে চেপে গেছে বিষয়টি। উল্লেখ্য সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদও জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সদস্যদের একজন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা অর্পন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংগ্রাম পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ বিষয়ে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে প্রশ্নটি করলে তিনি এর জবাব না দিয়ে দ্রুত এলাকাটি ছেড়ে চলে যান।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে নিয়ে আমাদের কিছু কার্যক্রম এই সুযোগে সবার সঙ্গে শেয়ার করি। এরশাদের পতনের পর ঢাকায় আমরা প্রিয় প্রজন্ম নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করি। আমাদের অন্যতম প্রধান সম্পাদকীয় নীতি ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্নেহধন্য ছিল প্রিয় প্রজন্ম টিম। আমরা তাকে আম্মা ডাকতাম। শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের মিডিয়া সহযোগী হিসাবে কাজ করছিল প্রিয় প্রজন্ম টিম। গণআদালতে গোলাম আজমের বিচারের রায় বেরুবার পর একমাত্র প্রিয় প্রজন্মই টেলিগ্রাম পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রণয়নেও কাজ করেছে প্রিয় প্রজন্ম টিম। আমাদের টিমের অনুসন্ধানেই প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার একাত্তরের কসাই কাদের নামটি বেরিয়ে আসে। তখন থেকেই কাদের মোল্লার আরেক নাম কসাই কাদের।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিকের পাশাপাশি বেশ কিছু রাজাকার যুদ্ধাপরাধী সাংবাদিকও ছিল। এবং তাদের বেশ কয়েকজন ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যও। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানও ছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এখন যত সিনিয়র সাংবাদিককে টিভি চ্যানেলগুলোর টকশোগুলোয় সারগর্ভ বক্তৃতা দিতে দেখা যায় তাদের অনেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে বসে ডালপুরি খেতেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের গ্রেফতারের পর আমি বিভিন্ন মিডিয়ায় জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে তাদের বহিষ্কার দাবি করে লিখতে থাকি। তখন জাতীয় প্রেসক্লাবের বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাধারন সম্পাদক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তখনও প্রমানীত হয়নি, ওই অবস্থায় তারা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননা। আমি তখন তাকে বলি, বহিষ্কার না করতে না পারেন আপাতত সদস্যপদতো স্থগিত করতে পারেন। ক্লাবের চাঁদা ঠিক সময়ে না দেবার কথা বলে আপনারা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সদস্যপদওতো বাতিল করে দিয়েছিলেন। তখন তিনি আমার কথার আর কোন জবাব দেননি। তখন বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব ভিত্তিক সাংবাদিক রাজনীতির কদর্য এক রূপ বেরিয়ে আসে। পেশাগত উৎকর্ষ বিবেচনায় নয় জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ দেয়া হয় দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে! যেমন আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে দেয়া হলো তিরিশ জনের নাম, এমন আরও তিরিশজনের নাম দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াত প্যানেল থেকে! তখন দুই পক্ষ সমঝোতা করে এদের ক্লাবের সদস্য করে নেয়। প্রেসক্লাবে যে বছর কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানকে সদস্য করা হয় তখন প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়। তাই এই দু’জন যুদ্ধাপরাধী হিসাবে গ্রেফতার-বিচারের সম্মুখিন হলেও তাদের জাতীয় প্রেসক্লাবের সভ্যপদ নিয়ে কেউ কোন কথা বলছিলোনা! গণজাগরন মঞ্চ গঠনের পর শাহবাগের গণজোয়ার থেকে আলটিমেটাম দেবার পর জাতীয় প্রেসক্লাব তড়িঘড়ি করে কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানের সদস্যপদ বাতিল করে। তখন আর কোন অজুহাত দেয়ার সময় কারও ছিলোনা। পিঠ বাঁচানোর তাগিদ তখন সবার ছিল বড় প্রয়োজন।

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অপমান-অসম্মান, সমাজে উস্কানি-নৈরাজ্য সৃষ্টির ধৃষ্ট অপচেষ্টার দায়ে কী এখনও সংগ্রাম পত্রিকার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে? প্রতিবাদ জানিয়ে যেতে হবে প্রিয় প্রজন্ম বাহিনীকে। জাগো বাংলাদেশ। প্রিয় প্রজন্ম জাগো। কোন যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে ধৃষ্ট অপচেষ্টা চালানোর দেশ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ না। নতুন প্রজন্ম প্রতিবাদ জানিয়ে গেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মুখপত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকার বাধ্য হতে পারে।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com