বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের চূড়া বলে কিছু নেই

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের চূড়া বলে কিছু নেই

ফজলুল বারী: করোনা সংক্রমনে বাংলাদেশের পিক টাইম তথা চূড়া কোনটি সেটি নিয়ে দেশের নানা মুনির নানা মত। একদিনে বাংলাদেশের সংক্রমনের হার সোমবার হাজার ছাড়িয়েছে। এরপরও আমার সাধারন ধারনা বাংলাদেশের চূড়া বলে কিছু নেই।
কারন যখন বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় তখন দেশে টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিলোনা। আর এই পরিস্থিতিতেও যে দেশে মানুষ রোগটির হট স্পট ঢাকা শহরের দিকে ছুটে আসতে থাকেন!
এই মহামারীর সময়েও ঈদ শপিং না করলে অপরিণামদর্শী যাদের মন মানেনা! যে দেশের লোকজন দেখবেন এবার ঈদে রোগটি নিয়ে বাড়ি যাবেন! সে দেশে অন্যদেশের মতো করে ফর্মূলা ধরে পিক টাইম, চূড়া খুঁজে লাভ নেই।
এখনও টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দেশে নেই। শুরুতে উন্নত তকমার অনেক দেশেরই টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিলোনা। কারন এ রোগ কোন চেনা খালাতো বোন মামাতো বোন রোগ নয়। এ এক নতুন মহামারী।
এর ওপর এই মহামারী শুরু থেকে বারবার এর নেচার পাল্টেছে। এখনও পাল্টাচ্ছে! মেইড ইন চায়না এক রকম। মেইড ইন ইতালি এক রকম। মেইড ইন চায়না শুধু বুড়োদের পছন্দ করতো।
বাংলাদেশের রোগটা মেইড ইন ইতালি। এটি সবাইকে পছন্দ করে। বাংলাদেশে উপসর্গবিহীন অনেক করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে! অথবা সে রোগীর তখন এন্টিবডি সময় চলছিলো কিনা তা নিয়ে এক বিশেষজ্ঞের এক মত!
টেস্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তাই যখন বাংলাদেশে প্রথম রোগী পাবার সময়টায় তখন দেশে আসলে এর কত রোগী ছিল সে সম্পর্কে আমাদের ধারনা নেই। এখন উদ্বিগ্ন মানুষজন টেস্টের জন্যে নিজেরাই বিভিন্ন কেন্দ্রে ভিড় করছেন।
কিন্তু কেন্দ্রগুলোর সামর্থ্য আর ব্যবস্থাপনার দূর্বলতায় ওই ভিড়ের মধ্যে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হয়তো তাদের অনেক সুস্থ মানুষ আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক আক্রান্ত মানুষ হয়তো টেস্ট করাতে না পেরেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
এর মাঝে তাদের মধ্যে এন্টিবডি গড়ে ওঠায় নিজেরা নিজেরাই তারা সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের প্রকৃত রোগীর সংখ্যা জানা কঠিন। আবার সংশ্লিষ্ট টেকনেশিয়ানদের অদক্ষতায় ভুল রেজাল্টও আসছে!
টেকনেশিয়ানদের এসব অদক্ষতা নিয়েও আচানক হৈ চৈ করার কিছু নেই। কারন আমরা দেশের মানুষ হিসাবে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ঘটির খবর জানি। আমি সাংবাদিক হিসাবে আমার অদক্ষতা জানি এবং তা স্বীকার করি। প্রতিদিন শুদ্ধ হবার চেষ্টা করি।
আপনিও আপনার অদক্ষতা জানেন। কিন্তু স্বীকার করেননা বলে শুদ্ধ হননা। পার্থক্য এখানেই। বাংলাদেশে স্বাভাবিক সময়েও অনেক ক্ষেত্রে এক জায়গার টেস্টে এক রেজাল্ট পাওয়া যেত। এখনতো অস্বাভাবিক সময়। সবার মাথা গরম।
অত চাপ নেবার সামর্থ্যও সব টেকনেশিয়ানের নেই। এরজন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এক দুটি ভুলের ঘটনায় দেশ উচ্ছন্নে গেছে ভাবা যাবেনা। ভুল করতে করতে একজন শুদ্ধ হয়। এভাবে গড়ে ওঠেন একেকজন দক্ষ টেকনেশিয়ান।
বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের দক্ষতা-একাগ্রতার ব্যাপারে আমি আস্থাবান। শুরুতে চিকিৎসক থেকে শুরু করে অনেকেরও অনেক ভুল হচ্ছিল। ভুল থেকেও অনেকে রোগটায় আক্রান্ত হয়েছেন।
সেই ভুলগুলো কমে আসায় চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হবার সংখ্যাও কমে আসছে। রোগীদের নিরলস সেবা দিতে দিতে তাদের অনেকে হয়ে উঠছেন একেকজন মানুষ দেবতা। মানুষের জীবনে এমন দেবতা হবার সুযোগ খুব আসে।
এই মহামারী বাংলাদেশের পুলিশ-সিভিল প্রশাসনের বেশিরভাগ সদস্যকে এরমাঝে মানুষের কাছে দেবতায় পরিণত করেছে। বদলে গেছে পুলিশের চেনা চেহারা। ত্রান যদি শুধু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেয়া হতো ক্ষতি হতো বেশি।
কিছু ত্রান চোর ধরা পড়ছিল। শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় এই চোরগুলো সঙ্গে সঙ্গে ধরায়, ত্রানের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ওতোপ্রতো জড়িত থাকায় চুরির খবর কমে এসেছে। এতে একটা ক্ষতিও হচ্ছে।
কারন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে জনগনের সম্পর্ক এবং আস্থার জায়গাটা কমে আসছে। এখন উপায়ও নেই। দেশের মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে। এখন প্রশাসনে অনেক চমৎকার চমৎকার ছেলেমেয়ে এসেছে। জানপ্রান দিয়ে তারা এখন কাজ করছে।
ব্রাহ্মনবাড়িয়ার এক উপজেলার এক নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এখন নিজে সন্তান সম্ভবা হয়েও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্লান্তিহীন কাজ করেন। রাতে বাসায় ফিরে নিজে গোসল করে নিজের সব কাপড়চোপড় ধুয়ে আগে নিজেকে এবং নিজের অনাগত সন্তানকে নিরাপদ করেন।
সকালে আবার কাজে বেরিয়ে যান। এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এই কর্মকর্তা। তাঁর পিতার যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাঁর মেয়ে এখন দেশের মানুষকে বাঁচানোর যুদ্ধে নেমেছে।
পিরোজপুরের এক উপজেলার নির্বাহী অফিসার সরকারি ত্রান আর উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত ত্রান বন্টনের সমন্বয় করে নিয়েছেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল বানিয়ে কাদামাটির পথ মাড়িয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে তারা প্রকৃত অভাবীদের বাড়িতে ত্রান পৌঁছে দেন।
আমাকে মাঝে মাঝে কিছু ছবি দিয়ে তিনি বলেন, ভাই কোথাও আমার নাম লিখবেননা। উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম লিখে একটা পোষ্ট দিলে তাঁকে উৎসাহিত করে আরও কয়েকশো লোককে ত্রান দেয়ামু।
এমন গনমুখী কর্মকর্তারা যে প্রশাসনে আছেন সে দেশের কোন মানুষের না খেয়ে মরা কঠিন। তবে সবার এই সার্ভিস অব্যাহত রাখতে হবে। মন্ত্রিসভার অন্যতম সক্রিয় সদস্য স ম রেজাউল করিমকে হঠাৎ করে পূর্ত মন্ত্রনালয় থেকে সরিয়ে দেয়ায় পিছনের কুশীলবদের সাফল্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
কিন্তু গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মন্ত্রীকে মৎস ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রনালয়ে নিয়ে আসার সাফল্য দেখছে এই করোনা সময়। এই মন্ত্রনালয়ের অধীনে থাকা কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে নামিয়ে মাছ দুধ ডিম মাংস বিক্রির ভ্রাম্যমান ব্যবস্থাটি এখন এভাবে না চালালে এই সেক্টরের চলতি সময়ের সংকট এখন আরও বাড়তো।
অনেক জায়গায় এসব কৃষি পণ্য এখন ত্রান হিসাবেও কাজে লাগানো হচ্ছে। মন্ত্রীর এলাকার কর্মহীন সাধারন মানুষ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, সাংবাদিক, আইনজীবী, গাড়ির ড্রাইভার, জুতো শিল্পী,
হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সহ বিভিন্ন শ্রেনীপেশার প্রায় ২৯ হাজার পরিবারের তালিকা করে তাদেরকে খাদ্য সহায়তা, জীবানুনাশক সামগ্রী, পিপিই বিতরন করেছেন এই সাবেক পেশাদার সাংবাদিক মন্ত্রী।
এমন মানুষ যে দেশের আছে সে দেশ এই যুদ্ধে হারবেনা। বাস্তব আরেক কারনে বাংলাদেশের মহামারীর পিক টাইম বা চূড়া নিয়ে আমি ভাবিনা। যেমন বাংলাদেশের পিক টাইম নিয়ে আমেরিকার কোন উদ্বেগ নেই।
কিন্তু নিউইয়র্কের পিক টাইম নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ আছে। কারন ওখানে বাংলাদেশের অনেক লোকজন থাকেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের টাকা আসে। ইউরোপের দেশগুলো পরিস্থিতি সামাল দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গার্মেন্টস খুলে দিতে হয়েছে।
নতুবা তারা গার্মেন্টস পণ্যের জন্যে আরেক দেশের বাজারের দিকে ঝুঁকে যেতো। এমন নানা কারনে বাংলাদেশের পিক-অপিকের নিয়ন্ত্রন টাওয়ারটি বিদেশের মতো নয়। বাংলাদেশকে নিজের রক্ষার কৌশলটি নিজেদের মতো করে ঠিক করতে হবে।
যারা সব বাধা ডিঙ্গিয়ে এখন ঢাকার দিকে ছুটে আসছে তারা ত্রান চায় না। তারা ফাইটার। তারা কাজ করতে চায়। ভয় ছড়িয়ে তাদের কে নিয়ন্ত্রন করা যাবেনা। তার সমস্যা শুনে সমাধানের আশ্বাসে আশ্বস্ত করে তাকে নিরাপদ করতে হবে।
বাঁচতে হবে তাঁকে। বোঝাতে হবে এই ঈদ তার জীবনের শেষ ঈদ নয়। ঈদ শপিং কেউ এখন জরুরি শপিং মনে করলে এই সময়ে ঈদে বাড়ি যেতেই হবে মনে করলে এটিই তার জীবনের শেষ ঈদ হতে পারে।
এখন মরলে তার ঈদের পোশাকওয়ালা লাশ ঘরে পড়ে থাকবে। তার স্বামীও তার দাফন করবেনা। নতুন আরেকটা বিয়ে করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কাঁদবে তার দুধের বাচ্চাটা। অতএব সাধু, সাবধান।